মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

ফুল উৎপাদনে বিপ্লব

| প্রকাশের সময় : ১০ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মিজানুর রহমান তোতা : ফুল উৎপাদনে নীরব বিপ্লব ঘটেছে দেশে। নিকট অতীতে এতো ব্যাপক আকারে বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ হতো না। চাহিদা মিটতো আমদানিকৃত ফুলে। মাত্র কয়েকবছরের ব্যবধানে কৃষির এই খাতটিতে বিরাট সফলতা এসেছে। দেখা দিয়েছে বিরাট সম্ভাবনা। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন এলাকায় হাজার হাজার হেক্টর জমিতে ফুল উৎপাদন হচ্ছে। এটিকে সৌন্দর্যের চিহ্ন ও রঙিন ইতিহাস হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যশোর, ঝিনাইদহ ও চুয়াডাঙ্গাসহ ২৪টি জেলায় ১০ সহস্রাধিক হেক্টর জমিতে ফুল চাষ হচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে। যার প্রায় ৭০ ভাগ ফুল উৎপাদন হয় ফুলরাজ্য হিসেবে চিহ্নিত যশোরের গদখালি এলাকায়। উৎকর্ষতার প্রতীক ফুল সৌন্দর্যপিপাসু মানুষের জীবনের সঙ্গে মিশে আছে। ফুল ভালোবাসেন না এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। শুধু সৌন্দর্য কিংবা মিষ্টি সুবাতাস ছড়ানো নয়, এখন ফুল থেকে আসছে কাঁড়ি কাঁড়ি বৈদেশিক মুদ্রা। যা কিছুদিন আগে কল্পনাও করা যায়নি। যশোর-বেনাপোল সড়কের গা ঘেঁষা ঝিকরগাছার গদখালী ফুলের রাজ্য ঘুরে দেখা গেছে, মাঠে মাঠে নানা জাতের ফুল আর ফুল। সবুজের মাঝে সাদা রজনীগন্ধা আর লাল, হলুদ, কমলা, খয়েরী ও মেজেন্ডা রঙের জারবেরা, ঝাউ কলম ফুল, গ্লাডিওলাস, লিলিয়াম, লাল গোলাপ, সাদা গোলাপ, কালো গোলাপ, হলুদ গোলাপ, গাঁদা, জবা ও জুইসহ বিভিন্ন ফুলের চাদর বিছানো মনমাতানো এক অভূতপূর্ব নয়নাভিরাম দৃশ্য। যা দেখলে পাষাণ হৃদয়ও নরম হয়ে যায়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিভাগ ও কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আসলেই বিপ্লব ঘটেছে ফুল চাষ ও উৎপাদনে। বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটি জানায়, সারাদেশে ফুলকে ঘিরে চলছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ২৫ লাখ মানুষের বিশাল এক কর্মযজ্ঞ। যারা ফুল চাষ, পরিচর্যা, ফুল তোলা, বান্ডিল করা, সংরক্ষণ, পরিবহন, ক্রয় ও বিক্রয় কাজে নিয়োজিত। তবে ফুলের মান বৃদ্ধি, সংরক্ষণ, চাষিপর্যায়ে আধুনিক পদ্ধতি ও কলাকৌশলের জ্ঞানের অভাব এবং সুষ্ঠু বাজারজাতকরণে বহুমুখী সমস্যার কারণে বিরাট সম্ভাবনার খাতটির আশানুরূপ অগ্রগতি হচ্ছে না। কারণ উৎপাদকদের পর্যাপ্ত ঋণ দেয়া, বিপণন ব্যবস্থার সহায়ক অবকাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যেসব সমস্যা রয়েছে তা মাঠপর্যায়ে তদন্ত করে সমাধানের ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি অনুপস্থিত রয়েছে। অথচ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ একটু নজর দিলে অনায়াসেই খাতটির সকল সমস্যার সমাধান সম্ভব। এটি হলে স্বাচ্ছন্দ্যে খাতটির সঙ্গে জড়িতরা স্বপ্ন পূরণ করতে পারতেন। চাষিপর্যায় থেকে শুরু করে ক্রয়-বিক্রয়সহ বাণিজ্য নতুন মাত্রা যোগ হতো। আর্থিক দিক দিয়েও সংশ্লিষ্টরাসহ দেশ লাভবান হতো। বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, আশার কথা ঢাকায় ফুলের একটি স্থায়ী পাইকারী মার্কেট স্থাপন ও বিদেশে রফতানী বৃদ্ধির ব্যাপারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চেষ্টা করে প্রাথমিক সফলতা এসেছে। তাছাড়া ফুলের রাজ্য যশোরের গদখালিতে একটি ফুল গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে। এ ব্যাপারে ইউএসএইড সাপোর্ট দিচ্ছে। তারা স্টাডি শুরু করেছে। তিনি জানালেন, ফুল সংরক্ষণের উপযোগী একটি আধুনিক কোল্ড স্টোরেজ স্থাপন অত্যন্ত জরুরি। সংরক্ষণের অভাবে পিকসিজনে অনেক সময় ফুল নষ্ট হয়। সূত্র জানায়, বর্তমানে প্রতিবছর গড়ে প্রায় আড়াইশো’ কোটি টাকার ফুল রফতানী হচ্ছে। এই অংক অনায়াসেই হাজার বিংবা দেড় হাজার কোটিতে উন্নীত করা সম্ভব। যার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশে। জাপান ও হল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশে যেভাবে কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয় ফুল উৎপাদনে। বাংলাদেশে সেটি অনায়াসেই করা যায়। বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকার মাটি রকমারী ফুল উৎপাদনের জন্য খুবই উপযোগী।
বিরাট সম্ভাবনাময় খাতটির প্রধান সমস্যা রফতানীর প্রতিবন্ধকতা। বহুবার আবেদন নিবেদন করে দীর্ঘদিনেও ফুল রফতানীর প্রতিবন্ধকতা দূর যায়নি বলে জানালেন ফুলচাষি কল্যাণ সমিতি ও ফ্লাওয়ার সোসাইটির নেতৃবৃন্দ। ফুল রফতানীর সরকারী নীতিমালার অভাবে বিদেশে যাচ্ছে ফুল হিসেবে নয়, সবজি হিসেবে। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের ফুলের ব্যাপক কদর ও চাহিদা রয়েছে। কিন্তু সুযোগকে কাজে লাগানো হচ্ছে না। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় একচেটিয়া ফুল ব্যবসা করে লাভবান হওয়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বেঙ্গালোর, পুনা ও তামিলনাড়–র চেয়ে যশোরসহ দেশের বিভিন্নস্থানে উৎপাদিত রজনীগন্ধাসহ প্রায় সব ফুলের মান খুবই উন্নত এবং রং উজ্বল ও হৃষ্টপুষ্ট। সংশ্লিষ্টদের মতে, ফুল রফতানীর নীতিমালা হলে সম্ভাবনাময় ফুল শিল্পটির বিশাল উন্নতি হবে। রাখতে পারবে দেশের অর্থনীতিতে বিরাট ভুমিকা। সমৃদ্ধ হবে বৈদেশিক মুদ্রা ভান্ডার। সূত্র জানায়, মধ্যপ্রাচ্য বাংলাদেশী ফুলের বড় বাজার। কিন্তু নানা কারণে উল্লেখযোগ্য ফল পাওয়া যাচ্ছে না, ধরা যাচ্ছে না বাজার। রফতানী হচ্ছে ঠিকই কিন্তু চাহিদার তুলনায় খুবই কম। কিভাবে চাহিদানুযায়ী বাজারে বাংলাদেশের ফুল রফতানী করা যায় তার উদ্যোগ নেয়া হয় না কখনো। তাছাড়া দেশে ফুল উৎপাদনে রেকর্ড সৃষ্টির পরও বিদেশ থেকে ফুল আমদানি করা হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে এ ব্যাপারে ফুল আমদানি নিরুৎসাহ করার ক্ষেত্রে ফুল আমদানির উপর ট্যাক্স ১৫% এর স্থলে ৫০% করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে মন্ত্রণালয় ও ফ্লাওয়ার সোসাইটি সূত্র জানায়। সূত্রমতে, যেহেতু দেশে উৎপাদিত ফুলে চাহিদা পূরণ হচ্ছে সেখানে আমদানির প্রয়োজনীয়তা নেই। এতে দেশের সম্ভাবনাময় খাতটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একটি সূত্র জানায়, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ইতোমধ্যে এটি অনুধাবন করতে পেরেছেন। দেশের ফুলচাষিদের স্বার্থে রফতানী জোরদারও করা হবে বলে সর্বশেষ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সঙ্গে এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
একইভাবে উৎপাদকদের উৎসাহ দেয়া ও বিপণন ব্যবস্থার সহায়ক অবকাঠামো গড়ে তোলা ও গুণগতমান বাড়ানোর ক্ষেত্রে যেসব সমস্যা রয়েছে তা নিরসনের জোরালো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ। ফুলচাষিরা জানান, আমরা নিত্যনতুন জাতের ফুল উৎপাদন করছি। আগে বেশিরভাগ ফুলের বীজ আমদানি করতে হতো। এখন টিস্যু কালচারের মাধ্যমে নানা জাতের চারা উৎপাদন করা হচ্ছে নিজেদের উদ্যোগে। উদাহরণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেন, টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উদ্ভাবিত চারা থেকে জারবেরা ফুল উৎপাদনে সফল হয়েছি। ভারতের বেঙ্গালোর কিংবা অন্য দেশ থেকে অতিরিক্ত মূল্যে চারা আমদানির প্রয়োজন হয় না। ফুলচাষীরা হাতে কাছে খুব কমমূল্যে চারা হাতে পাচ্ছেন। জারবেরা ফুল বিশ্বে কাট ফ্লাওয়ার হিসেবে খুবই জনপ্রিয় ফুল। জারবেরা একটি জাতীয় বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ। এর চাষ করে ফুলচাষীরা মাত্র ২ কাঠা জমি থেকে বছরে নীট মুনাফা ৫০ হাজার টাকারও বেশী আয় হয়। একবার চাষ করলে কয়েকবছর ফুল পাওয়া যায়। সফলতা এসেছে শাপলা ফুলের মতো দেখতে লিলিয়াম ফুল উৎপাদনে। যা রজনীগন্ধার মতো সম্প্রসারিত হয়েছে দ্রুত। একইভাবে কার্ণিশন ফুলও। কার্ণিশন চন্দ্রমল্লিকার মতো থোকা থোকা ফুল হয়। ব্যাপক চাহিদা এই ফুল। জারবেরা ও চন্দ্রমল্লিকার পর এবার পরীক্ষামূলক নতুন জাত স্ট্রোমা ফুলের চাষ করা হচ্ছে। ফুলটি দেখতে কলমি ফুলের মতো। লম্বা স্টিকে হয়। রং গোলাপ। জাপান থেকে বীজ ও চারা আনা হয়েছে। জাপান ও হলান্ডে স্ট্রোমা ফুলের উৎপাদন হয় বেশী। বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম এই তথ্য দিয়ে জানান, বাংলাদেশে ফুলের উৎপাদন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাজারও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি বললেন, নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত ফুলের মূল সিজন। এই সময়ে শীতকাল। শীতে রোগ পোকা-মাকড়ের ঝামেলা থাকে না। ফুলের গঠন ও রং ভালো হয়। তবে সারা বছরই আমাদের দেশে ফুল উৎপাদন হয় কমবেশী। দেশেীয় চাহিদা পিক সিজনেই বেশী থাকে এটি ফুল চাষিদের জন্য আশীর্বাদ। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, বসন্ত ও ভালোবাসা দিবস পড়ে পিক সিজনে। তাই ফুলের বেচাকেনা হয় খুবই ভালো। ফুলচাষিরা আর্থিকভাবে বিরাট লাভবান হয়। জারবেরা ফুল একবিঘায় ৭/৮ লাখ টাকা খরচ করে সর্বনিম্ন ৩ বছর ১৫/১৬ লাখ টাকা আয় হয়। রজনীগন্ধা ও গ্লাডিওলাস একবিঘায় একবার লাখখানেক টাকা খরচ করে ৩ বছর ধরে ফুল পাওয়া যায়। বিক্রি হয় ৩ লক্ষাধিক টাকা।
সূত্র আরো জানায়, দেশের মধ্যে যশোর হচ্ছে রজনীগন্ধাসহ ফুল বাণিজ্যিকভাবে আবাদ ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে মডেল। যশোরে সর্বপ্রথম বাণিজ্যিকভাবে রজনীগন্ধা ফুল উৎপাদন হয়। ১৯৮৩ সালে যশোরের পানিসারা গ্রামের শের আলী সরদার মাত্র ৩০ শতক জমিতে রজনীগন্ধা আবাদ শুরু করেছিলেন। পরবর্তীতে আস্তে আস্তে রজনীগন্ধাসহ নানা জাতের ফুল আবাদ পদ্ধতি পানিসারা গ্রাম থেকে গদখালী ও হাড়িয়াসহ আশপাশের গ্রাম এবং ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ, মহেশপুর ও চুয়াডাঙ্গাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিস্তৃত হয়। সারা দেশের মোট চাহিদার সিংহভাগ অর্থাৎ প্রায় ৭০ শতাংশ ফুল সরবরাহ হয় যশোর থেকে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রাখছে খাতটি। তাই ফুল চাষ ও বিপণনসহ সকল সমস্যা সমাধানের জরুরি উদ্যোগ নিতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন ফুল চাষি, ব্যবসায়ী, কৃষি বিশেষজ্ঞ, বিজ্ঞানী, পর্যবেজ্ঞক মহল।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন