আজিবুল হক পার্থ : সারাদেশের বিভিন্ন ইউনিয়নে হামলা, মামলা, ভাঙচুর, প্রচারণায় বাধাসহ নানা সহিংস ঘটনার মাধ্যমে আজ মধ্যরাতে শেষ হচ্ছে ৭২১ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনী প্রচারণা। এ পর্যন্ত সহিংসতায় নিহত হয়েছে ৯ জন। আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচনের প্রথম ধাপে ৭২১ ইউপিতে ভোটগ্রহণের সব প্রস্তুতিসম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গত রাতে নির্বাচনী এলাকাসমূহে মোটরসাইকেল চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। আজ থেকে মাঠে নামছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। মাঠে থাকবে ভোটের পরের দিন পর্যন্ত। আগামীকাল কেন্দ্রে ব্যালট পেপার নিয়ে অবস্থান করবেন প্রিজাইডিং অফিসাররা।
গতকাল শনিবার দুপুরে কালীগঞ্জে কৃষ্ণনগর ইউনিয়নে ও শুক্রবার রাতে আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর তিনটি কার্যালয়ে বোমা হামলা এবং অগ্নিসংযোগের এ ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া প্রচারণার শেষ মুহূর্তে এসে দেশের বিভিন্ন ইউপিতে হামলা-হুমকির ঘটনা ঘটেছে।
ইসির উপ-সচিব মো. সামসুল আলম স্বাক্ষরিত সড়ক বিভাগ, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সচিব বরাবর পাঠানো নির্দেশনা থেকে জানা যায়, ভোটের দিনের পূর্ববর্তী রাত ১২টা থেকে গ্রহণের দিন মধ্যরাত ১২টা পর্যন্ত বেবিটেক্সি, অটোরিকশা, ইজিবাইক, ট্যাক্সি ক্যাব, মাইক্রোবাস, জিপ, পিকআপ, কার, বাস, ট্রাক, টেম্পো প্রভৃতি যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে ভোটগ্রহণের পূর্ববর্তী তিনদিন থেকে ভোটগ্রহণের দিন মধ্যরাত পর্যন্ত মোটরসাইকেল চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে।
এরই মধ্যে ৩৪ জেলায় পাঠানো হয়েছে ব্যালট পেপারসহ প্রয়োজনীয় উপরকরণ। আগামীকাল বিতরণ করা হবে। এসব উপকরণ নিয়ে মাঠে অবস্থান করবেন নির্বাচনী কর্মকর্তারা।
ইসি সচিবালয়ের উপ-সচিব রকিবউদ্দীন মন্ডল বলেন, প্রথম ধাপে ৭২১টি ইউপি নির্বাচনের জন্য চেয়ারম্যান, সাধারণ ও সংরক্ষিত সদস্য পদের জন্য প্রায় সাড়ে চার কোটি ব্যালট পেপার জেলা নির্বাচন অফিসে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এসব এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী রোববার থেকে মাঠে নামছে। এছাড়া নির্বাচনী অপরাধের সাজা দিতে সাথে থাকছে নির্বাহী ও বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটগণ।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, ইউপিতে প্রথম ধাপে ইতোমধ্যে ৬২ জন চেয়ারম্যান, ১৭৯ জন সাধারণ সদস্য ও ৫৪ জন সংরক্ষিত সদস্য পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। যদিও ইতোমধ্যে আদালতের আদেশে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হতে যাওয়া ৬২ জনের মধ্যে থেকে ৬ জন ফিরে পেয়েছেন। ২২ মার্চের ভোটে তিন হাজার ৩৪ জন চেয়ারম্যান, সাধারণ সদস্য পদে ২৫ হাজার ৮৪৭ জন ও সংরক্ষিত পদে সাত হাজার ৫৭৫ জন প্রার্থী রয়েছেন। এরপর আরও পাঁচ ধাপে দেশের বাকি সাড়ে তিন হাজার ইউপিতে ভোট হওয়ার কথা রয়েছে।
আজ মাধ্যরাতে শেষ হচ্ছে প্রচার-প্রচারণা:
আজ মধ্যরাতে শেষ হচ্ছে প্রথম ধাপের ইউপি নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা। নির্বাচনী আইনানুযায়ী কোনো নির্বাচনী এলাকার ভোটগ্রহণ শুরুর পূর্ববর্তী ৩২ ঘণ্টা, ভোট গ্রহণের দিন সকাল ৮টা থেকে রাত ১২টা এবং ভোটগ্রহণের দিন রাত ১২টা থেকে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে উক্ত নির্বাচনী এলাকায় কোনো ব্যক্তি কোনো জনসভা আহবান, অনুষ্ঠান বা তাতে যোগদান করতে এবং কোনো মিছিল বা শোভাযাত্রা সংঘটিত করতে বা তাতে যোগদান করতে পারবেন না। একইসঙ্গে কোনো আক্রমণাত্মক কাজ বা বিশৃঙ্খলামূলক আচরণ করতে পারবেন না। এমনকি ভোটার বা নির্বাচনী কাজে নিয়োজিত বা দায়িত্ব পালনরত কোনো ব্যক্তিকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করতে পারবেন না। এই বিধি লঙ্ঘন করলে অন্যূন ৬ মাস বা অনধিক ৩ বছরের কারাদ-ে দ-িত হবেন।
মাঠে নামছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী
আজ সকাল থেকে প্রথম ধাপে ইউপি নির্বাচনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে মাঠে নামছে বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা। একইসঙ্গে ৩৪ জেলার ১০১টি উপজেলায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের পাশাপাশি জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটরাও অপরাধ তদারকিতে মাঠে থাকবেন। ইসি সচিবালয়ের উপ-সচিব সামসুল আলম জানান, ভোটের দু’দিন আগে থেকে (২০ মার্চ) মাঠে নামছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
বিধি অনুযায়ী, ভোট শুরুর ৩২ ঘণ্টা আগে থেকে সব ধরনের প্রচার, সভা-সমাবেশ ও শোডাউন নিষিদ্ধ। ভোটের পরে ৪৮ ঘণ্টাও কোনো মিছিল করা যাবে না।
নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সূত্রগুলো জানিয়েছে, এ নির্বাচনে প্রায় সাড়ে সাত হাজার ভোটকেন্দ্র রয়েছে। যেখানে সাধারণ ও ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র ভেদে ১৭ থেকে ২০ জনের ফোর্স মোতায়েন থাকবে। এক্ষেত্রে কেবল ভোটের দিনই প্রায় দেড় লাখ ফোর্স ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকবে। এছাড়া রোববার থেকে ভোটের পরের দিন বুধবার পর্যন্ত মোট চারদিনের জন্য মাঠে থাকবে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, কোস্ট গার্ডের মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স। সব মিলিয়ে প্রায় দুই লাখ সদস্য নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবেন।
ইসি’র ফোর্স মোতায়েনের পরিকল্পনা অনুযায়ী, পুলিশ, এপিবিএন ও ব্যাটেলিয়ন আনসারের সমন্বয়ে প্রতি ইউনিয়নে ১টি করে ৭২১টি মোবাইল ফোর্স ও প্রতি তিন ইউপির জন্য স্ট্রাইকিং ফোর্স রাখা হচ্ছে।
অন্যদিকে প্রতি উপজেলায় ২টি করে র্যাবের মোবাইল টিম ও ১টি স্ট্রাইকিং টিম এবং প্রতি উপজেলায় ২ প্লাটুন বিজিবি মোবাইল ও ১ প্লাটুন স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে থাকছে। আবার উপকূলীয় অঞ্চলে প্রতি উপজেলার জন্য কোস্টগার্ডের ২ প্লাটুন মোবাইল ফোর্স ও এক প্লাটুন স্ট্রাইকিং ফোর্স থাকছে। যারা ভোটের দু’দিন আগে থেকে পরে একদিন মোট চারদিনের জন্য নিয়োজিত থাকবে। এক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন প্রয়োজন মনে করলে ফোর্স মোতায়েনের এ সংখ্যা কম-বেশি হতে পারে।
এদিকে রোববার থেকে প্রতি উপজেলায় একজন করে বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট ও ৩ জন করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটও মাঠে থাকবেন। তারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে মুভ করবেন। এক্ষেত্রে যেকোনো নির্বাচনী অপরাধ আমলে নিয়ে তারা শাস্তি প্রদান করতে পারবেন।
মোটরসাইকেলসহ যান চলাচল নিষিদ্ধ
গত শনিবার মধ্যরাত থেকে নির্বাচনী এলাকায় মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়া ভোটের আগের রাত থেকে ৩২ ঘণ্টা সব ধরনের যান চলাচল নিষিদ্ধ করেছে ইসি। নির্বাচন কমিশনের এক নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ভোটগ্রহণের পূববর্তী দিন থেকে ভোটগ্রহণের দিন মধ্যরাত পর্যন্ত নির্বাচনী এলাকায় মোটরসাইকেল চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে। এছাড়াও ভোটগ্রহণের পূর্ববর্তী মধ্যরাত থেকে অর্থাৎ সোমবার মধ্যরাত থেকে ভোটের দিন মধ্যরাত পর্যন্ত অটোরিকশা/ইজিবাইক, ট্যাক্সিক্যাব, মাইক্রোবাস, জিপ, পিকআপ, কার, বাস, ট্রাক ও টেম্পো চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। তবে রিটার্নিং কর্মকর্তার অনুমতি সাপেক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী/তাদের নির্বাচনী এজেন্ট, দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক ও অনুমোদিত সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে তা শিথিল থাকবে।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ সাধারণ নির্বাচন উপলক্ষে কতিপয় যান চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এবারও তাই করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ভোটগ্রহণের পূর্ববর্তী তিনদিন আগে থেকে ভোটের দিন মধ্যরাত ১২টা পর্যন্ত মোটরসাইকেল চালানোর উপর নিষেধাজ্ঞা রাখতে সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
এছাড়াও নির্দেশনায় বলা হয়েছে, জাতীয় মহাসড়ক (হাইওয়ে), বন্দর ও জরুরি পণ্য সরবরাহসহ অন্যান্য জরুরি প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় যান চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞা শিথিলের বিষয়ে প্রয়োজনীয় কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারবেন।
সড়ক বিভাগ, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সচিব বরাবর পাঠানো আরেকটি নির্দেশনায় নৌ-যান চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞায় বলা হয়েছে, ভোটের দিনের পূর্ববর্তী রাত ১২টা থেকে গ্রহণের দিন মধ্যরাত ১২টা পর্যন্ত লঞ্চ, ইঞ্জিনচালিত সকল ধরনের নৌ-যান ও স্পিটবোট চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে বলা হয়েছে।
ইসির নির্দেশনায় আরো বলা হয়েছে, নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহে নিয়োজিত দেশি-বিদেশি সাংবাদিক (পরিচয়পত্র থাকতে হবে), নির্বাচনের কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারী, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, নির্বাচনের বৈধ পরিদর্শক এবং চিকিৎসা, ফায়ার সার্ভিস, বিদ্যুৎ, গ্যাস, ডাক, টেলিযোগাযোগ ইত্যাদি কাজে ব্যবহারের জন্য উল্লেখিত যানবাহন চলাচল নিষেধাজ্ঞার আওতামুক্ত থাকবে। জাতীয় মহাসড়ক (হাইওয়ে), বন্দর ও জরুরি পণ্য সরবরাহসহ অন্যান্য জরুরি প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা শিথিল থাকবে। লঞ্চসহ ইঞ্জিনচালিত সব ধরনের নৌযান চলাচলেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে বলা হয়েছে। সম্প্রতি জেলা প্রশাসক ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়ে নির্দেশনা দিতে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক বিভাগের সচিবকে চিঠি দিয়েছে ইসি।
ইসির ঘোষণা অনুযায়ী প্রথম ধাপে ২২ মার্চ ৭২১টি, ২৩ মার্চ নাগরপুরে ১১টি এবং ২৭ মার্চ টেকনাফের দু’টি ইউপি, দ্বিতীয় ধাপে ৩১ মার্চ, তৃতীয় ধাপে ২৩ এপ্রিল, চতুর্থ ধাপে ৭ মে, পঞ্চম ধাপে ২৮ মে ও ষষ্ঠ ধাপে ৪ জুন ভোট হওয়ার কথা রয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন