শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সাহিত্য

মেলার মাঠ থেকে বলছি ...

| প্রকাশের সময় : ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৬ এএম

পুঁথিঘরের বই বাজারের সেরা’-টিনের প্লেটে এই বিজ্ঞাপন অনেকেই দেখে থাকবেন। মূলত পথের ধারের গাছের গায়ে অথবা দেয়ালে সাঁটা থাকত এই বিজ্ঞাপনটি। এখন যেভাবে বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপনে সয়লাব হয়ে থাকে শহরের দেয়ালগুলো। একসময় বইয়ের এমন বিজ্ঞাপন সবার নজর কেড়েছিল। শহরের আগে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে এই বিজ্ঞাপনটি পৌঁছে গিয়েছিল। পুঁথিঘরের সেই বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি আরেকটি বিজ্ঞাপন বেশ জনপ্রিয়তা পায়। শুধু জনিপ্রয়তাই পায়নি, রীতিমতো শ্লোগানে পরিণত হয়েছিল আর সেটি হলো ‘প্রিয়জনকে বই উপহার দিন’ অফসেট মেশিনে রঙিন পোস্টারে ছাপা এই বিজ্ঞাপনটি নিয়ে এসেছিল- মুক্তধারা। আমাদের এই যে বইমেলার বৃহৎ কলেবর এর সূচনায় যাঁর অবদান স্বীকার্য তাঁর নাম শ্রী চিত্তরঞ্জন সাহা। মুক্তধারা ও পুঁথিরের সত্ত্বাধীকারী ছিলেন তিনি। ১৫১ সালে নোয়াখীল জেলার চৌমুহনীতে ছিল তার পুঁথিঘর নামের বইয়ের দোকান। ৯৫৬ সালে যা ঢাকার পাটুয়াটুলীতে নিয়ে আসেন। ১৯৬১ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পুঁথিঘর থেকে মাধ্যমিক, উ’চ মাধ্যমিক ও স্নাতক শ্রেণির পাঠ্যবই প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৭০ সালে তিনি সৃজনশীল সাহিত্য প্রকাশনার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠা করেন পুঁথিঘর সাহিত্য সংসদ। শওকত ওসমানের ‘কৃতদাসের হাসি’ ‘উভশৃঙ্গ’, ড. নিলীমা ইব্রাহিমের ‘দুই বাঁক এক পথ’ বইগুলো এখান থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এরপর তিনি মুক্তধারা নামের একটি সৃজনশীল বই প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠান থেকেই প্রকাশিত বই নিয়ে তিনি ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমির দক্ষিণ গেটে আমগাছের নিচে চট বিছিয়ে খোলা মাঠে প্রথমবারের মতো বই বিক্রি শুরু করেছিলেন। তখন মুক্তধারা থেকে প্রকাশিত মাত্র ৩২ টি বই ছিল তার সেই চটের বইমেলার সম্ভার। সেই থেকে শুরু...তারপর আজকের এই বৃহৎ পরিসরের বইমেলা আয়োজন হচ্ছে। বইমেলায় লোকসমাগম এতটাই বেড়ে গিয়েছে যে বাংলা একাডেমি সামনে যতটুকু উঠোন আছে তাতে লোকজন ঠাঁই দেওয়া যাচ্ছিল না। তাই ২০১৪ সাল থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে সংযুক্ত করে বইমেলা আয়োজিত হচ্ছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজন করা এর আগের প্রায় সব মেলাতেই নানান অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেলেও এবারের আয়োজনে তার কাটিয়ে উঠতে পেরেছে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ। ‘অন্য যে কোন বছরের চেয়ে এবারের বইমেলা গোছানো, পারিপাটি। সুবিন্যস্ত স্টল। হাঁটা-চলা করার মতো যষ্টে খালি জায়গা পাওয়া যাচ্ছে। তবে এর মাঝেই কিছুটা খামতি আছে। ধূলোবালিও বেশ ভোগাচ্ছে।’ এ কথাগুলো বলছিলেন একজন প্রকাশক। বইমেলা দিনে দিনে জমে উঠছে। পাঠকদের ভিড় বাড়ছে। তারা বই নেড়েচেড়ে দেখেছে। কিন্তু দেখাতেই যেন সার। যতটা দেখা হচ্ছে ততটা বই তারা কিনছে না। একজন পাঠকেরা কাছে জানতে চাইলাম, ‘কী কী বই কিনেছেন?’
তিনি মৃদু হেসে বললেন, ‘এখনও কোনো বই কিনিনি। দেখছি। তালিকা তৈরি করছি। ১৫ তারিখের পর কেনা শুরু করব।’
কথা হল শুদ্ধ প্রকাশের সত্ত্বাধীকারী হিরণ¥য় হিমাংশুর সাথে। তিনিও বললেন, ‘এখনও তেমনভাবে বই বিক্রি হচ্ছে না। হয়তো কিছু দিনের মধ্য পাঠক বই কিনতে শুরু করবে।’
‘সাধারণত প্রথম সপ্তাহে সব বই মেলায় আসে না। পাঠকও কেনে না। তারা গ্রন্থতালিকা বা বিজ্ঞাপন দেখে বইগুলো বাছাই করে রাখে। দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে মোটামুটি সব ধরনের বই স্টলে চলে আসে। পাঠকও কিনতে শুরু করে।’ বলছিলেন পার্ল পাবলিকেশন্স এর প্রকাশক হাসান জায়েদি। তার কথার সাথে মিলিয়ে দেখা গেল অনেকে বন্ধুদের সাথে দলবেঁধে মেলায় এসেছে। স্টলে স্টলে ঘুরছে। আড্ডা দিচ্ছে। কিন্তুু বই কিনছে না। ব্যতিক্রমও চোখে পড়ল। কারো কারো হাত ভর্তি বই। এমন একজনকে দেখে এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইলাম, ‘আপনি তো অনেক বই কিনেছেন?’
তিনি মৃদূ হেসে বললেন, ‘জি, আর আসার সুযোগ হবে না। তাই কিনে নিলাম।’
জানতে চাইলাম, ‘কোথা থেকে এসেছেন আপনি?’
তিনি হাঁটতে হাঁটতে জবাব দিলেন, ‘আমি এসেছি রংপুর থেকে। আজই ফিরে যাব। তাই পছন্দের বইগুলো কিনে নিয়ে বাড়ি যাচ্ছি।’
মূলত ঢাকার বাইলে থেকে আসা পাঠকেরা বই কিনে নিয়ে যাচ্ছে। ঢাকা বা তার আশপাশে যারা থাকেন তারা প্রায় প্রতিদিনই মেলায় আসেন। শুধু বই দেখতে বা কিনতে নয়। বন্ধুদের সাথে দেখা করতেও আসে অনেকে। বইমেলা তো শুধু বইয়ের মেলা নয়। মিলনমেলাও বটে। বাংলা একাডেমির সামনের চত্ত¡র, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ছাড়াও টিএসসি ও দোয়েল চত্ত¡রের সামনে আড্ডা দিতে দেখা গেছে শত শত মানুষকে। তারা সবাই বইমেলাকে কেন্দ্র করে একত্রিত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও লোকজন এসে জমায়েত হয়ে থাকে এসব আড্ডায়।
এবারের মেলায় নতুন আকর্ষণ ‘লেখক বলছি’ নামের একটি আয়োজন। এর জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে বাঁশ দিয়ে একটি চমৎকার মঞ্চও বানানো হয়েছে। মঞ্চে নির্ধারিত কবি অথবা লেখক বসবেন। তার নতুন বই নিয়ে প্রশ্ন করবেন উপস্থাপক। একজন কবি বা লেখক নিজের লেখা সম্পর্কে, বই সম্পর্কে কথা বলবার জন্য সময় পবেন বিশ মিনিট। লেখক ও বই বাছাই করে দিচ্ছে মেলা কর্তৃপক্ষ। যেদিন লেখক কথা বলবেন তার আগের দিন তার বই জমা দিতে হবে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের কাছে। সেখান থেকে প্রতিদিন পাঁচজনকে নির্বাচন করে দেয়া হয়। তারাই পরে আলোচনায় অংশ নেন। প্রতিদিন পাঁচজন লেখক এখানে কথা বলতে পারেন তার নিজের বই নিয়ে। নবীন-প্রবীণ সব লেখকের কাছেই এ আয়োজনটি আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। দিন দিন বাড়ছে এর প্রতি লেখক পাঠকদের আগ্রহ। আগের মেলায় ‘লেখক কুঞ্জ’ নামে একটি স্টল লেখকদের আড্ডার জায়গা হিসেবে রাখা হত। কিন্তু সেখানে লেখকদের তেমন আড্ডা বা গল্প করতে দেখা যেত না। একসময় দেখা যেত লেখক কুঞ্জে লেখক নয়, দর্শনার্থীরা বসে ক্লান্তি দূর করছে। কিন্তু এবার ‘লেখক বলছি’ চালু আয়োজনটি করার লেখকদের মাঝেও অন্যতম আকর্ষণ ও আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
এ সপ্তাহে মেলায় আসা নতুন বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু বই হলো, কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের ‘নির্বাচিত গল্প’ ও আজহার শাইনের ‘লোককবি রাধারমন জীবন দর্শন ও কবিতা’ প্রকাশ করেছে ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ। তা¤্রলিপি থেকে প্রকাশিত হয়েছে নাট্যকার শফিুকুর রহমান শান্তনুর উপন্যাস ‘গবলিন’ কথাশিল্পি নাসরীন জাহানের প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে এবার বইমেলায় ‘এসেছি সূর্যাস্ত থেকে’ নামের কবিতার বইটি প্রকাশ করেছে পাঞ্জেরি। এছাড়া এই লেখকের ‘সারারাত শিশিরের কান্না, ‘সিসেমের দ্বিতীয় দরজা’ প্রকাশ করেছে অন্য প্রকাশ। নন্দিতা প্রকাশ এনেছে কবি রাশিদা তিথির ‘তুমি আমার চোখের জলে’ ঐতিহ্য প্রকাশ করেছে মেহেদী উল্লাহর ‘অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগ ও মেহেদী ধ্রবর মেঘ ও মানুষের গল্প’ বেহুলাবাংলা প্রকাশ করেছে আহমেদ সুজনের প্রথম উপন্যাস ‘অতঃপর একটি সম্পর্কের মৃত্যু’ ও কথাসাহিত্যিক বাসার তাসাউফের মুক্তিযুদ্ধর উপন্যাস ‘স্বর্গগ্রামের মানুষ’ এবং সমগ্র প্রকাশ এনেছে জাহান রিমার ‘যে তুমি মানুষ খোঁজো’ অন্যপ্রকাশ এনেছে সাইদ আজাদের ‘অগ্নিপ্রভাত’ দাড়িকমা এনেছে মনিরা জাহানের ‘কানামাছি’ বাংলার প্রাকশন এনেছে ইশরাত জাহান শান্তার প্রিয় কৃষ্ণ আকাশ, সারোয়ার কামালের এই বিষাদ যাবে না কোনদিন আল আমিন মোহাম্মদের ‘মোরাল অব দা স্টোরি’ জেব্রাক্রসিং এনেছে কবি ফরহাদ মেঘনাদের ঊনশপলা দুখ ও মোহাম্মদ জসিমের মিথ্যেরা সাতবোন। প্রতি বছর শিশু-কিশোরদের বইয়ের আলাদা চাহিদা থাকে। শিশু-কিশোরদের বইয়ের মধ্যে উল্লোখযোগ্য কিছু বই হলো: মীম নোশিন নাওয়াল খানের ‘টুপিটুন’ এনেছে বিদ্যাপ্রকাশ। সাইফুল ইসলাম জুয়েলের ‘গীতাঞ্জলি চুরির রহস্য’ প্রকাশ করেছে বাবুই প্রকাশ।

বাসার তাসাউফ

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন