বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মুক্তাঙ্গন

পাখি কেন গান গায়

প্রকাশের সময় : ২৩ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আবদুর রহমান খান
আমাদের পৃথিবীতে পাখিদের আগমন ঘটেছে মানুষ সৃষ্টির অনেক আগেই। এক বিশাল প্রকৃতি, বিস্তৃত প্রান্তর, গাছপালা, নদীনালা, সমুদ্র, ঝরনা, পাহাড়, বনাঞ্চল আর ফুল-ফলের সমাহার আগে থেকেই তৈরি করা ছিল। মানুষ এসে দেখল সে সুন্দর পৃথিবীতে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে নানা প্রজাতির প্রাণী, পানিতে খেলা করছে নানা জাতের মাছ আর আকাশে উড়ছে কত কত রঙের পাখি। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে মানুষ নানা কাজে লিপ্ত হলেও কেন যেন পাখিকেই ভালবেসে ফেললো। আকাশে পাখিদের উড়তে দেখে মানুষের হিংসে হতো বটে কিন্তু পাখিদের মিষ্টি আওয়াজ মানুষকে আনন্দ দিতে শুরু করেছে সেই প্রথম দিন থেকে।
পাখিরা ডাকে, পখিরা গান গায়, পাখিরা সমবেত সুরে কলতান করে, দল বেঁধে কিচির-মিচির করে। এসব নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। তাইতো পাখিদের সুর আর তাল অনুকরণ করে মানুষ তার নিজের কণ্ঠে গান খুঁজে পায়। সুর যন্ত্রে সুর তোলে। এমনকি পাখিদের অনুকরণ করে উড়োজাহাজ বানিয়ে আকাশে ওড়া থেকে অতি সম্প্রতি ইন্টারনেটে টুইটার বারতা পাঠানোর বিদ্যাও রপ্ত করে ফেলেছে।
পাখিদের কাঠ ঠোকরানোর ছন্দ, পাখা ঝাপটানো বা ঠোঁটের একটানা শব্দের মধ্যেও সুর খুঁজে পাওয়া যায়। তবে, পাখিদের ছন্দবদ্ধ প্রলম্বিত সুরেলা আওয়াজকে পাখির গান বলে চিহ্নিত করেছেন পাখিবিশারদগণ। এ গানের মাধ্যমে পাখিরা তাদের আনুরাগ, প্রেম এবং যৌন মিলনের আকাক্সক্ষা প্রকাশ করে থাকে। তাছাড়া পাখিরা গান গেয়ে তাদের আবাসস্থলের চৌহদ্দি চিহ্নিত করে রাখে যাতে অন্য কেউ তার এলাকায় অনুপ্রবেশ না করে। পাখিরা বিশেষ বিশেষ সময়ে বিশেষ শব্দ করে থাকে। একরকম তীব্র বা তীক্ষè শব্দ করে পাখিরা জানিয়ে দেয় শত্রুর আগমন বার্তা। পাখিদের বাচ্চারা বা অন্য গোত্রের পাখিরাও সে সময় সতর্ক হয়ে যায়। শত্রু বা শিকারি পাখিদের দ্বারা আক্রান্ত হলে পাখিরা বিপদের সঙ্কেত দিয়ে শব্দ করে অন্যদের সতর্ক করার পাশাপাশি শত্রুর প্রতি দলবদ্ধভাবে আক্রমণ পরিচালনা করে থাকে। পাখি বিশারদ চার্লস ডারউইন বলেছেন পাখিদের কণ্ঠনালিতে সিরিঙ্কস নামক যন্ত্রটি একরকম কম্পন থেকে শব্দ তরঙ্গ সৃষ্টি করে। এ যন্ত্রের সাহায্যে পাখি একসাথে একাধিক শব্দ তরঙ্গ সৃষ্টি করতে পারে। সিরিঙ্কসের সাহায্যে তোতা বা ময়না পাখি মানুষের কথাও অনুকরণ করতে পারে।
কোনো কোনো পাখির জোড়া দ্বৈত সুরে এমনভাবে শব্দ তৈরি করে যেন মনে হবে একই পাখি গাইছে। কোনো কোনো প্রজাতির পেঁচা, টিয়া এবং কোয়েল এ রকম দ্বৈত সংগীত পরিবেশন করে থাকে। পাখিদের সুর আর শব্দকে চিহ্নিত করে আমরা পাখির নাম দিয়েছি, ‘বউ কথা কও’, ‘চোখ গেল’, ‘পিউ কাঁহা’, ‘রাত পোহা’ এসব।
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, বিশ্বের প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির পাখির মধ্যে অর্ধেক পাখি গান গায়। তবে বড় পাখিদের চেয়ে ছোট পাখিরাই গান গায় বেশি। তা ছাড়া পাখিদের প্রজাতিভেদে গানের বা শব্দের তীব্রতা বা সুরের মাধুর্য কম-বেশি হয়ে থাকে।
গানের পাখিদের স্বভাব-আচরণ এসব অনেক দিন ধরে পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞানীরা দেখতে পান যে, এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার নাতিশীতোষ্ণ ম-লীয় অঞ্চল পাখিদের বসবাসের প্রকৃতি, খাদ্যের সংস্থান এবং আবহাওয়া খুবই উপযোগী। এ অঞ্চলে নানা রঙের নানা প্রজাতির পাখি পাওয়া যায়। এ অঞ্চলে পাখিদের বংশবৃদ্ধিও বেশী হয়ে থাকে। এসব অঞ্চলে পুরুষ পাখিরা গান গায় প্রধানত মেয়ে পাখির মন ভোলাতে।
তবে আফ্রিকার উষ্ণ বা মরু অঞ্চলের গান গাওয়া পাখিদের মধ্যে মেয়ে পাখি বা পুরুষ পাখিদের সংখ্যা প্রায় সমান সমান। এখানে বৈরী আবহাওয়া বা খাদ্যের অভাবের কারণে পাখিদের বংশবৃদ্ধি হয় কম।
ওদিকে, অস্ট্রেলিয়া বা উত্তর আমেরিকার উষ্ণ অঞ্চলে পাখিরা বেশি দিন বাঁচে। এদের মধ্যে মেয়ে পাখি বেশি গান গায়। তারা একটি পুরুষ পাখির সাথে সারা জীবন কাটিয়ে দেয়া পছন্দ করে। তাই গান গেয়ে পুরুষ পাখিটিকে ভুলিয়ে রাখে। পাখি বিশারদ্গণ তাদের পর্যবেক্ষণে দেখতে পায়েছেন, যৌনতার আবেদন নিয়ে সুস্থ সবল পুরুষ পাখি গান গেয়ে মেয়ে পাখিদের কাছে ডাকে এবং ইতিবাচক সারা পেলে তাকে নিয়ে বাসা বাঁধে। এরপর যৌন মিলনের আনন্দ, ডিম পারা, ডিমে তা দেয়া, বাচ্চা ফোটানো এবং বাচ্চা বড় করা পর্যন্ত এক সাথে মিলে মিশে থাকে। মেয়ে পাখিটি যখন বাসায় ডিম পাড়ে এবং ডিমে তা দেয়ায় ব্যস্ত সে সময়টাতে পুরুষ পাখিটি কাছের ডালে বসে মেয়েটিকে গান শোনায়। খাবার এনে দেয়। কখনও বা মেয়ে পাখি বাসা ছেড়ে খাবার খেতে গেলে পুরুষটি ডিমে তা দেয়। বাচ্চা ফোটার পর পুরুষ পাখি আনন্দে গান গায়। যেন গর্বিত পিতা ঘোষণা করছে, দেখ আমাদের কী সুন্দর ফুটফুটে বাচ্চা হয়েছে। আবার যদি ডিম না ফোটে, তাহলে পুরুষ পাখিটি পাশের ডালে চুপচাপ বসে থাকে কয়েকদিন ধরে। যেন নিজের পুরুষত্বকে ধিক্কার দিচ্ছে বা শোক পালন করছে।
পাখির বাচ্চারা তাদের বাসায় থাকা অবস্থায় বাবা বা মায়ের গান শুনে সুর নকল করতে চেষ্টা করে। আস্তে আস্তে দু’তিন সপ্তাহের মধ্যেই সুর রপ্ত করে ফেলে। এরপর নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে নিজের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সুরটা আয়ত্ব করে নেয়।
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, নদীর ধারে, বনবাদারে, পাহাড়ে বা সমতলে পাখিদের আবাসস্থল ভেদে একই প্রজাতির পাখিদের মধ্যেও সুরের রকম ভেদ বা আঞ্চলিকতার টান সৃষ্টি হয়ে থাকে। পাখিদের বাসস্থান বা তার প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে ধরে এনে আলাদা একা রেখে দিলেও পাখি গান গায়। তবে তা বনের মুক্ত পাখিদের মতো সুমিষ্ট এবং সুরেলা হয় না। সঙ্গীত বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন, মানুষের সঙ্গীতের বিকাশে পাখিদের প্রকৃতিজাত সুরের একটা বিরাট প্রভাব রয়েছে। অনেক সঙ্গীত শিল্পী তাদের বাজনায় পাখিদের সুর অনুকরণ করেছেন। যেমন বেথোফেন, ওয়াগ্নার, পল উইন্টার, ভিভালদি প্রমুখ।
পাখি বিশারদ ডেভিড রথেনবার্গ দেখেছেন, পাখিদের শব্দ সঙ্গীতের মতো মনে হয়। শুধু তাই নয়, মানুষের গানের যে সুর বা তাল ও লয় সেসব পাখিদের মধ্যে আছে। তা হলে দেখা যাচ্ছে মানুষ পাখিদের কাছ থেকেই গান শিখেছে। কারণ পাখিরাই পৃথিবীতে আগে এসেছে।
দীর্ঘ পর্যবেক্ষণে মানুষ দেখতে পেয়েছে, পাখিরা সবেচেয়ে বেশি গান গায় প্রত্যুষে। যখন রাতের আকাশ ফিকে হয়ে আসে, সকালের সূর্য উঠবে এমন সময়টাতে নানা জাতের সব পাখি বনবাদার মাতিয়ে সমবেত কণ্ঠে গান ধরে। পাখিদের কলকালিতে ভরে ওঠে প্রকৃতি। সবাই যার যার সুর আর তাল নিয়ে যেন ভোরের আগমনে আনন্দ উল্লাস করছে একসাথে।
সুফি বা আধ্যাত্মিক সাধকগণ এমন ব্যাপারটিকে সৃষ্টি কর্তার প্রতি পাখিদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ হিসেবে দেখতে পান। তারা মনে করেন, স্রষ্টা তাঁর স্বর্গে এবং মাটির পৃথিবীতে পাখিদের সৃষ্টি করেছেন তাঁর প্রশস্তি উচ্চ স্বরে প্রকাশ করার জন্য। আর যখন রাতের গহ্বর থেকে একটি নতুন দিনের জন্ম হয় সেই প্রত্যুষে নীরব সময়টিতে পাখিরা স্রষ্টার সেই প্রশংসায় সমবেত হয়।
এ নতুন দিনটিতে পাখিরা একা বা সঙ্গীদের নিয়ে নতুন করে খাবারের সন্ধানে বের হবে। নতুন দিনের গানে নতুন সঙ্গী খুঁজবে। নতুন করে বাসা বাঁধবে। আবার বাচ্চাদের গান শেখাবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন