শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

অনিয়মের নির্বাচন : দু’টি দেশের গণপ্রতিক্রিয়ার স্বরূপ

মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক | প্রকাশের সময় : ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

যে দেশে আইনের শাসন দুর্বল, সেখানে অনিয়ম হয় বেশি এবং সেই অনিয়মগুলোর কোনো নিষ্পত্তি হয় না। পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে সার্বজনীন ভোটে প্রেসিডেন্ট বা সার্বজনীন ভোটে পার্লামেন্ট নির্বাচনের সময় মারাত্মক কিছু অনিয়ম হয়েছিল। সেসব দেশে, অনিয়মগুলো করা হয়েছিল ক্ষমতাসীনদের শক্তিমত্তার প্রভাবে এবং বিদ্যমান আইনের অপব্যবহার করে অথবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপব্যবহার করে। ওই সব দেশে ওইরূপ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জনগণ যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিল, সেগুলো ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। ওইসব দেশের সে প্রতিক্রিয়াগুলো পৃথিবীর দেশে দেশে সততার পক্ষে, ন্যায়ের পক্ষে এবং নিজেদের অধিকার রক্ষায় সংগ্রামী নাগরিকদের জন্য উৎসাহব্যঞ্জক ও প্রণিধানযোগ্য। আজকের কলামে দুটি দেশের ঘটনা তুলে ধরবো।
তার আগে প্রতিক্রিয়ার রকমফের নিয়ে কিছু কথা। সব দেশেই এক রকম প্রতিক্রিয়া হবে, এটা আশা করা ঠিক নয়। ফিলিপাইনে যা হয়েছে, সেটা হুবহু আরেকটি দেশে না-ও হতে পারে। ইউক্রেনে যা হয়েছে, সেটিও আরেক দেশে অনুষ্ঠিত না-ও হতে পারে। ইন্দোনেশিয়ায় যা হয়েছে, সেটিও হুবহু আরেক জায়গায় কপি করা যাবে না। কোন দেশে কী প্রতিক্রিয়া হবে, তা নির্ভর করে কয়েকটি বিষয় বা আঙ্গিকের ওপর। উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি আঙ্গিক উল্লেখ করছি। এক. ওই দেশের বঞ্চিত ও নির্যাতিত রাজনৈতিক শিবিরের সাংগঠনিক অবস্থান কী রকম। দুই. ওই দেশে নির্যাতনকারী সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণকারী এক বা একাধিক ক্যারিশমেটিক নেতা আছেন কি না, যাকে কেন্দ্র করে মানুষের আবেগ আবর্তিত হবে। তিন. ওই দেশের সাধারণ মানুষ কতটুকু প্রতিবাদী, তথা প্রতিবাদ করতে গিয়ে কতটুকু এগোবে। চার. ওই দেশের সাধারণ মানুষ কতটুকু নিয়তিনির্ভর। পাঁচ. ওই দেশের সরকারের পক্ষ থেকে মিডিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ কতটুকু। ছয়. ওই দেশের সরকারের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ কতটুকু। সাত. ওই দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা রাজনৈতিকভাবে কতটুকু প্রভাবিত। আট. ওই দেশের বিচার বিভাগের ওপর মানুষের আস্থা কতখানি। নয়. বিদেশিরাষ্ট্রের তথা বিদেশি সরকারের সাথে ক্ষমতাসীন সরকারের সম্পর্ক কেমন, অর্থাৎ ক্ষমতাসীন সরকার তার আন্তর্জাতিক সমালোচনা মোকাবেলা করার জন্য কতটুকু প্রস্তুত ও সংগঠিত ইত্যাদি
সুতরাং বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন শাসক কর্তৃক জনগণের ওপর শোষণ ও নির্যাতনের প্রক্রিয়ায় বা ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রক্রিয়ায় মিল থাকলেও এইরূপ শাসকদের বিরুদ্ধে বা প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিক্রিয়া হুবহু এক না-ও হতে পারে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তাই, অন্য দেশের মতো হয়নি। আরো একটি কথা উল্লেখ করার মতো। বিভিন্ন দেশে শাসকেরা বিভিন্ন অজুহাতে বা কারণ দেখিয়ে নিজেদের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। অপরপক্ষে, এমন দেশও আছে যেখানে জনগণ অতি সচেতন এবং জনগণের প্রতিনিধি তথা আইনপ্রণেতা তথা পার্লামেন্ট সদস্যরা অতি সচেতন এবং কেউ যেন ক্ষমতা দীর্ঘায়িত না করে তার জন্য আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। জনগণ তথা তাদের প্রতিনিধিদের সচেতনতা প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান সংবিধান মোতাবেক, নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির মেয়াদ চার বছর এবং কোনো ব্যক্তি পরপর দুইবারের বেশি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হতে পারবেন না। সংবিধানের এ বিধানটি সব সময় ছিল না। একটু ব্যাখ্যা দিচ্ছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে অন্যতম প্রভাবশালী প্রেসিডেন্ট তথা ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ও ক্রান্তিকালীন সময়ের প্রেসিডেন্টদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট। তিনি ডেমোক্র্যাট দলীয় ব্যক্তি। তিনি ১৯৩২ সালে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হন এবং পরবর্তী আরো তিনটি নির্বাচনে তিনি জয়ী হয়েছেন। অর্থাৎ তিনি তিনটি পূর্ণ মেয়াদে রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তবে চতুর্থ মেয়াদ শুরু হওয়ার ১১তম সপ্তাহে তিনি অসুস্থতার কারণে ১২ এপ্রিল ১৯৪৫ তারিখে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় রাষ্ট্রপতি এবং আমেরিকা ও পৃথিবীর ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সময় আমেরিকার রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন। তার বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ বা গুরুতর অভিযোগ ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়নি। মার্কিন আইনপ্রণেতারা রুজভেল্টের রাজনীতি থেকে একটি উপসংহারে এসেছেন। সে কারণে আইন প্রণয়ন তথা মার্কিন সংবিধান সংশোধন করেছেন। সেই আইন মোতাবেক, কোনো ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। এখানে উল্লেখ করছি, আমেরিকা সংবিধান সংশোধন করেছিল যেন ক্ষমতার মসনদে ব্যক্তির প্রাধান্য বৃদ্ধি না পায়। অপর পক্ষে বাংলাদেশে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে, যেন মসনদে ক্ষমতার প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়। এবার আমরা এখন দু’টি দেশের বিষয়ে আলোচনা করছি।
ফিলিপাইন: ফিলিপাইন দেশটির তিন দশক আগের ঘটনা প্রসঙ্গে একটু স্মৃতিচারণ করি। ফিলিপাইনে একজন বহুলালোচিত স্বৈরশাসক ছিলেন, যার নাম ফার্ডিন্যান্ড মার্কোস। তিনি ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৯ সাল ফিলিপাইন পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের সদস্য ছিলেন। পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের সদস্য ছিলেন ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত। ১৯৬৫ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তার শাসনামলে বৈদেশিক ঋণের চাপে এবং অর্থনীতির মন্দার কারণে দেশের সাধারণ মানুষ ভীষণ কষ্টে নিপতিত হয় এবং সরকারের প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরে মর্কোস দেশে সামরিক আইন জারি করেন; সামরিক শাসক হিসেবে তিনি সংবিধান সংশোধন করেন। তিনি মিডিয়ার কণ্ঠ রোধ করেন এবং সরকারের প্রতি বিরূপ জনগোষ্ঠীর ওপর অত্যাচারের স্টিমরোলার চালান। দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি হয়ে ওঠে তার শাসনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। মার্কোস ক্ষমতা ছাড়তে অনাগ্রহী ছিলেন। তার অন্যতম প্রধান সমালোচক ছিলেন তৎকালীন ফিলিপাইন পার্লামেন্ট তথা সিনেটের সদস্য বেনিনো একুইনো জুনিয়র। সিনেটর একুইনো বিদেশে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছিলেন, কারণ ফিলিপাইনে তিনি থাকতে পারছিলেন না। একপর্যায়ে গণতন্ত্র উদ্ধারের নিমিত্তে ব্রতী ও উদ্যোগী সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে আহ্বান ও মনস্তাত্তি¡ক চাপের কারণে একুইনো দেশে ফিরে আসতে মনস্থ করেন। প্রেসিডেন্ট মার্কোস প্রকাশ্যেই হুঁশিয়ারি দেন যে, একুইনো দেশে ফিরে এলে তার জীবন বিপন্ন হতে পারে। এতদসত্তে¡ও একুইনো সিদ্ধান্ত নেন; তিনি স্বদেশে ফিরে আসবেন; ফিলিপাইনের জনগণের নিকট ফিরে আসবেন। তিনি ছিলেন দেশপ্রেমিক ও স্বদেশের মানুষের প্রতি বিশ্বস্ত। একুইনো, একটি অ্যারোপ্লেনের যাত্রী হয়ে ২১ আগস্ট ১৯৮৩ সালে ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলা বিমানবন্দরে পৌঁছেন; প্লেন থেকে বের হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামেন; কয়েক কদম মাত্র হাঁটেন; অনেক দূর থেকে জনৈক আততায়ী তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে; সাথে সাথে একুইনো বিমানবন্দরের টারমাকে লুটিয়ে পড়েন।
ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে আগ্রহী প্রেসিডেন্ট মার্কোসের জন্য সিনেটর বেনিনো একুইনো জ্বলন্ত একটি আতঙ্ক বা একটি সমস্যা ছিলেন বলেই তাকে রাষ্ট্রীয় মদদে হত্যা করা হয়; কিন্তু মৃত একুইনো অধিকতর ক্ষমতাশীল হয়ে ওঠেন। তার স্ত্রী কোরাজন একুইনো স্বামীর রক্ত ছুঁয়ে শপথ করেন, তিনি ফিলিপাইনের স্বৈরশাসক মার্কোসকে ক্ষমতাচ্যুত করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে জনগণের সাথে থাকবেন। দুই বছর এই আন্দোলন চলে। গণ-আন্দোলনের মুখে ১৯৮৫ সালের শেষ দিকে প্রেসিডেন্ট মার্কোস হঠাৎ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঘোষণা দেন। তিনি ভেবেছিলেন হঠাৎ নির্বাচন দিলে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ প্রস্তুতির সময় পাবে না এবং সরকারপক্ষ কারচুপি করতে পারবে। জনগণের পক্ষ থেকে কোরাজন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যদিও জনগণ ব্যাপকভাবে ভোট দেয় কোরাজনের অনুকূলে; কিন্তু অনিয়ম, জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে মার্কোসকে ‘বিজয়ী’ ঘোষণা করা হয়। এই ফল ঘোষণার তারিখ ছিল ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬; কিন্তু ফিলিপাইনের সাধারণ মানুষ তথা ভোটাররা এই ফলাফল মানতে অস্বীকৃতি জানায়। ঐতিহাসিক ৮ ফেব্রুয়ারি বিকেল থেকেই গণ-আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। মার্কোসের সমর্থকগোষ্ঠীর মধ্যে ছিল সশস্ত্রবাহিনী এবং খ্রিষ্টান ক্যাথলিক গির্জার কর্তৃপক্ষ।
নির্বাচনে অনিয়ম, জালিয়াতি ও প্রতারণার প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে ওই আমলের ফিলিপাইন সশস্ত্রবাহিনীর অনেক অফিসার ও সৈনিক সরকারের হুকুম মানতে অস্বীকার করেন (যেমন ১৯৯০ সালের নভেম্বর মাসের শেষাংশে এবং ডিসেম্বরের প্রথমাংশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জ্যেষ্ঠ অফিসাররা তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি এরশাদের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করেছিলেন)। ওই বিদ্রোহী অফিসার ও সৈনিকেরা জনগণের কাতারে গিয়ে শামিল হন। ক্যাথলিক গির্জা কর্তৃপক্ষ জনগণের খুব প্রিয় ছিল এবং জনগণ তাদের খুব মান্য করত। একপর্যায়ে গির্জার কর্তৃপক্ষ (ইংরেজি পরিভাষায়: দি হায়ারার্কি অব দি ক্যাথলিক চার্চ), মার্কোসের ওপর থেকে তাদের সমর্থন বা আশীর্বাদ প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে গণবিপ্লব ব্যাপক ও খুব বেগবান হয়ে ওঠে। গণ-আন্দোলনের মুখে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের পরামর্শে ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬ তারিখে মার্কোস তার স্ত্রী ইমেলদাসহ ম্যানিলা তথা ফিলিপাইন থেকে আকাশপথে পলায়ন করেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি কোরাজন একুইনো প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন এবং পরে প্রেসিডেন্টের মেয়াদ পূর্ণ করেন।
নাইজেরিয়া: পশ্চিম মধ্য আফ্রিকার অন্যতম সমৃদ্ধ দেশের নাম নাইজেরিয়া। জনসংখ্যার মধ্যে বিভিন্ন ধর্মের অনুপাতের ভিত্তিতে নাইজেরিয়া একটি মুসলিমপ্রধান দেশ; ওআইসি’র সদস্য এবং তেলসমৃদ্ধ দেশ হওয়ার সুবাদে ‘ওপেক’ নামক আন্তর্জাতিক তেল রফতানিকারক দেশগুলোর সংগঠনের সদস্য। সাম্প্রতিককালে নাইজেরিয়া বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজের বা সচেতন অংশের কাছে বিশেষ কারণে পরিচিত, তা হলো- ‘বোকো হারাম’ নামক একটি উগ্রবাদী ধর্মীয় গোষ্ঠীর সহিংস কর্মকান্ড। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছেও নামটি পরিচিত, কারণ নাইজেরিয়া আন্তর্জাতিক ফুটবলে তথা বিশ্বকাপে সম্মানজনক অবস্থানে। ওই নাইজেরিয়ায় ১৯৯৩ সালে যিনি সেনাবাহিনী প্রধান ছিলেন, তিনি ১৭ নভেম্বর ১৯৯৩ তারিখে সরকারের বিরুদ্ধে রক্তপাতহীন বিদ্রোহ বা বিপ্লব ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন (যেমন, বাংলাদেশে ২৪ মার্চ ১৯৮২ তারিখে তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রক্তপাতহীন বিদ্রোহের মাধ্যমে নির্বাচিত বিএনপি সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিলেন)।
বিভিন্ন ফরমান জারির মাধ্যমে নাইজেরীয় সেনাপ্রধান বিচার বিভাগের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সাধারণ মানুষের নাগরিক অধিকার মারাত্মকভাবে খর্ব করেন। ওই সেনাবাহিনী প্রধান ছিলেন একজন চার তারকা জেনারেল; নাম তার সানি আবাচা। এই ব্যক্তি এক দিকে যেমন ধিকৃত ছিলেন ক্ষমতা দখলকারী হিসেবে, অপর দিকে মানুষ সমীহ করত অর্থনৈতিক অঙ্গনে তার সরকারের চমকপ্রদ কিছু সাফল্যের জন্য। ১৯৯৩ সালের নভেম্বরে ক্ষমতা গ্রহণের সময় নাইজেরিয়ার বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ছিল ৪৯৪ মিলিয়ন ডলার; চার বছর পরে এই রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। তার ক্ষমতা গ্রহণের সময় নাইজেরিয়ার বৈদেশিক ঋণ ছিল ৩৬ বিলিয়ন ডলার। চার বছর পর এই ঋণ কমে এসে দাঁড়ায় ২৭ বিলিয়ন ডলারে। আবাচার পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট যেসব বিতর্কিত প্রাইভেটাইজেশন কর্মসূচি চালু করেছিলেন, সেগুলো তিনি বন্ধ করে দেন। সানি আবাচা ক্ষমতা গ্রহণের সময় নাইজেরিয়ার মুদ্রাস্ফীতি হার ছিল ৯৪ শতাংশ; কিন্তু পাঁচ বছরের মাথায় এটি কমিয়ে মাত্র ৮ দশমিক ৫ শতাংশে আনা হয়। এগুলো ছিল সানি আবাচার সাফল্য।
তবে তার বিরুদ্ধে অভিযোগেরও শেষ ছিল না। একটি বড় অভিযোগ ছিল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে দমন। এর মানে, হয় গুলি করে মেরে ফেলা অথবা ফাঁসি দেয়া, নয়তো দীর্ঘমেয়াদি জেল দেয়া। আবাচার বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ ছিল, তিনি, তার পরিবার এবং তার সমর্থক একটি ক্ষুদ্র রাজনৈতিক গোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ করে অবৈধভাবে দেশের বাইরে পাচার করেছেন। অর্থাৎ ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ। একটি রিপোর্ট মোতাবেক তিনি ৫ বিলিয়ন পাউন্ড আত্মসাৎ এবং বিদেশে পাচার করেছিলেন। আবাচার দুর্নীতির অনেক কিছুই আবিষ্কার করা হয় তার মৃত্যুর পর। তার ছেলে মোহাম্মদ আবাচা ২০০২ সালে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার রাষ্ট্রকে ফেরত দিতে সম্মত হয়েছিলেন। ক্ষমতায় থাকার সোয়া চার বছরের মাথায় জেনারেল সানি আবাচা নির্বাচনের ঘোষণা দেন, যে নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নির্বাচিত বেসামরিক ব্যক্তির কাছে যাওয়ার কথা। তিনি ১ অক্টোবর ১৯৯৮-এর আগেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের এবং ওই নির্দিষ্ট দিনেই ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনা করেন। দেশবাসী এবং বিদেশি সরকারগুলো তার এই পদক্ষেপকে সতর্কভাবে স্বাগত জানায়।
১৯৯৮ সালের এপ্রিল-মে মাসের দিকে পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টিতে এটা ভেসে ওঠে, তিনি দেশের পাঁচটি রাজনৈতিক দলকে বিভিন্ন উপায়ে (যথা টাকা-পয়সা ঘুষ বা ভবিষ্যতে ক্ষমতার অংশীদার করার প্রতিজ্ঞা প্রদান বা ভীতি সৃষ্টি করা ইত্যাদি উপায়ে) বাধ্য করেন যেন ওই পাঁচটি দল সম্মিলিতভাবে তাকে একমাত্র রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেয়; কিন্তু বিধি বাম! জেনারেল আবাচা নিজের ভাগ্যের লিখন পড়তে পারেননি। সারা দেশে যখন নির্বাচনী তোড়জোড়ে গরম হয়ে উঠছে, তর্ক-বিতর্ক জমে উঠছে, তখন ১৯৯৮ সালের জুন মাসের একটি দিনে অতি প্রত্যুষে, প্রেসিডেন্সিয়াল প্রাসাদের মধ্যে প্রেসিডেন্ট সানি আবাচা নীরব মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুটা যেহেতু হঠাৎ ছিল, সেহেতু পোস্টমর্টেমের মাধ্যমেই জানা যেত এর সঠিক কারণ। কিন্তু পোস্টমর্টেম করতে না দিয়ে, দিনে দিনেই তাকে দাফন করা হয়। তার মৃত্যুর তাৎক্ষণিক কারণ বা অজুহাত বা মাধ্যম প্রসঙ্গে বহু কথা প্রচলিত আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য হলো, যত শত মিলিয়ন ডলার বা যত বিলিয়ন ডলারই সানি আবাচা আত্মসাৎ করে থাকুন না কেন, এই আত্মসাৎ ছিল দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান্তরাল একটি কর্মসূচি এবং আবাচা কবরে যাওয়ার সময় সাথে কিছুই নিয়ে যেতে পারেননি।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (13)
Ahammad Ali ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১:২২ এএম says : 0
৩০ শে ডিসেম্বর কোন নির্বাচন হয়নি, নির্বাচন হয়েছে ২৯ শে ডিসেম্বর,১৮ রাতে। এক কলন্কজনক তামাসার নির্বাচন। যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন মনে থাকবে।
Total Reply(0)
Rasel Majondar ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১:২৩ এএম says : 0
30 শে ডিসেম্বর কোন নির্বাচনে হয় নাই এটাই হলো একটা তামাশার নির্বাচন ফলাফল নির্ধারিত সময় দিন ছিল
Total Reply(0)
Md Rezaul ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১:২৪ এএম says : 0
ফেরাউন অনেক ক্ষমতার মালিক ছিল, তার ভয়ে রাজ্যের সবাই তার বিরুদ্ধে কোন কথা বলত না। আল্লাহ্‌ তাকে অনেক সম্পদ দিয়েছিলেন তার মানে এই নয়, আল্লাহ্‌ ফেরাউনকে ভাল বাসতেন। আল্লাহ্‌ অত্যাচারী ফেরাউনকে নীল নদে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। দুনিয়ার সব জালিমদের জুলুম একদিন ধবংস করবেন।
Total Reply(0)
Everthing Shohel ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১:২৫ এএম says : 0
যদি আপনার কথা সথ্য হয় তাহলে ঐক্য ফ্রন্টের নেতা কর্মিরা কোথায় ছিল ২৯ ডিসেম্বর রাতে, তারাই তো ঘোষণা দিয়েছে কেন্দ্র পাহারা দিবে। তাহলে পাহারা দারাই ভোট দিয়েছে, মোবাইল ফোনে ভিডিও কারা যাবে ৩০ ডিসেম্বর দিনে, তাহলে রাতের অংশ টুকু কেন ভিডিও করল না ঐক্যফ্রন্ট কর্মিরা।
Total Reply(0)
Yousuf Mahmoud ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১:২৫ এএম says : 0
৩০ শে ডিসেম্বর রাতের অন্ধকারে কি ঘটেছিল তা এ দেশের জনগণ খুব ভালো করেই জানে। প্রশাসন কে ব্যাবহার করে আওয়ামীলীগ সারা দেশে যে ভোট ডাকাতি করেছিল তা ইতিহাসে কালো অধ্যায় হিসেবে রচিত হবে। যে দলের নেতা কারাগারে তার প্রতি আআওয়ামীলীগ এতো ভীতসন্ত্রস্ত কেন? খালেদা জিয়া কারাগারে থাকা সত্বে ও কেন নির্বাচনে আওয়ামীলীগ এত বড়ো কারচুপি করলেন?
Total Reply(0)
Wahid Zaman ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১:২৬ এএম says : 0
ধন্যবাদ, দেরীতে হলেও সত্য প্রকাশ করার জন্য, এদেশের মিডিয়া গুলো ভয়ে বোবা হয়ে গেছে। জনগণ নির্বাক! দেশের রক্ষক করেছে ভক্ষণ গনতন্ত্র আজ নির্বিকার!
Total Reply(0)
Md Anwar ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১:২৬ এএম says : 0
নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন ছাড়া জনগণ ভোট কেন্দ্রে যেতে পারবে না এইটা প্রমাণিত হয়েছে
Total Reply(0)
T.M.ferdausur Rahman ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১:২৭ এএম says : 0
৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনকে যারা কলঙ্কিত ও ভুয়া না বলে, ইনিয়ে বিনিয়ে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করে, আসলে তারাই ভুয়া এবং কলঙ্কিত।
Total Reply(0)
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১:২৭ এএম says : 0
Each people of Bangladesh asked for anyone Truly or dial any Number of Bangladesh they will say what happened in national Election 2018.....
Total Reply(0)
রুপালী ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১:২৮ এএম says : 0
এ নির্বাচন হবে ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায়
Total Reply(0)
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১:২৮ এএম says : 0
So, the only solution for the end of the debate, and for long term peace in Bangladesh is - to arrange free, fair and neutral national election under non-political neutral care taker govt. I think no party will be loser from the system.
Total Reply(0)
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১:২৯ এএম says : 0
৩০ তারিখে কি আসলে ভোট উৎসব হয়েছে নাকি ভোট ডাকাতি হয়েছে? এই নিয়ে একটা জরীপ ইনকিলাব করতে পারে। তবে বামদল গুলো যা বলছে তা কিন্তু ভুল না, এবারের নির্বাচন আসলে সব দিক থেকেই ডাকাতির নির্বাচন হয়েছে। ভোট চুরি মানে হলো লোকচক্ষুর আড়ালে ভোট দেয়া আর ভোট ডাকাতি হলো প্রকাশ্যে সবার সামনে নিজের মার্কায় সিল মারা। ভাবতে অবাক লাগে, এমন নির্বাচন করে ইসি, পুলিশ পার্টি করে বেড়ায়। আর আমরা এতোসব দেখেও কোন প্রতিবাদ করতে পারছি না! তবে আশার কথা হলো এই যে, সব অন্ধকারের শেষে কিন্তু আলো থাকে। দেখা যাক আর কতদিন অপেক্ষায় থাকতে হবে ঐ আলো দেখার জন্যে।
Total Reply(0)
বি চৌধুরী ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১:২৯ এএম says : 0
সবকিছুতেই রোলমডেল ! তাই এবার গণতন্ত্র হত্যা করে কলংকিত নির্বাচনের রোলমডেল হলো.
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন