বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ভারতের ক্রীড়াতারকাদের ভীমরতি

মোহাম্মদ আবু নোমান | প্রকাশের সময় : ১৯ মার্চ, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

ক্রিকেট খেলোয়াড়রা ভালোভাবেই জানেন, বোলারদের সব বলই যে শুধু স্ট্যাম্প বরাবর হয়, তা অবশ্যই নয়। খেলায় ওয়াইড বল হয় এবং হবেই। পাকিস্তান-ভারতের যুদ্ধখেলায় সব বলই (বোমা) যে লক্ষ্যে পৌঁছবে তা নয়। বোমা ওয়াইড হলে সেটা যে শুধু সাধারণ নিরীহ মানুষের উপরই পড়বে, তাও নয়। বরং কোনো তারকার আস্তানায়ও পড়তে পারে। হামলা-পাল্টা হামলার মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনায় ক্রিকেটাররা কীভাবে সম্মতি দিতে পারে? খুনের বদলা খুন হতে পারে না। যুদ্ধের বদলা কখনোই যুদ্ধ হতে পারে না। এতে রক্ত ক্ষয় হয়। পরস্পর বিদ্বেষ শুধু হিংসাই জন্ম দেয়, কখনো ভালোবাসা জন্ম দিতে পারে না। যুদ্ধ না করে পাকিস্তান ও ভারত সমোঝোতায় বসে আলোচনা করতে পারে। কিন্তু তা না হয়ে ঠিক উল্টোটাই চলছে। এতে পরস্পরের প্রতি হিংসা বাড়ছে। 

পাকিস্তানে বিমান হামলাকে স্বাগত জানান শচিন টেন্ডুলকার। পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণরেখা (লাইন অব কন্ট্রোল) পেরিয়ে ভারতীয় বিমানবাহিনীর হামলাকে স্বাগত জানিয়েছেন দেশটির ক্রীড়াঙ্গনের আরো কিছু তারকাও। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রান ও সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়া শচিন টেন্ডুলকার এই হামলার পর টুইট করেন, ‘আমাদের ভালোমানুষিকে কখনোই দুর্বলতা মনে করা উচিত নয়। ভারতীয় বিমানবাহিনীকে কুর্নিশ। জয় হিন্দ।’ টেন্ডুলকারের একসময়ের জাতীয় দলের সতীর্থ বীরেন্দর শেবাগ আবার একটু ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বলতে ভালোবাসেন। হামলার পর শেবাগ টুইট করেন, ‘আমাদের ছেলেরা সত্যিই ভালো খেলেছে।’ ভারতের বর্তমান দলটির ওপেনার শিখর ধাওয়ানও টুইট করেন, ‘ভারতীয় বিমানবাহিনী সময়মতো যে সাহস ও শৌর্য দেখিয়েছে সে জন্য তাদের কুর্নিশ।’ টাইম অব ইন্ডিয়ায় পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলা নিয়ে প্রতিবেদনে টেন্ডুলকার, শেবাগ, ধাওয়ান ছাড়াও আরও কজন ক্রিকেটারের টুইট তুলে ধরা হয়েছে। সুরেশ রায়না লিখেছেন, ‘এই প্রতিক‚ল পরিস্থিতির মধ্যে অসাধারণ সাহস দেখানোর জন্য ভারতীয় বিমানবাহিনীকে সেলাম জানাই। কাপুরুষদের প্রতি দুর্দান্ত জবাব।’ অজিঙ্কা রাহানের টুইট, ‘ভারতীয় সেনাবাহিনীর চমৎকার কাজ।’ এছাড়াও ভারতের ব্যাডমিন্টন তারকা সাইনা নেহওয়াল টুইট করেন, ‘ভারতীয় সেনাবাহিনীকে কুর্নিশ জানাই... জয় হিন্দ।’ সে সঙ্গে হ্যাশট্যাগ দিয়ে লিখেছেন ‘ইন্ডিয়া স্ট্রাইক ব্যাক’। দেশটির ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কারজয়ী আরেক ব্যাডমিন্টন তারকা শ্রীকান্ত কিদাম্বির টুইট, ‘সন্ত্রাসের বিপক্ষে আক্রমণের জন্য ভারতীয় বিমানবাহিনীকে কুর্নিশ। তোমাদের নিয়ে প্রতিটি ভারতীয় গর্বিত।’
অপরদিকে ‘পাকিস্তান তোমাদের শত্রু নয়’; ভারতের উদ্দেশ্যে এমন কথা বলেছেন পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেট তারকা ওয়াসিম আকরাম। ভারত ও পাকিস্তানের সীমান্ত সংঘাতের প্রেক্ষাপটে তিনি এক টুইট বার্তায় বলেন, পাকিস্তান ভারতের শত্রু নয়। জঙ্গিবাদ ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশেরই শত্রু। দুই দেশকে একসঙ্গে এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। টুইটে ওয়াসিম আকরাম ভারতের উদ্দেশে সৌহার্দ্যপূর্ণ বক্তব্য দেন। বলেন, ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আমি বলতে চাই, ‘পাকিস্তান তোমাদের শত্রু নয়। তোমাদের শত্রু আমাদেরও শত্রু! আমরা কেন বুঝতে পারছি না, আমাদের লড়াই একই। এর আগে আর কত রক্ত ঝরবে? যুদ্ধে জঙ্গিদের পরাজিত করতে হলে দুই ভাইকে একসঙ্গে লড়াইয়ে নামতে হবে।’ এরপর তিনি টুইটে হ্যাশট্যাগ টুগেদার উইন হ্যাশট্যাগ নো টু ওয়ার লেখেন। আকরাম নিজের সাথে শচিন, সৌরভ, হরভজনদের যোজন যোজন ব্যবধান গড়ে তুললেন এই শান্তির বার্তা দিয়ে।
পাকিস্তানকে ২০১৯ বিশ্বকাপ থেকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছে ভারত। না হলে উল্টো ভারতই বিশ্বকাপ বয়কট করতে পারে বলে জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম। আইসিসি সভাপতি শশাঙ্ক মনোহরের কাছে একটি খসড়া চিঠি লিখেছে বিসিসিআইয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক নিযুক্ত প্রশাসক কমিটি (সিওএ)। কমিটি অব অ্যাডমিনিস্ট্রেটর (সিওএ) নাকি সেই চিঠিতেই জানাচ্ছে এমন বিস্ময়কর দাবি! অবশ্য সিওএ সদস্য এবং ভারতের নারী দলের সাবেক অধিনায়ক ডায়না এডুলজি আইসিসিকে এই চিঠি পাঠানোর বিপক্ষে। তিনি বলেন, ‘বিসিসিআই এমন কিছু করতে পারে না। বৈশ্বিক কোনো টুর্নামেন্ট থেকে একটি দেশকে নিষিদ্ধ করতে আয়োজক কর্তৃপক্ষকে বলার ব্যাপারটি করার চেয়ে সহজ। তাদের বোকার মতো কিছু করে বসা উচিত নয়।’
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান দেখিয়ে দিয়েছেন, তিনি রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ বলে মনে হলেও বাস্তবে তা নয়। ক্রিকেটার ইমরান খান বহু কাট-খড় পুড়িয়ে তৃণমূল পর্যায় থেকেই রাজনীতিতে শীর্ষে উঠে এসেছেন। তার দেশপ্রেম প্রশ্নাতীত। দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে যেকোনো ধরনের সামরিক পদক্ষেপে তিনি মোটেই পিছপা হবেন না। তার এই অবস্থান তাকে যেমন পাকিস্তানের সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা দিয়েছে, তেমনি পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও ডিপ স্টেটের কাছে গ্রহণযোগ্য করেছে। ইমরানের কাছে কৌশলে, নৈতিকতায়, সামরিকসহ সব দিক দিয়েই মার খেয়েছেন মোদি। সমস্যা হলো নির্বোধরা ভদ্রতাকে দুর্বলতা মনে করে। যেমন ইমরানের প্রশংসনীয় উদ্যোগকে এখানে অনেকেই আরেক চোখে দেখা শুরু করেছে। ভারতীয় পাইলট উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমানকে ফেরত দেয়াকে অনেকেই ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তানের দুর্বলতা ও জেনেভা কনভেনশনকে চিহ্নিত করছেন। কিন্তু ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে, যুদ্ধ কখনোই অর্থনীতির ধার ধারে না। যুদ্ধ বিধ্বস্ত সিরিয়া, আফগানিস্তান, সাউথ সুদান, বসনিয়া, হার্জেগোভিনায় কি এমন অর্থনীতি আছে যেখানে যুদ্ধ চলেছে বছরের পর বছর ধরে। তাহলেতো বলতে হয়, ভারতীয় নৌসেনা কুলভূষণ যাদব পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে ধরা পড়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। তাকে পাকিস্তান ছাড়ছে না কেন? আর ভারতই তাকে ফেরত চাইছে না কেন?
ইতিহাস এটাই! যতদিন ইমরান খান পাকিস্তানের ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেন ছিলেন, ততোদিন ভারত-পাকিস্তানের ক্রিকেট খেলাগুলোতে পাকিস্তানের জয়ের পাল্লা ভারি ছিল। এখন তিনি দেশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এখনও প্রমাণ হলো, ইমরান খান শুধু শরীর দিয়ে খেলেন না, মাথা দিয়ে খেলেন। ভারতের বিভিন্ন পর্যায়ের তারকাদের বুঝতে হবে, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও যুদ্ধ পৃথিবীর সকল সভ্যমানুষের শত্রু। দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশে যখন যুদ্ধ লাগে, তখন সেটা, ক্রিকেটের বল ও বলিউড, ঢালিউডের নাচন-কুর্দনের মতো কোনো ছেলে খেলা হয় না। যুদ্ধ বরাবরই ভুল হিসেবের ফল। যখন দুই প্রতিপক্ষের হাতে পারমাণবিক বোমা থাকে, তখন সে যুদ্ধে কেউই জিততে পারে না। এতে শুধুমাত্র অনেক সাধারণ মানুষ হতাহত হতে পারে।
ভারতীয় বিমান বাহিনী যদি কোনো পাকিস্তানী বিমানকে ভূপাতিত করতে পারতো এবং কোনো পাইলটকে জিন্দা ধরে চমক দেখাতে পারতো, তাহলেতো শচিন, শেহবাগসহ ভারতীয় ক্রিকেট এবং বলিউড অভিনেতাদের অভিনন্দনের ‘সুনামি’ বয়ে যেতো। অথচ পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর পাক সেনারা অভিনন্দন বর্তমানের বাড়িতে ফোন করে তার বাবা-মাকে আশ্বস্ত করেন, ‘আপনাদের ছেলে আমাদের হাতে নিরাপদে রয়েছে এবং অতি শীঘ্রই তাকে আপনাদের হাতে তুলে দেয়া হবে...।’ পাক প্রধানমন্ত্রীও ঘোষণা করেন, শান্তির পদক্ষেপ হিসেবে অভিনন্দনকে মুক্তি দিয়ে ভারতের হাতে তুলে দেয়া হবে। এর আগে কার্গিল যুদ্ধের সময়ও আটক ভারতীয় পাইলট নচিকেতাকে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছিল পাকিস্তান।
পাকিস্তানি শিল্পীদের সঙ্গে আর কাজ করবেন না ভারতীয় শিল্পীরা। পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলার প্রতিবাদে সম্প্রতি এমন বিবৃতি দিয়েছে অল ইন্ডিয়া সিনে ওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশন (এআইসিডব্লিউএ)। বলিউড তারকা অজয় দেবগন ইতোমধ্যে পাকিস্তানে তার ছবি ‘টোটাল ধামাল’ মুক্তি না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। ভারতের তারকারা রাজনীতির সঙ্গে খেলা, সার্ক ও বিশ্বকাপকে গুলিয়ে এই উপমহাদেশের শান্তিপ্রিয় সভ্যজনের মন-মেজাজকে অশান্ত করে তুলেছেন। কতিপয় পেশাদার শিল্পী ও খেলোয়াড়ের কাছ থেকে এমন শিশুসুলভ মন্তব্য আশা করা যায় না। যুদ্ধকে উস্কে না দিয়ে খেলোয়াড়দের খেলা নিয়েই থাকা ভালো। পাক-ভারতের মতো হতদরিদ্র দুই দেশকে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা জরুরি। ভারতের মহাতারকারা হিংসা-বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন!
সারা বিশ্ব মানুষ বাচানোর চেয়ে মানুষ মারার অস্ত্রের জন্য বেশি পয়সা খরচ করে। ওই পয়সাগুলো দিয়ে যদি গরিব মানুষদের সাহায্য করা যেতো তাহলে হয়তো সন্ত্রাস জন্ম নিতো না। বিশ্বের প্রতিটি দেশে যদি যুবকদের চাকরি বাধ্যতামূলক করা যেতো, তাহলে কেউ সন্ত্রাসের পথ বেছে নিতো না। কিন্তু বিশ্ব আজ ভারি ভারি অস্ত্র কিনে নিজেদের পাল্লা ভারি করে রাখছে। অস্ত্র জমিয়ে রেখে টাকাগুলো আটকে রাখছে। যদি অস্ত্র না কিনে বেকার সমস্যার সমাধান করা যেতো তাহলে কেউই খারাপ পথে যেতো না হয়তো।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন