বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মহান স্বাধীনতা দিবস

আরব বিশ্ব ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ

মাহামুদ শাহ কোরেশী | প্রকাশের সময় : ২৬ মার্চ, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সহানুভূতি, এমন কি সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেলেও আরব বিশ্ব থেকে প্রত্যক্ষভাবে সেরকম কিছু পাওয়া যায়নি। বরং একটি মুসলিম রাষ্ট্র ভেঙে দুই টুকরা করে ফেলছি এই যুক্তিতে তারা আমাদের বিরোধিতা করেছিলেন। অনেক ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি সশ্রদ্ধ সমর্থন থাকলেও ‘অভ্যন্তরীণ সমস্যা’ সমাধানের জন্য বিচ্ছিন্নতার নীতি অবলম্বন, একেবারে স্বাধীনতা ঘোষণা, তার ওপর ‘হিন্দু’ ভারতের সমর্থনে প্রতিরোধ গড়ে তোলা, তারা সমর্থন করতে পারছিলেন না।
এখানে আরব বিশ্ব বলতে আমরা কাদের বোঝাব? প্রথমত, সউদী আরব, দ্বিতীয়ত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো; বিশেষ করে লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, মিসরসহ বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্র। এর মধ্যে প্রভাবশালী শেষের দুটি দেশ ইরাক ও মিসর আমাদের প্রতি বেশ কিছু সমর্থন ছিল। লেবানন আরবি সংস্কৃতি অধ্যুষিত হলেও মূলত খ্রিস্টীয় প্রভাবযুক্ত। পাশ্চাত্যের অন্য দেশগুলোর মতো কিছুটা মৌখিক সহানুভূতি প্রকাশ ও দুর্গত শরণার্থীদের জন্য অল্প সাহায্য পাঠিয়ে দায়িত্ব পালন করছিল। সিরিয়া ভয়ঙ্কর রক্ষণশীল রাষ্ট্র। তারা এসব ঝামেলায় নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করতে চাইল না।
জুন মাসে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল বিদেশে কয়েকটি ‘মিশন’ পাঠাবে, যাতে আমাদের বিদ্রোহ বিচ্ছিন্নতার জন্য নয়, আত্মরক্ষার খাতিরে এবং যথার্থ স্বাধীনতা লাভের জন্য। তাছাড়া পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সীমাহীন গণহত্যা ও নারকীয় অত্যাচার এবং ধ্বংসলীলার বিরুদ্ধে মানবিক প্রতিরোধের সংগ্রাম সম্পর্কে বহির্বিশ্বকে অবহিত করা আমাদের কর্তব্য কর্মরূপে নির্ধারিত হলো। তখন ঠিক হলো : মধ্যপ্রাচ্য ও দূরপ্রাচ্যে দুটি দল যাবে। মধ্যপ্রাচ্যে ফরিদপুরের এমএনএ মোল্লা জালালউদ্দীন আহমদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রিডার ড. মাহমুদ শাহ কোরেশী যাবেন। আমার নির্বাচন হলো যেহেতু দীর্ঘকাল ফ্রান্সে অবস্থান ও শিক্ষকতা করে আমি একজন ফরাসি ভাষা বিশেষজ্ঞ রূপে গণ্য হয়েছি সে জন্য। দূরপ্রাচ্যের ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের এমএনএ এম আর সিদ্দিকী এবং বৌদ্ধভিক্ষু জ্যোতিনাশ মহাথের যাবেন। খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত বদলে সিদ্দিকী সাহেবকে মার্কিন মুল্লুকে এবং তার জায়গায় ফকির শাহাবুদ্দিন নির্বাচিত হলেন। তাছাড়া জননেতা আবদুল মালেক উকিলের নেতৃত্বে একটা দল যাবে নেপালে।
১৩-৭-১৯৭১ তারিখে মোল্লা জালাল ও সিদ্দিকী সাহেবের সঙ্গে আমি দিল্লি এলাম। পরদিন দিল্লিতে আমাদের প্রতিনিধি কে এম শাহাবুদ্দিন ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিয়ে গেলেন সবাইকে। ২৮.৭.১৯৭১ বৈরুতে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত এবং মিসেস বিজয় লক্ষী পন্ডিতের মেয়ের জামাই আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন এবং করণীয় কর্ম সম্পর্কে অবহিত করলেন। পরদিন প্রখ্যাত কবি ও রাষ্ট্রদূত ওমর আবু রিশ ও সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ আলী হিমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ। হিমাদে সেখানকার সেরা দৈনিক আননাহায়ের ডিরেক্টর। এরপর প্রগ্রেসিভ সোসালিস্ট পার্টি-প্রধান কামাল জুমলাতের সঙ্গে দুই দফা সাক্ষাৎ। ‘আল বৈয়রাক’ পত্রিকার সম্পাদক কারাম-এর সঙ্গে আলোচনা। বেশির ভাগ ফরাসি ভাষায়। যখন কেউ ইংরেজি বলতে পারেন বা বলতে চান তখন মোল্লা জালাল আমাদের উদ্দেশ্য জানিয়ে দেন। কমিউনিস্ট পার্টির প্রেসিডেন্ট এবং আমার পূর্ব পরিচিত ডা. ছিতাফ আবদেল সামাদ, প্রফেসর নিকোলাস জিয়াদেসহ আরো অনেক ছাত্র-শিক্ষক-সাংবাদিক বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ ঘটল। ১১.৮.৭১ তারিখে আমরা আরব-কালচারাল ক্লাবে একটি প্রেস কনফারেন্স করলাম। সেখানে আননাহারের সাংবাদিক খায়রুল্লাহর সঙ্গে পরিচয় হলো। খায়রুল্লাহ আমাদের বেশ বন্ধু হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি কিন্তু ক্রিশ্চান। লেবানিজ পার্লামেন্টের ফরেন রিলেশন্স কমিটির চেয়ারম্যান ড. আমিন হাফিজের সঙ্গে তার বাসভবনে সৌজন্য সাক্ষাৎ হলো। ১৩.৮.৭১ অপরাহ্ণে ভাড়া গাড়িতে আমরা সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক গিয়ে পৌঁছলাম। সেখানে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত গুহ সাহেব বাঙালি। এর আগে তিনি ঢাকায় কনসাল জেনারেল ছিলেন। সেখানে আমার প্যারিসের সহপাঠী মিশেল আবরাশ ও তার ভাই বাহিজ আরবাশ যোগাযোগের ব্যাপারে আমাদের খুবই সাহায্য করল। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ড. খিয়ামী। কমিউনিস্ট পার্টির মোরিস সালিবা ও ড. মুস্তফা আমিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। বার অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট রিয়াদ আবেদের সঙ্গে একটি ফলপ্রসূ আলোচনা সভা হলো।
সিরিয়ার দ্বিতীয় বড় শহর আলেপ্পোয় আমরা একটি সংক্ষিপ্ত সফর করলাম। সেখানে ফরাসি কনসাল জেনারেল লুই সেকুতোভিচ এর আগে ঢাকায় ছিলেন এবং আমার অতিঘনিষ্ঠ বন্ধুজন। মধ্যপ্রাচ্য মিশন সেরে যেহেতু আমি প্যারিসে যাব (ফরাসি সরকার ইতোমধ্যে আমাকে ও আমার স্ত্রীকে এ জন্য দুটি বৃত্তিদানের ব্যবস্থা করে রেখেছেন) সে জন্য তার সঙ্গে দেখা করে যাবতীয় যোগাযোগের আগাম খবর জেনে রাখা আমার প্রয়োজনীয় মনে হয়েছিল।
২৪.২.৭১ সকালে আলেপ্পো থেকে দামেস্কে রওনা হওয়ার সময় সেকুতোভিচ আমাকে জানালেন যে, ইরাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আবুল ফতেহ বাংলাদেশের পক্ষে যোগদান করেছেন। একটা বড় খবর বটে। ফতেহ পরে প্যারিসে রাষ্ট্রদূত ছিলেন।
২৫.৮.৭১ তারিখে বৈরুত ফিরে আমরা সঙ্গী পেলাম ভ্রাম্যমাণ রাষ্ট্রদূত আবদুস সামাদ আজাদকে। তিনি ছিলেন প্রবীণ মন্ত্রী তাজউদ্দীনের প্রতিনিধি।
৩০.৮.৭১ তারিখে লিবানিজ পার্লামেন্টে ড. আমিন হাফেজ ও ফরেন রিলেশন্স কমিশনের ৭ জন সদস্য আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন এবং বাংলাদেশের সরকারি বক্তব্য রেকর্ড করলেন। তারা আমাদের প্রসঙ্গ তাদের পার্লামেন্টে তুলবেন এমন প্রতিশ্রুতি দিলেন। এবার আমাদের সাক্ষাৎ হলো ডেইলি স্টারের সম্পাদকের সঙ্গে। এরপর বিশ্বশান্তি সংসদের সভাপতি মারূফ সাদের অভ্যর্থনা। আল্লামা শেখ আব্দুল্লাহ আলায়লির সঙ্গে বৈঠক। বিশেষ করে ভবিষ্যতের অপেক্ষমাণ দুই প্রবীণ মন্ত্রী রশীদ কারামে ও তাজিয়েদ্দীন সোলের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা আমাদের মিশনকে সত্যিকার সাফল্যের পথে নিয়ে গেল। তাছাড়া ইতোমধ্যে প্রভাবশালী নেতা কামাল জুমলাত তার অফিসকে আমাদের ‘বাংলাদেশ মিশন’ রূপে ব্যবহারের অনুমতি প্রদান করেছেন। আমরা সাংবাদিক নারিল বাবাদিকে আমাদের প্রতিনিধি নিয়োগ দিলাম। নাবিল আমার লেখা Suffering Humanity in Bangladesh শীর্ষক রচনা সারণিতে অনুবাদ করে বহু কপি পুস্তিকা বিভিন্ন আরব দেশে বিলির ব্যবস্থা করল।
এ ছাড়া আরও বহুতর ঘটনা ঘটেছিল ৪.১০.৭১ তারিখে আমি দিল্লি ফিরে আসার পূর্বাবধি। কিন্তু তার জন্য আমার রোজনামচার ভিত্তিতে রচিত ‘মুক্তিযুদ্ধের মিশন আমার জীবন’ পড়তে হবে।
লেবাননে সবচেয়ে প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ বলে যাকে মনে হয়েছিল, সেই তাকিয়েদ্দিন সোল আমাদের পরিস্থিতির কথা জেনে বলেছিলেন, ‘এই অমানুষিক ববর্রতার কথা শুনে তারা যে শুধু দুঃখ পেয়েছেন তা-ই নয়, তাদের বুকে শেলের মতে বিঁধেছে। মুসলমান এভাবে মুসলমানকে মারবে? জোর করে আনুগত্য তথাকথিত সংহতি রক্ষা করতে চাইবে? এটা কল্পনা করা যায় না! কিন্তু আরব জাতিসমূহের বর্তমান পরিস্থিতিতে কিছু করা সম্ভব ছিল না।’ তার মতে, ‘কখনো সংহতি, কখনো বিচ্ছিন্নতা জাতিসমূহের শক্তির কারণ হয়। বাংলাদেশের স্বাতন্ত্র্য স্বীকার করে নিলে আন্তর্জাতিক মুসলিম সংহতি বা আফ্রো-এশীয় সংহতি ক্ষুন্ন হবে না বরং শক্তি বৃদ্ধি হতে পারে কিনা এ কথা বিবেচনার সময় এসেছে।’
আরব বিশ্ব সে বিবেচনা করতে দীর্ঘ সময় নিয়েছে, তবে পরবর্তীকালে বিভিন্ন পর্যায়ে তাদের সাহায্য ও সহযোগিতা যে আমাদের বিশেষভাবে কাজে লেগেছে তা অস্বীকার করা যাবে না।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন