শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

অপরিকল্পিত নগরায়ণে চট্টগ্রাম সৌন্দর্য হারাচ্ছে বাড়ছে দুর্ভোগ

শফিউল আলম : | প্রকাশের সময় : ১৫ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

 ‘ইটের পর ইট মাঝে মানুষ কীট, নাইকো ভালবাসা নাইকো খেলা’। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘চয়নিকা’য় শহর-নগরে মানুষের যাপিত জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণা প্রাণময় করে তুলে ধরেছেন। এরই জ্বলন্ত নজির যেন দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত আজকের বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। কর্ণফুলী নদীর তীরে বঙ্গোপসাগরের কিনারায় পাহাড়-টিলায় সুশোভিত চট্টগ্রাম দিন দিন হারিয়ে ফেলছে তার সৌন্দর্য-সুষমা। নগর পরিকল্পনাবিদগণ জানান, অপরিকল্পিত ও সমন্বয়হীন নগরায়নের কারণে চট্টগ্রাম বিভিন্নমুখী সমস্যা-সঙ্কটের মুখে পড়েছে। ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলো নষ্ট ও বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। এতে করে নগরজীবনে দুর্ভোগ প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাণিজ্যিক নগরী হিসেবে গুরুত্বও কমে আসছে। জাতীয় অর্থনৈতিক স্বার্থেই চট্টগ্রামের যথেচ্ছ ও অপরিকল্পিত নগরায়ন বন্ধ হওয়া উচিৎ।
চট্টগ্রামের উন্নয়ন ও সেবা-পরিসেবার সাথে ২২টি সরকারি আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা বা বিভাগের কর্মকান্ড জড়িত। কিন্তু সংস্থা ও বিভাগগুলোর মধ্যকার সমন্বয় নেই। যে যার মতো করে চট্টগ্রামে উন্নয়ন কার্যক্রম চালাচ্ছে। এরমধ্যে চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য দায়বদ্ধ বৃহৎ সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) যেন কোন সমন্বয় ও জবাবদিহিতার গরজ বোধ করছে না। আরও বিভিন্ন সংস্থা তোয়াক্কাহীন কার্যক্রম চালিয়ে নগরীকে বেহাল অবয়বের দিকেই ঠেলে দিয়েছে। দুর্যোগ-প্রবণ হয়ে উঠছে। ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
অপরিকল্পিত ও যথেচ্ছ উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচানার কারণে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ক্রমেই ভারসাম্য হারাচ্ছে। বসবাসের প্রায় অযোগ্য হয়ে উঠছে। চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সুরক্ষা ও ভারসাম্যের জন্য অপরিহার্য হচ্ছে পাহাড়-টিলা, বন-জঙ্গল, নদ-নদী, হ্রদ, জলাশয়, দীঘি, পুকুর, খেলার মাঠ, খোলা জায়গা এবং খাল-ছরা। কিন্তু লাগামহীন তথাকথিত ‘উন্নয়নে’র পরিণতিতে এসব বৈশিষ্ট্য ও অপরূপ নিসর্গ হারিয়ে যেতে বসেছে। নির্বিচারে পাহাড় কেটে-খুঁড়ে ও জলাশয় ভরাট করে ভবন আর বস্তি গড়ে উঠেছে সারি সারি। খাল-ছরা ও নালার উপর ঘরবাড়ি, মার্কেট, দোকান-পাট তৈরি হচ্ছে সবখানেই। চট্টগ্রাম মহানগরী ও শহরতলীর ব্যাপক এলাকা হারিয়ে ফেলছে তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলো। অতীতের সাথে মিলিয়ে চট্টগ্রামকে চেনা দায়। বঙ্গোপসাগরের কোলে-কিনারে, পাহাড়ি খরস্রোতা কর্ণফুলী নদী, সারি সারি পাহাড়-টিলা আর সবুজ বনানী আর সমতলে প্রাচ্যের রাণী খ্যাত চট্টগ্রামের সেই আদি পরিচিত রূপ-নিসর্গ বিলুপ্তির মুখে। এরফলে ভারসাম্যহীন ‘কষ্টের শহর’ হয়ে উঠেছে চট্টগ্রাম। বাড়ছে জনদুভেৃাগ। প্রায় ৬০ লাখ জনসংখ্যার ভার নিয়ে ১২০ বর্গমাইল আয়তনের চট্টগ্রাম মহানগরী এবং আরও সমআয়তনের শহরতলীর এখন বেহালদশা।
বন্দরনগরী চট্টগ্রামে জনস্রোত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে সেই তুলনায় বাড়ছে না আবাসন সংস্থান। এখানে সবকিছুই হচ্ছে অপরিকল্পিতভাবে। বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, সড়ক, পার্ক-বিনোদন, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় মাদরাসাসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, পানি ও পয়ঃবর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থা, গণপরিবহনসহ ন্যুনতম অপরিহার্য নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চল ছাড়াও দেশের সকল প্রান্ত থেকে আয়-রোজগারের জন্য সমুদ্র বন্দর বা বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু এই মহানগরীতে অজস্র মানুষ ছুটে আসছে। তবে নগরায়নে সুবিন্যস্ত পরিকল্পনা ও সমন্বয় না থাকায় কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রগুলো ক্রমাগত সীমিত ও স্থবির হয়ে পড়ছে।
বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি আশিক ইমরান অভিমত ব্যক্ত করেন, চট্টগ্রামের উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে এ অঞ্চলের নিজস্ব ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যসমূহকে গুরুত্বের শীর্ষে রেখেই সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করা অপরিহার্য। একই সাথে প্রয়োজন উন্নয়ন ও সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর সমন্বয়। তবে তা অনেক ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত। অপরিকল্পিত ও সমন্বয়হীন উন্নয়নে চট্টগ্রাম ভারসাম্য হারাবে, নাগরিক দুর্ভোগও বাড়বে। উন্নয়নের জন্য নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে মতামত গ্রহণের বিষয়ে তিনি তাগিদ দেন।
নগর পরিকল্পনাবিদরা জানান, রাজধানী ঢাকার পর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চট্টগ্রাম মহানগরীতে প্রতিনিয়ত ৮ থেকে ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে জনসংখ্যা। প্রতিবছর গড়ে যোগ হচ্ছে অন্তত ৫০ হাজার নবাগত নাগরিক। তাদের জন্য দরকার ১০ থেকে ১২ হাজার ইউনিট অতিরিক্ত ফ্ল্যাট অথবা বসতঘর। এর পাশাপাশি প্রয়োজন পর্যাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা-বাণিজ্যকেন্দ্র, অফিসসহ কর্মক্ষেত্রের মতো হরেক প্রতিষ্ঠান। কমপক্ষে ১২০ হেক্টর ভূমিতে আবাসন ব্যবস্থার চাহিদা তৈরি হচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, সামুদ্রিক বন্দর, শিল্প-কারখানা, পরিবহন, শিক্ষা, প্রশাসনিক সব কাজকর্মের গুরুত্বকে ঘিরে নগরমুখী জনস্রোত বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ইউএনডিপি, গৃহায়ন অধিদফতর, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), সিটি কর্পোরেশন ও পরিবেশ অধিদফতরের বিভিন্ন জরিপ তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী উপরোক্ত চাহিদার চালচিত্র উঠে এসেছে।
চট্টগ্রামজুড়ে যথেচ্ছভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গড়ে উঠছে বাড়িঘর ও হরেক ধরনের স্থাপনা। বিস্তার ঘটছে দোকান-পাট, গুদাম, আড়ত, কল-কারখানা, ওয়ার্কশপ, বাণিজ্য ও বিপণিকেন্দ্রের। ব্রিটিশ শাসনামলের মাঝামাঝি এদেশের অন্যতম প্রাচীন পৌর শহর হিসেবে ১৮৬৩ সালের ২২ জুন ‘দি চিটাগাং মিউনিসিপ্যালটি’র সূচনা হয়। তখন মাত্র ৬ বর্গমাইল আয়তনের ৫টি ওয়ার্ড নিয়ে শহরটি প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা করে। ১৮৬৯ সালের আদম শুমারিতে চট্টগ্রাম শহরে জনসংখ্যা ছিল ১৫ হাজার ৫৯৮ জন। এখন ৪১টি ওয়ার্ড নিয়ে জনসংখ্যা ৫৫ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। চট্টগ্রাম মহানগরীতে প্রতিসপ্তাহে গড়ে প্রায় ২০০ থেকে ২৫০টি নতুন বাড়িঘর নির্মিত হচ্ছে। সিডিএ প্রতিমাসে গড়ে ২শ’ থেকে তিন শ’ নতুন বাড়ি নির্মাণের প্ল্যান অনুমোদন করছে। মহানগরীর মোট ঘরবাড়ির সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৩ লাখ। এরমধ্যে ৩৫ শতাংশ পাকা দালান। তবে এই মহানগরীতে ঝুপড়ি ও বস্তিঘরের সংখ্যা যেমন বাড়ছে তেমনি বহুতল ভবনরাজিও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
অপু ১৫ নভেম্বর, ২০১৭, ২:২৪ এএম says : 0
অপরিকল্পিত নগরায়নের কুফল সরকারকে কে বুঝাবে ?
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন