বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

বিজিবির মামলা : পুরুষশূন্য গ্রাম

| প্রকাশের সময় : ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

গত মঙ্গলবার ঠাকুরগাঁও জেলার হরিপুর উপজেলার বহরমপুর গ্রামে বিজিবি’র গুলিবর্ষণে তিনজন নিহত ও অন্তত ১৫ জন আহত হওয়ার তিনদিন পর গত শুক্রবার বিজিবির তরফে হরিপুর থানায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এক মামলায় আসামী করা হয়েছে ১৯জনকে। তাদের মধ্যে ওইদিন নিহত দু’জনও রয়েছেন। তারা হলেন স্কুল শিক্ষক নবাব উদ্দিন ও কৃষক সাদেক আলী। তাদের সঙ্গে নিহত অপরজন এক শিশুশিক্ষার্থী, যার বয়স ১২ বছর। গরু চুরি ও বিজিবি’র কাছ থেকে গরু ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টার অভিযোগ এই মামলাটি করা হয়েছে। অন্য মামলায় আসামী করা হয়েছে দু’শতাধিক লোকের বিরুদ্ধে। তাদের বিরুদ্ধে বিজিবি’র দায়িত্ব পালনে বাধাদান, হামলা ও অস্ত্র লুটের চেষ্টার অভিযোগ আনা হয়েছে। এ দুটি মামলা দায়েরের পর শোকাচ্ছন্ন বহরমপুর গ্রামে ব্যাপক আতংকের সৃষ্টি হয়েছে। গ্রামটি এখন পুরুষশূণ্য হয়ে পড়েছে। বলার অপেক্ষা রাখেনা, বিজিবির গুলিতে হতাহতের ঘটনায় ওই গ্রামসহ সংশ্লিষ্ট এলাকায় মানুষের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ দেখা দেয়। তারা ইতোমধ্যে ঘটনার বিচারের দাবিতে সমাবেশ, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করেছে। মামলা দায়েরের পর এ জাতীয় কর্মসূচী পালনও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। গ্রেফতারের ভয়ে বহরমপুর গ্রামের পুরুষেরা গ্রামছাড়া অথবা আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হয়েছে। প্রতিবাদের দরজাও কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। বিজিবির মামলা দায়েরের পর বিষয়টি থানা কর্তৃপক্ষের অধীনে চলে গেলেও গ্রামটিতে বিজিবির আনাগোনা থামেনি। গত শনিবার সকালে বিজিবি তিনজনকে আটক করে বিওপিতে নিয়ে যায়। দু’ঘণ্টা পর অবশ্য তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে তার কার্যারম্ভের পর তিন দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। ঠাকুরগাঁ-২ আসনের সংসদ সদস্য হতাহতদের সমবেদনা জানাতে গিয়ে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের আশ্বাস দিয়েছেন। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে এলাকাবাসী অধিনায়কসহ বিজিবির সংশ্লিষ্ট সকল সদস্যের প্রত্যাহার দাবি করেছে। পর্যবেক্ষকরা আশা করেছেন, নির্মোহ ও নিরপেক্ষ তদন্ত হলে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে।
ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া দরকার। দায়ী ব্যক্তিদের যথোচিত শাস্তি হওয়াও দরকার। ভবিষ্যতে যাতে এরূপ ঘটনা না ঘটে, বিজিবি’র হাতে দেশের আর কোথাও যাতে কেউ হতাহত না হয়, তা নিশ্চিত করার জন্যই এই তদন্ত সুষ্ঠু হওয়া দরকার, দায়ীদের উপযুক্ত শাস্তি হওয়া দরকার। তাছাড়া গণক্ষোভ এখনই প্রশমিত না হলে তা আরো সম্প্রসারিত হয়ে পড়তে পারে, যা কাম্য হতে পারেনা। বিজিবি কোনো ভিনদেশী বাহিনী নয়। দেশের জনগণের অর্থে প্রতিপালিত এবং সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনের অঙ্গীকার নিয়ে এ বাহিনী গঠিত। সীমান্ত সুরক্ষা ও সীমান্তবাসীর নিরংকুশ নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করাই বিজিবি’র প্রধান কাজ। সেদিন বহরমপুরে যে ঘটনা ঘটেছে, তা অনভিপ্রেতই শুধু নয়, নজিরবিহীনও বটে। ওইদিন বিজিবি’র গুলিতে যে তিনজন নিহত হয়, তাদের একজন স্কুল শিক্ষক নবাব উদ্দীন এলাকার একজন সম্মানীয় ব্যক্তি। ইনকিলাবের এক রিপোর্টে জানা গেছে, স্বনামধন্য ওই শিক্ষকের কাছে প্রতিদিন কমপক্ষে ১০০ জন শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে। ওই খবরে আরো জানা গেছে, যে কৃষক নিহত হয়েছেন সেই সাদেক আলী তার মেয়ের বিয়ের খরচ যোগাতে একমাত্র গরুটি বিক্রী করতে যাওয়ার সময় বিজিবির বাধার সম্মুখীন হন। অনেক আগে কেনা ওই গরুর ক্রয়রসিদ দেখিয়েও তিনি রেহাই পাননি। গুলিতে তার প্রাণ গেছে। এখন তার মেয়ে রক্তমাখা রশিদটি নিয়ে আহাজারি করছে। সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী পিতাকে হারিয়ে মেয়ের বিয়ে ও ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। আর যে শিশুটি মারা গেছে, সে স্কুল থেকে ফিরে ঘটনা দেখতে গিয়ে নির্মম বর্বরতার শিকার হয়েছে। গোলাগুলির ভয়ে সে একটি বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সেখান থেকে টেনে বের করে এনে তার পায়ে গুলি করা হয়। আহত অবস্থায় সে পড়ে থাকে। তাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করা হলে বিজিবি গুলি করার হুমকি দেয়। এমতাবস্থায়, প্রচুর রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়। এ বিবরণ দিয়েছেন তার বাবা নূরুল ইসলাম। এই তিন মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। বিজিবির যে সদস্যরা এর সঙ্গে জড়িত তারাও এদেশের মানুষ। যাদের রক্ষা করার কথা, তাদের ওপর তারা এরূপ নির্দয়ভাবে গুলি চালাতে পারলো কিভাবে? সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ’র গুলিতে বাংলাদেশী নিহত হওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। যারা নিহত হয় তারা অধিকাংশই নিরিহ গ্রামবাসী, কৃষক বা রাখাল। বিএসএফ’র বাংলাদেশী হত্যার ঘটনা আর বহরমপুরের ঘটনার মধ্যে তাহলে ফারাক থাকলো কোথায়?
স্বাধীন এদেশের স্বাধীন নাগরিকদের প্রতি বিজিবি’র ক্ষতিপয় সদস্য এরূপ আচরণ করতে পারে, তা কল্পনাতীত। অথচ এই বিজিবির অনেক কীর্তি আছে, অনেক গৌরবগাঁথা আছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভাবমর্যাদার অবনমন লক্ষ্য করা গেলেও তার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কখনো প্রশ্ন দেখা দেয়নি। সীমান্ত রক্ষা সর্বোচ্চ পুণ্যকর্মের মধ্যে একটি। সেই পুণ্যকর্মে নিবেদিতদের সম্পর্কে আমরা কোনো নেতিবাচক ধারণার উপনীত হতে চাইনে। আমরা আশা করি, বিজিবি তার ভাবমর্যাদা পুনরুদ্ধারে যত্নবান হবে এবং সব সময় দেশ ও জনগণের পক্ষে থাকবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন