শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

তামাকের ব্যবহার নির্মূলে করণীয়

| প্রকাশের সময় : ২৭ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ইকবাল মাসুদ : তামাক ও তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি সত্তে¡ও বাংলাদেশে ৪৩ শতাংশ অর্থাৎ ৪ কোটি ১৩ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করে, যার মধ্যে ২৩ শতাংশ (২ কোটি ১৯ লক্ষ) ধূমপানের মাধ্যমে তামাক ব্যবহার করে এবং ২৭.২ শতাংশ (২ কোটি ৫৯ লক্ষ) ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করে। ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারের হার নারীদের মধ্যে অনেক বেশি। বাংলাদেশে ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সের প্রায় ৭ শতাংশ কিশোর-কিশোরী তামাকপণ্য ব্যবহার করে যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বিশ্বের তামাক ব্যবহারকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগের প্রকোপও দিন দিন বেড়ে চলেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে হৃদরোগের কারণে মৃত্যুর ৩০ শতাংশের, ক্যান্সারে মৃত্যুর ৩৮ শতাংশের, ফুসফুসে যক্ষার কারণে মৃত্যুর ৩৫ শতাংশের এবং অন্যান্য শ্বাসতন্ত্রজনিত রোগে মৃত্যুর ২০ শতাংশের জন্য ধূমপান দায়ী।
তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের কারণে চিকিৎসা ব্যয় বহুগুণে বেড়ে গেছে যা দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বিশাল বোঝা। এছাড়া সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবেও দেশ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ’। তামাক ব্যবহারজনিত রোগে দেশে প্রতিবছর প্রায় ১ লক্ষ (ওঐগঊ, ২০১৩) মানুষ অকালমৃত্যু বরণ করে। তামাকখাত থেকে সরকার যে পরিমাণ রাজস্ব পায় তামাক ব্যবহারের কারণে অসুস্থ রোগীর চিকিৎসায় সরকারকে স্বাস্থ্যখাতে তার দ্বিগুণ ব্যয় করতে হয়। এভাবে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে দেশ। তামাকজনিত ক্ষয়ক্ষতি হিসেব করে দেখা গেছে, প্রতিবছর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ৩ শতাংশ নষ্ট হচ্ছে তামাকের কারণে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বে সবচেয়ে কম দামে সিগারেট পাওয়া যায় এমন তিনটি দেশের মধ্যে একটি হচ্ছে বাংলাদেশ। এর পরই অবস্থান করছে নেপাল ও মিয়ানমার। ক্যাম্পেন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস-এর এক প্রস্তাবনাপত্রে দেখা গেছে, বাংলাদেশের তামাকের বর্তমান কর কাঠামো অত্যন্ত জটিল। বলা হয়েছে, সম্পূরক কর (এক্সসাইজ ট্যাক্স), মূল্যে শতাংশ হিসেবে ধার্য রয়েছে। তামাক পণ্যের ধরণ এবং ব্রান্ডভেদে সম্পূরক করের উল্লেখযোগ্য তফাৎ রয়েছে। দামি ব্রান্ডের তুলনায় সস্তা ব্রান্ডের ওপর করের মাত্রা অনেক কম। সিগারেট ক্ষেত্রে স্তরভিত্তিক যে কর কাঠামো বিদ্যমান, যা ভিন্ন ভিন্ন এ্যাড-ভ্যালোরেম কর হিসেবে খুচরা মূল্যস্তরের ওপর ধার্য রয়েছে। বিড়ির ওপর ধার্য কর অত্যন্ত কম এবং তা কেবল সরকার নির্ধারিত ট্যারিফ ভ্যালুর প্রযোজ্য। এদিকে তামাক কোম্পানির কর ফাঁকি ও প্রচারণার কৌশল তামাক নিয়ন্ত্রণকে বাধাগ্রস্ত করছে। ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ তার প্রাইলট ব্র্যান্ড সিগারেটে মিথ্যা মূল্যস্তর ঘোষণায় প্রায় ৭শ’ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। মূল্যস্তর কম দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকির এ ঘটনা সম্প্রতি উচ্চ আদালতে প্রমাণ হওয়ায় অর্থ পরিশোধে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
বাজেটকে সামনে রেখে তামাক কোম্পনিগুলো প্রতি বছর সক্রিয় হয়ে ওঠে। তারা বিভিন্নভাবে এবিআর ও অর্থমন্ত্রণালয়কে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এফসিটিসি অনুযায়ী এসব বৈঠক প্রকাশ্যে হওয়ার কথা থাকলেও আমাদের দেশে তা মান্য হয় না। তাদের দাবির পক্ষে এমপিদের কাছ থেকে ডিও লেটার সংগ্রহ করে। গত বাজেট বক্তৃতায় মাননীয় অর্থমন্ত্রীও স্বীকার করেছেন “বিশ্বব্যপী ধূমপান বিরোধী রাষ্ট্রীয় নীতির সাথে সামঞ্জস্য বিধান, তামাকজাত পণ্যের স্বাস্থ্যঝুঁকিহেতু এর ব্যবহার কমিয়ে আনা এবং রাজেস্ব আয় বৃদ্ধি এখাতের একটি বড় চ্যালেঞ্জ”
গত ২০১৬ সালের ৩০-৩১ জানুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন’ শীর্ষক সাউথ এশিয়ান স্পিকার’স সামিট এর সমাপনী অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তামাকের ব্যবহার সম্পূর্ণ নির্মূল করার ঘোষণা দিয়েছেন। এই ঈপ্সিত লক্ষ্য অর্জনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তামাকের ওপর বর্তমান শুল্ক-কাঠামো সহজ করে একটি শক্তিশালী তামাক শুল্কনীতি গ্রহণের নির্দেশনা দিয়েছেন যাতে এখাতে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি তামাকপণ্যের ব্যবহার হ্রাস পায়। দেশের ৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাতেও ঝউএ-এর স্বাস্থ্য সংক্রান্ত লক্ষ্য- ৩ অর্জনে আন্তর্জাতিক চুক্তি ঋৎধসবড়িৎশ ঈড়হাবহঃরড়হ ড়হ ঞড়নধপপড় ঈড়হঃৎড়ষ (ঋঈঞঈ) বাস্তবায়ন ও তামাকজনিত ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
এমতাবস্থায়, জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতির ওপর তামাকের নেতিবাচক প্রভাবের কথা বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন- ‘২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তামাকের ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিমূর্ল করা’ বাস্তবায়নে অবিলম্বে একটি কার্যকর শুল্কনীতি প্রণয়নের প্রস্তাব করছি। মাথাপিছু আয়বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে কার্যকর শুল্কারোপের মাধ্যমে প্রতিবছর তামাকপণ্যের দাম বাড়াতে হবে যাতে তামাকপণ্য ক্রমশ ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। এছাড়া আগামী বাজেট ২০১৭-১৮-এর জন্য আমার সুনির্দিষ্ট সুপারিশ হচ্ছে: সিগারেটের মূল্যস্তরভিত্তিক কর-প্রথা বাতিল করে প্যাকেট প্রতি খুচরা মূল্যের কমপক্ষে ৭০ শতাংশ পরিমাণ সম্পূরক কর বৃদ্ধি করতে হবে। বিড়ির ট্যারিফ ভ্যালু তুলে দিয়ে প্যাকেট প্রতি খুচরা মূল্যের ৪০ শতাংশ পরিমাণ সম্পূরক কর বৃদ্ধি করতে হবে। গুল-জর্দার ক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ পরিমাণ সম্পূরক কর বৃদ্ধি করতে হবে। তামাকের ওপর আরোপিত স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ ১ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ২ শতাংশ নির্ধারণ করতে হবে। অবিলম্বে তামাকের বিদ্যমান শুল্ক-কাঠামোর পরিবর্তে কার্যকর তামাক শুল্কনীতি প্রণয়ন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়নে উদ্যোগী হলে ও এফসিটিসির আলোকে সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করলে অবশ্য ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকের ব্যবহার নির্মূল সম্ভব।
য় লেখক : প্রধান, স্বাস্থ্য সেক্টর, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
মোহাম্মাদ সাকিব হাসান হাবীব ২৬ অক্টোবর, ২০২০, ৪:০২ পিএম says : 0
আয়ের চেয়ে ব্যয় যেখানে বেশি সেখানে ব্যয় কমানোর চিন্তা করে বিড়ি সিগারেট পণ্যের মূল্য ক্রেতার ক্রয় ক্ষমতার ঊর্দ্ধে নিলে আসক্ত ক্রেতা ভাইবোনদের চাইলেই সমূলে ফেরানো সম্ভব নয়।কেননা নেশা আমি মোহাম্মাদ সাকিব হাসান হাবীবও করেছিলাম-আসক্তির চোটে ইচ্ছে হয় দুধ বিক্রি করে সকল নেশার মা সিগারেট ও মদ খাই। আলহামদুলিল্লাহ আমি এখন কোনো নেশা করিনা। কিন্তু আমার মতো সবাই যে ফিরে আসবে এটা আমি বিশ্বাস করিনা ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ শুধু মাত্র ওষুধ উদ্ভাবন ছাড়া তামাক উৎপাদন ও ক্রয় বিক্রয় নিষিদ্ধ করা না হয় ।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন