স্টাফ রিপোর্টার : রাজধানীর বনানীর একটি ছয় তলা আবাসিক ভবনে বৃহস্পতিবার গভীর রাতে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে ১ জন দগ্ধ এবং অন্ততঃ ২০ জন আহত হয়েছেন। গ্যাস লাইন লিকেজ হয়ে বিস্ফোরণের পর আগুন লাগে বলে জানিয়েছেন সেখানের বাসিন্দারা। আগুন লাগার পর ভবনটির ছাদে আত্মরক্ষায় থাকা বাসিন্দাদের উদ্ধারের পাশাপাশি আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিস। বিস্ফোরণে ওই ভবনের কয়েকটি তলার দেয়ালসহ আশপাশের কয়েকটি ভবনের দরজা-জানালাও উড়ে গেছে। রাজউক ও বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা ভবনটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছে।
বাড়ির বাসিন্দা ও এলাকাবাসীর অভিযোগ, রাস্তায় খোঁড়াখুঁড়ির সময় গ্যাস লাইন ফুটো হয়ে যায়। গ্যাস লাইনের ওই ফুটো থেকেই আগুন লেগেছে। এই বিস্ফোরণের দায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ও তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ একে অন্যের ওপর চাপাচ্ছে। এদিকে এ ঘটনার দায় তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ কোনো ভাবেই এড়াতে পারেন না বলে জানিয়েছেন ঢাকা সিটি উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক।
ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার রাত ১টা ৪০ মিনিটে বনানীর ২৩ নম্বর রোডের ৯ নম্বর হোল্ডিংস্থ ৬ তলা ভবনের তৃতীয় তলায় আগুন লাগে। এর আগে সেখানে বিকট বিস্ফোরণ ঘটে। অল্প সময়ের মধ্যেই আগুন তৃতীয়তলা থেকে ষষ্ঠতলা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। আগুন লাগার পর তৃতীয়তলা থেকে উপরের সব ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা আত্মরক্ষার জন্য ছাদে উঠেন। সেখানেই তারা আটকা পড়েন। ছয়তলা ওই ভবনের প্রতিটি তলায় রয়েছে চারটি করে ফ্ল্যাট। দ্বিতীয় তলায় একটি বায়িং হাউজের অফিস ছাড়া সব ইউনিটই আবাসিক। আগুন লাগার খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস সদরদপ্তরসহ ৫টি স্টেশন থেকে মোট ১৮টি ইউনিট দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। টানা তিন ঘণ্টা চেষ্টার পর রাত ৪টা ৪০ মিনিটে ফায়ার কর্মীরা আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। এর আগে তারা ভবনটির ছাদে আটকে পড়া ৩০ জন বাসিন্দাকে নিরাপদে নামিয়ে আনেন। এছাড়া নাভেদ ইমতিয়াজ নামে অগ্নিদগ্ধ একজনকে ফায়ার সার্ভিসের এ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ধোঁয়া এবং তাড়াহুড়ায় নামতে গিয়েই অধিকাংশ ব্যক্তি আহত হয়েছেন। বিস্ফোরণে ভবনের দ্বিতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলার সামনের দেওয়াল ভেঙে পড়েছে। ফাটল দেখা দিয়েছে ফলস পিলারে। ভবনটির পঞ্চম তলার এক বাসিন্দা জানান, বিস্ফোরণের শব্দে ঘুম ভেঙে তিনি আগুন দেখতে পান। এরপর দেখেন ফ্ল্যাটের সব জানালার কাঁচ ভেঙে গেছে, জিনিসপত্র ছড়ানো ছিটানো। প্রতিটি ফ্লোরেরই একই অবস্থা।
ভবনটির একজন মালিক শামসুল আলম ও তার বোন নাইয়ার রহমান বলেন, গত তিন দিন ধরে গ্যাসের লাইন ফুটো হয়ে গ্যাস বের হচ্ছে। এ ব্যাপারে তারা তিতাস গ্যাসে অভিযোগ করেছেন। বৃহস্পতিবার একবার, বিকেল চারটায় একবার ও রাত ১০টা ৫২ মিনিটে তিতাস গ্যাসে অভিযোগ জানানো হয়। সর্বশেষ রাত ১০টা ৫২ মিনিটে তিতাসের অভিযোগকেন্দ্র থেকে একজন বলেন, শ্রমিক পাঠাতে পারলে তারা লাইন মেরামত করে দেবেন। এর পর রাতেই অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। শামসুল আলমসহ বাড়িটির শরিকেরা জানান, মাইলস্টোন নামে ছয়তলা ওই ভবনে ২০১০ সাল থেকে বসবাস করছেন। সেখানে ২০টি ফ্ল্যাট রয়েছে। বাসার নিচতলায় গ্যারেজ। তারা বলেন, বাসার সামনের রাস্তায় কয়েক দিন ধরে খোঁড়াখুঁড়ি চলছিল। এ সময় গ্যাসের লাইন ফুটো হয়ে গেছে বলে তাদের ধারণা। জমে থাকা পানিতে বুদবুদ হয়ে গ্যাস বের হতে দেখেছেন। সেখানে গ্যাসের গন্ধ পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে তিতাস গ্যাসের পরিচালক (অপারেশন) এইচ এম আলী আশরাফ বলেন, প্রাথমিকভাবে তারা মনে করছেন, ভবনটি সংলগ্ন স্যুয়ারেজের পাইপ দিয়ে গ্যাস ওপরে উঠে গেছে। তিনি অভিযোগ করেন, গ্যাসের লাইন ফুটো হওয়ার কথা ওয়াসা তাদের জানায়নি। জানালে ব্যবস্থা নেওয়া যেত। এরপরেও তিতাস গ্যাসের অভিযোগকেন্দ্র থেকে যিনি শ্রমিক পাঠানোর কথা বলেছিলেন, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অপরদিকে ওয়াসার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক এডিএম কামরুল আলম চৌধুরী বলেন, তারা রাস্তায় খোঁড়াখুঁড়ি করে পাইপ বসানোর কাজ করছিলেন না।
ক্ষতিগ্রস্তরা অভিযোগ করেছেন, গ্যাসের লিকেজ থেকেই আগুনের সূত্রপাত এবং এতো বড় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তিতাসকে গ্যাস লিকেজ হওয়ার বিষয়টি বহুবার জানানো হলেও তারা কর্ণপাত করেনি। গতকাল দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক বিষয়টি জানতে পেরে তিনিও তিতাসের আচরণে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, রাতে অগ্নিকা-ের খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমি এখানে চলে আসি। ভবন থেকে মানুষদের নিরাপদে বের করে আনার জন্য আমি নিজে কাজ করেছি। গ্যাসের লাইন লিকেজের বিষয়ে আমাদের লোক বেশ কিছুদিন আগে তিতাসের কমপ্লেইন বক্সে অভিযোগ করেছে। কিন্তু তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তিতাস, ওয়াসা, ডেসা ও সিটি করপোরেশনের মধ্যে সমন্বয়হীনতার করণেই এই অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে বলেও জানান তিনি। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, বিস্ফোরণের দায় কোনভাবেই তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে না।
ঘটনা তদন্তে ৩ সদস্যের কমিটি
ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, গ্যাস লাইনের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণ ও আগুন লেগেছে কি না তা নিয়ে তদন্ত চলছে। এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে। আগুন লাগার কারণ ও ক্ষতির পরিমাণ এখনো জানা যায়নি।
ঘটনা তদন্ত করছে তিতাস
রাজধানীর বনানীর আবাসিক ভবনে আগুন লাগার ঘটনা গ্যাস লাইনের লিকেজ থেকে হয়েছে কিনা তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড কর্তৃপক্ষ। গতকাল দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে তিতাস ভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিতাসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ কথা জানান। কর্মকর্তারা বলেন, গ্যাস লাইনের কোনো লিকেজ (ছিদ্র) ছিলো কিনা তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
অভিযোগ আমলে নেয়নি তিতাস কর্মচারী
ভবনটিতে আগুন লাগার তিন ঘণ্টা আগেও তিতাস গ্যাস লিমিটেডের অভিযোগ কেন্দ্রে ওই সড়কের পাইপ থেকে গ্যাস বের হওয়ার অভিযোগ করেন ভবনটির মালিক শামসুল আলমের সহকারী কামরুল ইসলাম। অভিযোগ শুনে তিতাসের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অভিযোগকারীকেই শ্রমিক জোগাড় করতে বলেন। অন্যথায় কাজ করা সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেন। বাড়ির মালিক ও আশপাশের বাসিন্দারা বলছেন, অভিযোগ পাওয়ার পর ব্যবস্থা নিলে দুর্ঘটনাটি এড়ানো যেত। এ ব্যাপারে তিতাস গ্যাসের পরিচালক (অপারেশন) এইচ এম আলী আশরাফ বলেন, তিতাস গ্যাসের অভিযোগকেন্দ্র থেকে যিনি শ্রমিক পাঠানোর কথা বলেছিলেন, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
গ্যাস লাইনের ফুটো বন্ধ হলো ভবন পোড়ার পর
বনানীর যে বাড়িতে মধ্যরাতে আগুন লেগে কয়েকটি ফ্লোর পুড়েছে তার পাশের গ্যাসলাইনের ছিদ্র বন্ধে কয়েক ঘণ্টা আগে তিতাসের দ্বারস্থ হয়েছিলেন বাসিন্দারা। তবে তিতাস কর্মীরা এসেছে আগুন লাগার ঘণ্টা দেড়েক পরে। আর যে ছিদ্র থেকে গ্যাস বেরিয়ে এই বিস্ফোরণ বলে ধারণা করা হচ্ছে তা বন্ধ করা হয়েছে গতকাল শুক্রবার সকালে। এ ঘটনায় তিতাস কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করার ঘোষণা দিয়েছেন ভবন মালিক শামসুল আলম, যার এক ছেলে আগুনে ঝলসে গেছে। ওই ভবনের বাসিন্দা এক নারী বলেন, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকেও তারা ফোন করে তিতাস কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নিতে বলেন। কিন্তু লেবার নেই, এই অজুহাতে কর্তৃপক্ষ লোক পাঠায়নি। পরে আগুন লাগার প্রায় দেড় ঘণ্টা পর রাত ৩টার দিকে তিতাসের কর্মীরা এসে ভবনটির গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তিতাসের উপ-সহকারী প্রকৌশলী শিবেন্দ্র নাথ ঘোষ বলেন, পাশের ওই ভবনের গ্যাসের পাইপলাইনে ছিদ্র পেয়েছেন তারা। ভবনের নীচ দিয়ে ২ ইঞ্চি পাইপ গেছে। তাতে পৌনে এক ইঞ্চি ছিদ্র করে সেখানে পাইপ বসিয়ে বাসায় গ্যাস সংযোগ নেওয়া হয়। মূল লাইনের একটা সংযোগে পাইপ ছিল না, সেখানে ছিদ্র দিয়ে অনবরত গ্যাস বেরোচ্ছিল। ওই গ্যাস কোনোভাবে পানি বা স্যুয়ারেজ পাইপে প্রবেশ করে। প্রচুর গ্যাস পাইপে ঢুকে পড়ায় বিস্ফোরণ হয়েছে বলে আমরা ধারণা করছি।
ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা
গতকাল বিকেলে রাজউক ও বুয়েটের বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধি দল ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটি পরিদর্শন করেন। শেষে তারা ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ও বসবাসের অনুপযোগী উল্লেখ করে সেটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করেন। এর আগে ভবনটির প্রতিটি ফ্লোরের একজন করে বাসিন্দাকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেয়া। তারা গুরুত্বপূর্ণ মালামাল ও কাগজপত্র বের করে আনেন। ভবনটিতে নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশ প্রহরা রয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন