মাহমুদ ইউসুফ
জন্ম ২১শে অক্টোবর, ১৯৩০। পিতার নাম আলি হুসেন সরকার। পিতা ছিলেন পুলিশ অফিসার। কর্মসূত্রে তাঁকে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া, হুগলি, বাঁকুড়া, বিরভূম, নদিয়া প্রভৃতি জেলার বিভিন্ন স্থানে চাকরি করতে হয়েছে। স্বভাতই ওবায়দুল হক সরকারকেও বাল্যজীবন ও কিশোর জীবনেও বিচরণ করতে হয়েছে এখানে সেখানে। তখন থেকেই তিনি বিভিন্ন স্থানের, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের, বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের অধিবাসীদের বিচিত্র জীবন সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন।
ওবায়দুল হক সরকার বাংলাদেশের থিয়েটার ও ফিল্মস্টারদের মধ্যে অন্যতম। ছাত্রজীবন থেকেই অভিনয় নেশায় জড়িয়ে পড়েন।
পরবর্তীতে সরকারি দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সংস্কৃতিক অঙ্গনে ছিলো অবাধ বিচরণ। বিশুদ্ধ ও মূলধারার সংস্কৃতি চর্চায় ছিলেন নিবেদিত। মঞ্চ, রেডিও, টিভি এবং ফিল্মে সর্বত্রই তিনি কাজ করেছেন। নিষ্কলুষ চরিত্র, কাজের প্রতি অনুরাগ, প্রবল দায়িত্বানুভূতি, মৌলিক চিন্তা চেতনায় ঋদ্ধ, দেশিয় ইতিহাস ঐতিহ্যের অনুরাগী, মানুষ ও মাবতার প্রতি একনিষ্ঠ ভালোবাসা ছিলো এই গর্বিত মানুষটির চিন্তা ও কর্মজগতের বৈশিষ্ট্য।
ঔপনিবেশিক আমলে বাংলাদেশের মূলধারার সংস্কৃতি ছিলো গৃহকোণে বন্দি। ফিরিঙিদের অমানুষিকতায় ভূমিজপুত্ররা হয়ে পড়ে ছন্নছাড়া। আমাদের পূর্বপুরুষদের ওপর শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতিসহ সকল ক্ষেত্রে ইংরেজ ও বর্ণহিন্দু স¤প্রদায় মিলেমিশে আঘাত হানে। দুশ বছরের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে মুসলমানরাই ছিলো সামনের সারিতে। এদেশের প্রতি ইঞ্চি মাটির সাথে মিশে আছে ইমানদারদের রক্ত ও শ্রম। আর নেটিভ স¤প্রদায় ছিলো ইংরেজ সরকারের সহায়ক শক্তি। দুই স¤প্রদায় মিলে মুসলমানদের কৃষ্টি কালচার তাহযিব তামাদ্দুনকে ধূলিস্যাত করে দেয়।
বিশ শতকের গোড়ার দিকে নবাব সলিমুল্লাহ, নওয়াব আলি এবং শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের আবির্ভাব এবং মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠায় দুর্বিষহ পরিস্থিতির কিছুটা অবসান ঘটে। একই সাথে সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও স্ফূরণ ঘটে। সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজি, কাজী নজরুল ইসলাম, কবি গোলাম মোস্তফার কলম এবং আব্বাস উদ্দিনের কণ্ঠধ্বনিতে মূলধারার সংস্কৃতি ঝলমলিয়ে ওঠে। মাওলানা আকরম খাঁ, মুজিবুর রহমান খাঁ, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, কে মল্লিক, খাজা নসরুল্লাহ, কাজি জালাল উদ্দিন, খাজা আজমল, নাজির আহমদ, ওবায়েদ-উল-হক, ইসমাইল মোহাম্মদ, আবুল হাশিম, আবুল মনসুর আহমদ, এয়াকুব আলি চৌধুরী, বন্দে আলি মিয়া ছিলো এ পথেরই সহযাত্রী। পরবর্তীতে ফররুখ আহমদ, ড. এম আকবর আলি, ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন, খান আতাউর রহমান, ফতেহ লোহানি, মোহাম্মদ মোদাব্বের, বেনজির আহমদ এ ধারাটি সমৃদ্ধ করেন। আরও পরে আসেন ড. আসকার ইবনে শাইখ, অধ্যাপক শাহেদ আলী, অধ্যক্ষ দেওয়ান আলী আজরফ, সৈয়দ আলী আহসান, সৈয়দ আলী আশরাফ, ওবায়দুল হক সরকার, আরিফুল হক, রফিকুজ্জামান চৌধুরী, আল মাহমুদ, কবি মতিউর রহমান মল্লিক, সৈয়দ আশরাফ আলী, অধ্যাপক ড. এস. এম. লুৎফর রহমান, শফীউদ্দিন সরদার প্রমুখ।
সৃজনশীল, সুস্থ, পরিচ্ছন্ন সংস্কৃতি সৃষ্টিতে মুখর এ নাট্যকারের নাট্যজীবন। শেকড়ের পিছনে ছুটছেন অবিরত। শেকড় অনুসন্ধানে গিয়ে উপমহাদেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর আখ্যান-উপখ্যান, আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট, রাজনৈতিক উত্থানপতন, নেটিভদের বিশ্বাসঘাতকতা, কৃতিত্ব হরণের চালচিত্র তাঁকে ব্যথিত করে তোলে। ওবায়দুল হক সরকারের সাংস্কৃতিক চেতনা সম্পর্কে অবহিত হওয়া যাবে তাঁর ‘জাতীয় সংস্কৃতি ও গণমাধ্যম’ গ্রন্থের ভূমিকায় প্রদত্ত বক্তব্য থেকে। তিনি লিখেছেন, ‘প্রবাদ আছে- ‘‘একটা জাতিকে ধ্বংস করতে হলে তার সংস্কৃতিকে আগে ধ্বংস কর’’। সাংস্কৃতিক বশ্যতা রাজনৈতিক বশ্যতার সূচনা করে।
জীবন প্রবাহের কোনো একসময় তিনি নাস্তিকতা, কমিউনিজম, সোসালিজম দ্বারা আচ্ছন্ন হয়েছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে চিন্তাজগতে সৃজিত হয় আলোর বিচ্ছুরণ। এ সম্পর্কে নিজেই লিখেছেন: ‘মক্কা ছেড়ে আমিও কোনকালে মস্কো ধরেছিলাম। তথাকথিত প্রগতির মোহে দুর্গতির শিকার হয়েছিলাম। সময়মত ইসলামি মূল্যবোধের দুর্গে আশ্রয় নেওয়ায় আর দুর্গতি আমাকে নি:শেষ করতে পারেনি।’ তিনি আরও বলেছেন, আল্লাহ মানুষকে চোখ দিয়েছেন সুন্দর জিনিস বা বস্তু দেখার জন্য, কান দিয়েছেন ভালো কিছু শোনার জন্য আর মুখ দিয়েছেন ভালোকথা বলার জন্য।’ তাঁর জীবন সঙ্গীনি রোকেয়া সরকার জীবনের অন্তিম দিনগুলোর বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে: ‘সরকার সাহেব যেমন নাটক আর চলচ্চিত্র করতে ভালোবাসতেন তেমনি তাঁর প্রিয় আর একটি বিষয় ছিলো লেখা। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার লেখনি বৃদ্ধি পেতে থাকল। পাগলের মত টেবিলে বসে লিখতেন। তাঁর সেসব লেখা আজ আমাকে হতবাক করে দেয়। যখন লিখত তখন ভুল করেও ভাবিনি কত মূল্যবান ও তথ্যবহুল ছিলো সেসব লেখা যা আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দলিল হয়ে রইবে। ----- বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক কর্মকাÐে তাঁর অবদান কতটুকু সেই বিচারের ভার আপনাদের উপর রইল। কিন্তু একটা কথা সত্যি- এ অভিযোগ বিহীন মানুষটি কারোর ওপর কোনো অভিযোগ রেখে যাননি। শুধু নিজেদের শেকড়টাকে শক্ত করে ধরে রাখার অনুরোধ করে গেছেন।’(সাহিত্য ত্রৈমাসিক প্রেক্ষণ, অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০০৫, খন্দকার আবদুল মোমেন সম্পাদিত, মোহাম্মাদপুর ঢাকা)
গণমাধ্যমের স্ববিরোধীতা, জাতিকে শেকড়শূূণ্য করার প্রচেষ্টা, জাতিসত্তা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বিরোধী অবস্থান ও প্রচারণার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান এ বরেণ্য নাট্যকার। সূ²ভাবে, স্থূলভাবে, কুটকৌশলে ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস ও চিন্তা চেতনায় আঘাত হানে। নাটক,, চলচ্চিত্র, মঞ্চ ও প্রচার মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের মতাদর্শ আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। মরহুম সরকার একা কলম হাতে এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। যিনি শুধু একজন ব্যক্তি ছিলেন না, ছিলেন একটি ইনস্টিটিউশন। বাংলাদেশে নাট্য আন্দোলনে ইতিহাস, বাংলাদেশকে ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র এবং জাতীয় সংস্কৃতি ও গণমাধ্যম গ্রন্থসমূহ স্টাডি করলে যে কোনো নাগরিক শিহরিত হতে বাধ্য। সংস্কৃতির জগতের অতীত বর্তমান অবস্থান, আমাদের শত্রুমিত্র, আমাদের করণীয় ঠিক করতে অবশ্যই মরহুম ওবায়দুল হক সরকারের চিন্তাচেতনার সাথে একাত্ম হতে হবে।
ওবায়দুল হক সরকার বাঁকুড়া জিলা স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। ম্যাট্টিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন বিরভূম জিলা স্কুল থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন। ১৯৪৭ সালে কুমিলা ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হন কিন্তু আইএ পাশ করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে ভর্তি হন। তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। ১৯৫৪ সালে সম্মান এবং ১৯৫৫ সালে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৫৫ সালে এমএ পাশ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হোমিও ইকনমিক সার্ভে বোর্ডে কয়েক মাস চাকরি করেন। অত:পর পাকিস্তান সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি নিয়ে ১৯৫৭ সালের জানুয়ারি মাসে করাচি চলে যান। ১৯৬১ সালে জানুয়ারি মাসে চন্দ্রঘোনা কর্ণফুলি পেপার মিলে লেবার অফিসার হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬২ সালের জুন মাসে ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান সড়ক পরিবহন সংস্থার পাবলিক রিলেশন অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৫ সালের মার্চ মাসে লাহোর পিটাকে যোগ দেন। কেন্দ্রীয় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সুপারিশক্রমে তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের ঢাকা অফিসে গবেষণা অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৮৯ সালের ০২রা ডিসেম্বর উপ-প্রধান তথ্য অফিসার হিসেবে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
মঞ্চ, বেতার, টেলিভিশন এ তিন মাধ্যমেই ছিলো তাঁর সরব উপস্থিতি। চলচ্চিত্র ও নাটকের সাথে ছিলেন জীবনের দীর্ঘ সময়। ১৯৪৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া শহরে প্রথম অভিনয়ের শুরু করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীনের পূর্ব পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে নাটক করেন। ১৯৪৭ সালে কুমিল্লার ‘দি গ্রেট জার্নাল’ এ যোগ দেন। ১৯৪৯ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়ও নাটক করেন।
১৯৫০ সালে ঢাকায় এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনিই বাংলাদেশে প্রথম নারীপুরুষের যৌথ নাট্যাভিনয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৫৬ সাল থেকে নাটক পরিচালনায় হাত দেন। কয়েকশত নাটক পরিচালনা করেন। করাচিতেও বহু নাটক পরিচালনা করেন। ১৯৬৪ সালে ঢাকায় বঙ্গরূপ নাট্য একাডেমির অধ্যক্ষ হন। শতাধিক সংগঠনের নাটক পরিচালনা করেন। সহস্রাধিক নাটকের শিষ্য তার আছে। ১৯৫০ সাল থেকে ঢাকা বেতারে নাট্যশিল্পী তালিকাভুক্ত হন। ১৯৬৪ সালে প্রযোজক হলেন। কয়েকশত নাটক বেতারে করেছেন।
১৯৬৬ সাল থেকে টেলিভিশনে অভিনয় শুরু করেন। জীবনে বহু সাপ্তাহিক ও ধারাবাহিক নাটক করেছেন। শুকতারা, আনোয়ারা, সুবর্ণ সময় ইত্যাদি ধারাবাহিক উল্লেখযোগ্য। এছাড়া প্রায় ৮৯ টি মুক্তিপ্রাপ্ত পূর্ণদৈর্ঘ্য ছায়াছবিতে অভিনয় করেছেন। জাতীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের চেয়ারম্যান হিসেবে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের উন্নয়ন এবং সুষ্ঠ বিনোদন চর্চায় তিনি যথেষ্ট অবদান রেখেছেন। স্ত্রী এবং তিন কন্যা রেখে ২০০৫ সালের ৬ই নভেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন