শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

উপ সম্পাদকীয়

ভাষা আন্দোলনের অঘোষিত মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিক স্মরণে

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ১৬ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

গত মঙ্গলবার ১৪ নভেম্বর চলে গেল ভাষা আন্দোলনের অঘোষিত মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিক-এর ৬৯তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। ১৯৪৮ সালের এই দিন ভাষা আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংস্থা তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবুল কাসেমের উদ্যোগে সাপ্তাহিক সৈনিক-এর যাত্রা শুরু হয়। এর প্রধান সম্পাদক ছিলেন বিশিষ্ট কথাশিল্পী শাহেদ আলী। অন্যতম সম্পাদক ছিলেন এনামুল হক। সৈনিক সম্পাদনার সাথে প্রথম পর্যায়ে আর যারা জড়িত ছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন সানা উল্লাহ নূরী, আবদুল গফুর, মোস্তফা কামাল প্রমুখ। পরবর্তীকালে যারা সৈনিক সম্পাদনার সাথে বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িত হন তাদের মধ্যে ছিলেন হাসান ইকবাল (পরবর্তীতে দৈনিক ইত্তেফাকে-এর সহকারী সম্পাদক), কবি মফিজউদ্দিন আহমদ, দিদারুল আলম খাঁ, ফারুক মাহমুদ, সৈয়দ মোস্তাফা জামাল, আজিজুর রহমান প্রমুখ।
শুরুর দিকে সাপ্তাহিক সৈনিক-এর মুদ্রাকর ও প্রকাশক হিসাবে (অধ্যাপক) মোহাম্মদ আব্দুল কাসেমের নাম ছাপা হলেও ১৯৫১ থেকে ১৯৫৯ পর্যন্ত আবদুল গফুরের নাম ছিল মুদ্রাকর ও প্রকাশক হিসাবে। তবে সৈনিক-এর প্রকাশনা ও সার্বিক ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে বহুদিন পর্যন্ত মূল ভূমিকা পালন করেন তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবুল কাসেম।
সাপ্তাহিক সৈনিক ভাষা আন্দোলন, পূর্ব বাংলার স্বায়ত্ত্বশাসন আন্দোলন, শ্রমিক-কর্মচারীদের আন্দোলন এবং নির্যাতিত মানুষদের দাবীদাওয়ার প্রশ্নে আগাগোড়াই ছিল সোচ্চার। সাপ্তাহিক সৈনিক একই সাথে ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়নের দাবীতেও উচ্চকণ্ঠ ছিল। একই সাথে ইসলাম ও বাংলাভাষার প্রতি সমর্থনদানকে অনেকে সৈনিক-এর মধ্যে স্ববিরোধিতা আবিষ্কার করলে সৈনিকে তাদের পবিত্র কোরআনের সূরা ইবরাহিম-এর চার নম্বর আয়াতের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতো, যেখানে বলা হয়েছে, আল্লাহ কোন রসূলকে তার মাতৃভাষায় ব্যতীত বাণী পাঠাননি, যাতে করে তিনি তাদেরকে সহজে আল্লাহর বাণী বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হন।
একইভাবে যারা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলার দাবীকে পাকিস্তানের সংহতির বিরোধিতা বলে অভিযোগ করতো, সৈনিক তাদের পাকিস্তান আন্দোলনের ভিত্তিরূপী লাহোর প্রস্তাবের মর্মবাণীর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলতো, লাহোর প্রস্তাবেই উপমহাদেশের মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে একাধিক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ছিল। কারণ দেড় মাইলের ব্যবধানে অবস্থিত ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন একাধিক ভূখন্ড নিয়ে একটি রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে প্রায় নেই বললেই চলে। তবে সৈনিক-এর দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যে কোন সংকীর্ণতার স্থান ছিলনা। সৈনিক একই সাথে সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে কলম যুদ্ধ চালাত। সাপ্তাহিক সৈনিক বিভিন্ন সময়ে যেসব বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে তাতেও সৈনিক-এর আদর্শ সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যাবে।
পবিত্র ঈদ, স্বাধীনতা দিবস, মাতৃভাষা দিবস, ঈদে মিলাদুন্নবী প্রভৃতি সংখ্যার পাশাপাশি ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ফারুক (রা:) ও বিপ্লবী সাহাবী হযরত আবুজর গিফারী (রা:) এর ওফাত দিবস উপলক্ষে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে সাপ্তাহিক সৈনিক। সমাজকে দুর্নীতির কলুষমুক্ত করার লক্ষ্যে ১৯৪৯ সালের ৩ জুন প্রকাশ করে দুর্নীতি-বিরোধী সংখ্যা। ১৯৫০ সালে ভারতের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রতিক্রিয়ায় পূর্ববঙ্গে দাঙ্গা পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে ২ এপ্রিল ১৯৫০ তারিখে প্রকাশ করে দাঙ্গা-বিরোধী সংখ্যা। এ সংখ্যায় অন্যান্যদের মধ্যে আসকার ইবনে শাইখ, কাজী ফজলুর রহমান, শওকত ওসমান, সোলায়মান খান, মাহফুজুল হক প্রমুখের লেখা প্রকাশিত হয়। সৈনিক-এর আর একটি উল্লেখযোগ্য বিশেষ সংখ্যা ছিল জমিদারী-বিরোধী সংখ্যা। পুস্তক আকারে প্রকাশিত এ বিশেষ সংখ্যাটিতে বিভিন্ন গবেষনাধর্মী নিবন্ধ, গল্প, নাটক, কবিতা ইত্যাদির মাধ্যমে জমিদারী প্রথার মানবতা বিরোধী স্বরূপ উন্মোচন করে বিনা খেসারতে জমিদারী উচ্ছেদের দাবীর যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়।
সাপ্তাহিক সৈনিক ছিল শিল্পী সাহিত্যিকদের নিজস্ব কাগজ। সাপ্তাহিক সৈনিক-এর সম্পাদনার সাথে যারা জড়িত ছিলেন তারা যেমন এতে কাজের জন্য কোন পারিশ্রমিক নিতেন না, তেমিন সৈনিকে যারা লিখতেন, প্রবীন নবীন তারাও কোন সম্মানী নিতেন না। অথচ এদেশের তৎকালীন প্রায় সকল কবি-সাহিত্যিকই সৈনিক এ লিখেছেন। এদের মধ্যে ছিলেন: ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. কাজী মোতাহার হোসেন, প্রিন্সিপ্যাল ইব্রাহীম খাঁ, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, মওলানা ভাসানী, আবুল মনসুর আহমদ, মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ, কথাশিল্পী মাহবুব-উল আলম, দার্শনিক রাজনীতিক আবুল হাশিম, কবি বেনজীর আহমদ, কবি ফররুখ আহমদ, আহসান হাবীব, আবু রুশদ, হাবীবুর রহমান, শওকত ওসমান, সুফিয়া কামাল, অমিয় চক্রবর্তী, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরাফ, ফেরদৌস খান, মীর শামসুল হুদা, কাজী দীন মুহম্মদ, শামসুল হক, জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, রওশন ইজদানী, শাহেদ আলী, তালিম হোসেন, আবদুল হাই মাশরেকী, অধ্যাপক আবুল কাসেম, নাট্যকার আসকার ইবনে শাইখ, আশরাফ সিদ্দিকী, মীজানুর রহমান, আবদুর রশীদ খান, মুফাকখারুল ইসলাম, সরদার জয়েনউদ্দিন, অধ্যাপক আবু তালেব, শামসুর রাহমান, চৌধুরী ওসমান, রায়হান শরীফ, নুরুন্নাহার, প্রজেশকুমার রায়, মফিজুল্লাহ কবীর, হাসান জামান, অধ্যাপক নাজমুল করিম, নুরুল হোসেন খন্দকার, দৌলতুন্নেছা খাতুন, বজলুর রহমান, মযহারুল ইসলাম, শামসুল হক চৌধুরী, আবদুর রশীদ ওয়াসেকপুরী, মোহাম্মদ আজিজুল হক, চৌধুরী লুৎফর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, আজিজুর রহমান, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, মোহাম্মদ কায়সুল হক, নুরুল ইসলাম পাটোয়ারী, বদরুদ্দীন উমর, মওলানা সাখাওয়াতুল আম্বিয়া, মওলানা আবদুল আলী, হেদায়েতুল ইসলাম খান, গোলাম রসুল, এরশাদ হোসেন, খান মোহাম্মদ আবদুল হাকিম, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, মোজাফফর আহমদ, মনমোহন বর্মন, চৌধুরী শাহাবুদ্দিন খালেদ, আশরাফ ফারুকী, অধ্যাপক খন্দকার তোফাজুল হোসেন, মওলানা মুহিউদ্দীন খান, কবির উদ্দিন আহমদ, আহমদ ফরিদউদ্দিন, মাহফুজ্জল হক, শহীদ আখন্দ, মির্জা আ. মু. আবদুল হাই, আবু ইসহাক, আল মাহমুদ, শামসুল আলম, জাহানারা আরজু, তরীকুল আলম, আনোয়ারা বেগম, চেমন আরা, মোবায়েদুর রহমান, আখতার উল আলম, মোহাম্মদ নুরুল হক, মীর আবুল হোসেন, মোহাম্মদ রিয়াছত আলী, দেওয়ান আবদুল হামিদ, ওমর আলী, সিরাজুল ইসলাম মল্লিক, চৌধুরী হাশমবুল্লাহ প্রমুখ।
সাপ্তাহিক সৈনিক-এর মাষ্টটি এঁকে দেন খ্যাতনামা শিল্পী কামরুল হাসান। বিখ্যাত কার্টুনিষ্ট দোপেয়াজা (কাজী আবুল কাসেম) সৈনিকে-এ বিভিন্ন সমসাময়িক প্রশ্নে নিয়মিত কার্টুন আঁকতেন। অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে সৈনিক-এর প্রকাশনা ১৯৫৮-এর পর থেকে অনেকটাই অনিয়মিত হয়ে যায় এবং এক পর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭০ সালে দেশে স্বাধিকার আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন সৈনিক নব পর্যায়ে পুন:প্রকাশিত হয়। ১৯৭০ সালের ১৪ আগস্ট থেকে নব পর্যায়ে প্রকাশিত সৈনিক-এর সম্পাদক ছিলেন আবদুল গফুর। মুদ্রাকর ও প্রকাশক ছিলেন মোহাম্মদ আবুল কাসেম। সৈনিক-এর নব পর্যায়ের এ আত্ম প্রকাশে শুভেচ্ছা বাণী দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, এডভোকেট এ-এস-এম মোফাখখর আবুল মনসুর আহমদ, পীর মোহসীন উদ্দিন আহমদ (দুদু মিয়া), অধ্যাপক গোলাম আজম, অধ্যাপক আবদুল সাত্তার এবং আরও অনেকে। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ-এর পূর্বে পর্যন্ত সৈনিক এ নব পর্যায়ের প্রকাশনা অব্যাহত ছিল। ২৫ মার্চের ক্রাকডাউনের সময় সৈনিকে-এর ম্যানেজার নুরুর রহমান জামালীকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ধরে নিয়ে গিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ফলে সৈনিক-এর প্রকাশনা পুনরায় বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৭ সালে তমদ্দুন মজলিস পুনরায় সাপ্তাহিক সৈনিক প্রকাশ করে। এ পর্যায়ে মুদ্রাকর ও প্রকাশক ছিলেন মোহাম্মদ আবদুল গফুর। সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন চৌধুরী হাশমতুল্লাহ। অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে অল্পদিন পর পুনরায় সৈনিক বন্ধ হয়ে যায়।
তমদ্দুন মজলিস যে আদর্শবাদী সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলে, তার প্রধান মুখপত্র হিসাবে সাপ্তাহিক সৈনিক-এ যেমন বিভিন্ন সমস্যা কোন রাখ-ডাক না করে তুলে ধরা হতো, তেমনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বিভিন্ন ঘটনারও বলিষ্ঠ বিশ্লেষণ থাকতো। সৈনিক-এ প্রকাশিত বিভিন্ন লেখায় যেমন থাকতো সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদ কবলিত সমাজ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের আহ্বান, তেমনি অসাম্য-বৈষম্য কণ্টকিত সমাজব্যবস্থার পরিবর্তে ইসলামের হারিয়ে যাওয়া সাম্যভ্রাতৃত্বের আদর্শে কীভাবে আধুনিক বিশ্বে শোষণমুক্ত নতুন ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায় তার রূপরেখা তুলে ধরা হত। সমগ্র বিংশ শতাব্দী ধরেই চলে পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে শোষিত, নির্যাতিত মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রাম। এ সংগ্রামের প্রভাব পড়ে বাংলাদেশেও সাপ্তাহিক সৈনিক-এ প্রকাশিত বিভিন্ন লেখায় ইসলামের সাম্য-ভ্রাতৃত্বের হারিয়ে যাওয়া আদর্শের ভিত্তিতে কি ভাবে নতুন করে শোষণহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা যায় তার রূপরেখা সৈনিকে প্রকাশিত বিভিন্ন লেখায় পাওয়া সম্ভব। এখানেই আমাদের জাতীয় জীবনে সাপ্তাহিক সৈনিক-এর অবদান স্মরণ করার সার্থকতা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
হোসাইন মোহাম্মদ জাকি ৩ আগস্ট, ২০২১, ৫:০৫ পিএম says : 0
তথ্যবহুল একটা নিব্ন্ধ। সৈনিক পত্রিকার সেকালের সংখ্যাগুলো সংগ্রহ করতে চাই। কারো জানা থাকলে অনুগ্রহপূর্বক জানাবেন কি?
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন