শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

জ্বালানি জোগাবে এলএনজি টার্মিনাল

মিনি সিঙ্গাপুরের পথে মাতারবাড়ী

শফিউল আলম : | প্রকাশের সময় : ২৩ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বঙ্গোপসাগরের কিনারে পাহাড়-সমতলে কক্সবাজার জেলার নয়ন জুড়ানো দ্বীপ জনপদ মহেশখালী। আয়তন ৩৬২ দশমিক ১৮ বর্গ কিলোমিটার। তারই একটি উপদ্বীপ মাতারবাড়ী। এটি আজ বাংলাদেশের উন্নয়নের মহাসড়কে যুক্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে বহুমাত্রিক ও সুবিশাল অবকাঠামো নির্মাণ কার্যক্রম। পর্যটন শহর কক্সবাজারের অদূরে মাতারবাড়ীসহ সমগ্র মহেশখালী দ্বীপকে ঘিরে দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগে বিভিন্ন প্রকল্প আর মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এগিয়ে চলেছে। এরফলে আগামী পাঁচ বছর থেকে এক দশকের মধ্যেই কক্সবাজারের চেহারা পাল্টে যাবে। আর তাতে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান আশা করছে সরকার। পরিবেশ ও ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, পশ্চাদভূমি (হিন্টারল্যান্ড) হিসেবে সুযোগ-সুবিধা থাকায় মাতারবাড়ী এলাকায় ধাপে ধাপে গড়ে তোলা হচ্ছে এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) ও জ্বালানি তেল টার্মিনাল, কয়লাভিত্তিক সর্বাধুনিক প্রযুক্তির তাপবিদ্যুৎ মেগাপ্রকল্প এবং গভীর সমুদ্র বন্দর। এছাড়া প্রতিষ্ঠিত হবে অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং পর্যটন জোনসহ উপশহর। সবকিছু মিলিয়ে আগামীর স্বপ্নের মিনি সিঙ্গাপুর সিটিতে রূপান্তরিত হওয়ার প্রত্যাশা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, মাতারবাড়ীসহ মহেশখালী দ্বীপকে কেন্দ্র করে। দ্বীপরাষ্ট্র সিঙ্গাপুরের স্থলভূমির মোট আয়তন ৬৯৯ বর্গ কিলোমিটার। এর তটরেখার দৈর্ঘ্য ১৯৩ কি.মি.। সুষ্ঠু পরিকল্পনা, বলিষ্ঠ জাতীয় নেতৃত্ব, জাতিগত আত্মবিশ্বাস ও উচ্চাভিলাষে বলীয়ান হয়ে সেই নিকট অতীতের হতদরিদ্র জেলেপল্লীই উন্নতির চরম শিখরে আরোহন করে হয়েছে বিশ্বের বিস্ময় আজকের সিঙ্গাপুর।
মাতারবাড়ীর মেগাপ্রকল্পের মূল অবকাঠামো বিনির্মাণে সহায়তা করছে জাপান। ‘বাংলাদেশ-জাপান কম্প্রিপ্রহেনসিভ পার্টনারশিপ’ সমঝোতার আওতায় এ উন্নয়ন পথচলা শুরু। যৌথ কিংবা একক বিনিয়োগের ভিত্তিতে বাংলাদেশের সাথে উক্ত খাত-উপখাতে অর্থায়ন ও কারিগরি সহযোগিতায় আগ্রহী জাপান, চীন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ভারত, তাইওয়ানসহ বিভিন্ন দেশ। মেগাপ্রকল্প ও প্রকল্পের মধ্যে আছে ১০টি বিদ্যুৎকেন্দ্র, ৩টি এলএনজি টার্মিনাল, একটি বহুমুখী সুবিধাসম্পন্ন সমুদ্রবন্দর ও তিনটি অর্থনৈতিক জোন। প্রকল্প-মহাপ্রকল্পের পেছনে আগামী ১০ বছরে অন্তত আড়াই লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগের ব্যাপারে আশাবাদী সরকার। আর তা বাস্তবায়িত হলে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের পথ খুলে যাবে। সমগ্র কক্সবাজার ও দক্ষিণ চট্টগ্রামবাসীর জীবনযাত্রার মান হবে উন্নততর।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিবিড় তত্ত্বাবধানে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্যসচিবসহ সিনিয়র সচিব ও সচিবগণ মহেশখালী মাতারবাড়ী প্রকল্প-মেগাপ্রকল্পসমূহের বাস্তবায়ন কার্যক্রম দেখভাল করছেন। এসব প্রকল্প সরকারের ফার্স্ট ট্র্যাক তথা অগ্রাধিকার বিবেচিত।
চট্টগ্রাম শিল্প-কারখানার আদিস্থান। তবে প্রধানত গ্যাসের সঙ্কটে উৎপাদন মুখ থুবড়ে পড়েছে দীর্ঘদিন। বিনিয়োগ ও শিল্পায়ন স্থবির। চাহিদা ক্রমাগত বাড়লেও দেশে গ্যাসের উত্তোলন তেমন বাড়ছে না। এই প্রেক্ষাপটে গ্যাস আমদানির মাধ্যমে চাহিদা মেটানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে মাতারবাড়ীতে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করে সেখান থেকে গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে মহেশখালী-পেকুয়া হয়ে চট্টগ্রামের আনোয়ারা-ফৌজদারহাট পর্যন্ত জাতীয় গ্রিড লাইনে সরবরাহ করা হবে। এর জন্য অবকাঠামো স্থাপনের কাজ চলছে। প্রায় ৯৮২ কোটি টাকা ব্যয়ে গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে দৈনিক ৫শ’ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ সম্ভব হবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। পাইপলাইন স্থাপনে ৫টি কোম্পানি দায়িত্ব পেয়েছে। ৬ হাজার ৭শ’ মিটার দীর্ঘ মূল পাইপলাইনটি মহেশখালীর ধলঘাট হয়ে পশ্চিমে এলএনজি টার্মিনালকে যুক্ত করবে। মহেশখালী-পেকুয়া থেকে আনোয়ারা ও পরবর্তীতে ফৌজদারহাট অবধি পাইপলাইন চট্টগ্রামকে গ্রিড পয়েন্টে যুক্ত করবে। জাতীয় গ্রিডে সরবরাহের জন্য ৩টি সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। এর নির্মাণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে ‘বিদুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ এর আওতায়। মেগাপ্রকল্পের জন্য অধিভূক্ত এলাকাসমূহে ভূমি অধিগ্রহণের কাজ সম্পন্ন হওয়ার পথে। চলছে ভ‚মি উন্নয়ন কার্যক্রম।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামে শুধ্ইু নয় দেশে গ্যাসের ঘাটতি নিরসনে এলএনজি আমদানির মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। দেশে বর্তমানে চাহিদার বিপরীতে দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে। আমদানিকৃত এলএনজি খালাসের জন্য মহেশখালীর মাতারবাড়ি সমুদ্র উপকূলকেই টার্মিনাল অবকাঠামোর জন্য সবচেয়ে উপযোগী স্থান হিসেবে বিশেষজ্ঞরা মতামত দেন। সেখানে বাস্তবায়িত হচ্ছে জ্বালানি খাতের মেগাপ্রকল্প। গড়ে তোলা হবে বিশাল এক ‘এনার্জি হাব’। এরজন্য ৩টি এলএনজি টার্মিনাল এবং আমদানিকৃত পরিশোধিত ও অপরিশোধিত জ্বালানি তেল হ্যান্ডলিং ও পরিবহনের জন্য নির্মিত হবে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং টার্মিনাল। মহেশখালী মাতারবাড়ী এনার্জি হাব বাস্তবায়নে ধাপে ধাপে ব্যয় হবে ২ লাখ ৫ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা। প্রাথমিকভাবে আগামী বছর ২০১৮ সালের শেষ নাগাদ এলএনজি সরবরাহ শুরু হওয়ার কথা। যা চট্টগ্রামে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে।
এসপিএম প্রকল্পের আওতায় সামুদ্রিক ট্যাঙ্কার-জাহাজ থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে সরাসরি দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি তেল পরিশোধন কারখানা ইস্টার্ন রিফাইনারি লিঃ এবং পতেঙ্গায় দেশের প্রধান জ্বালানি তেলের স্থাপনা পর্যন্ত জ্বালানি তেল সরবরাহের জন্য সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং টার্মিনাল (এসপিএম) নির্মিত হবে। ডাবল পাইপলাইনসহ এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ৪ হাজার ৯৩৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা ব্যয় হবে। স¤প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এ প্রসঙ্গে বলেন, সরকারের নিবিড় পরিকল্পনা অনুসারে মাতারবাড়ীসহ মহেশখালী দ্বীপকে এনার্জি হাব হিসেবে গড়ে তোলার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এলএনজি টার্মিনাল ও পাইপলাইন স্থাপনের প্রাথমিক প্রক্রিয়া এগিয়ে চলেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশে গ্যাসের ঘাটতি মেটাতে বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে পেট্রোবাংলা বিল্ড ওন অপারেট এন্ড ট্রান্সফার (বিওওটি) ভিত্তিতে মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে ফ্লোটিং স্টোরেজ এন্ড রি-গ্যাসফিকেশন ইউনিট স্থাপন করছে। সেখান থেকে ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মাতারবাড়ীতে দৈনিক ১০০ কোটি ঘনফুট হ্যান্ডলিং ও ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ল্যান্ড বেইসড এলএনজি টার্মিনাল নির্মিত হবে।
তাছাড়া দেশের সমুদ্রসীমা থেকে উৎপাদন ও বন্টন চুক্তির আওতায় সাগরপ্রান্তিক গ্যাসক্ষেত্র থেকেও প্রাকৃতিক গ্যাস আহরণের সম্ভাবনা রয়েছে। এসব দিক সামনে রেখে এলএনজি টার্মিনাল এবং সাগর ব্লকের সম্ভাব্য গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহের জন্য মহেশখালী-পেকুয়া হয়ে আনোয়ারা-ফৌজদারহাট গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন প্রকল্পটি গৃহীত হয়েছে। এর আওতায় কর্ণফুলী নদীতে ১ দশমিক ৩ কিলোমিটার রিভারক্রসিংসহ ৪২ ইঞ্চি ব্যাসের ৩০ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন, একটি রেগুলেটরিং এবং মিটারিং স্টেশন নির্মাণ, সিপি সিস্টেম, পথস্বত্ব ও পরিবেশগত জরিপ এবং ভূমি অধিগ্রহণ, ভূমি উন্নয়ন। মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র, এলএনজি-এসপিএম টার্মিনাল স্থাপনের পরিকল্পনাটি সাজানো হয়েছে সমন্বিতভাবে। দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রার পূর্বশর্ত হিসেবে জ্বালানি চাহিদা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে মাতারবাড়ী ‘এনার্জি হাব’ গুরুত্বপূর্ণ ‘ফার্স্ট ট্র্যাক’ মেগাপ্রকল্প হিসেবেই দেখছে সরকার।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (6)
মিলন ২৩ অক্টোবর, ২০১৭, ৫:৫২ এএম says : 0
আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে কাজটি সঠিকভাবে শেষ হবে।
Total Reply(0)
Sirajur Rahman ২৩ অক্টোবর, ২০১৭, ৮:৩১ এএম says : 0
Good proposition. But how much time and month has bee n spent for evaluation? No mention about the background info. The LNG terminal will start supplying 500 MMSCFD gas. But how far can the capacity will be possible to be increased? No mention. Remember that every year cyclone will possibly come in May and November. Still good start.
Total Reply(0)
Md Alinoor Hossain ২৩ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:৫৪ পিএম says : 0
দেশের একি অবস্থা. কেউ বলে মালয়েশিয়া কেউ বলে হংকং আবার কেউ. মিনি সিংগাপুর. ........ কথা শুনতে আর ভাল লাগেনা
Total Reply(0)
Badrudoza H Khondaker ২৩ অক্টোবর, ২০১৭, ১:৪৩ পিএম says : 0
Bangladesh is one of the top natural resourceful country in Asia-Pacific region. We have many potentialities. Cox's Bazar especially Moheshkhali Matarbari surely to turn as Energy Hub. JAICA provides cooperation. So there are lots of prospect behind the Mega Projects. LNG terminals are feasible obviously.
Total Reply(0)
Dr. Md Moin Uddin Khan ২৩ অক্টোবর, ২০১৭, ১:৫১ পিএম says : 0
Govt must have to take immediate step for implementation the mega projects. We thank and welcome JAICA, Japan govt too.
Total Reply(0)
A M Mohsin Akber ২৩ অক্টোবর, ২০১৭, ৩:১২ পিএম says : 0
We thank to PM Sheikh Hasina for developing Matarbari Moheshkhali Cox's Bazar.
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন