দেশে পানির ভয়াবহ সংকট দেখা দিয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার দেশের বেশ কয়েকটি দৈনিকে পরিবেশিত খবরে বলা হয়েছে, শুধু রাজধানী নয়, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এখন সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। বর্তমানে মিঠা পানি ব্যবহারে অযোগ্য হওয়ার কারণে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার শুরু করলেও দেখা যাচ্ছে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বিপদসীমার কাছাকাছি চলে এসেছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর ও ময়মনসিংহের শিল্পাঞ্চলের পানির ব্যাবহার নিয়ে করা ব্রিটিশ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্যে এ কথা বলা হয়েছে। বাংলদেশের পানিসম্পদের সুশাসন নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন রিপোর্টে বলা হয়েছে, শিল্পকারখানাগুলোয় বর্তমান পানি ব্যবহার অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে শুধু ঢাকা নগরে পানির চাহিদা আড়াই গুণ বৃদ্ধি পাবে। এতে পানি ব্যবস্থাপনা বাবদ খরচ করতে হবে ৭০০ কোটি টাকা। প্রকাশিত অন্য খবরে বলা হয়েছে, মানবসৃষ্ট পানিদূষণে ক্রমবর্ধমান মাত্রা আঘাত হেনেছে ভূগর্ভস্থ স্তরেও। উপরিভাগের নির্বিচার পরিবেশ বিনষ্টকারীদের ছোবলের কারণে সুপেয় পানির সর্বশেষ আধার ভূগর্ভস্থ পানিও ক্রমেই বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর চারপাশে থাকা নদীগুলো ৬২ ধরনের রাসায়নিক বর্জ্য মিশে বিষাক্ত জলাধারে পরিণত হয়েছে। বুড়িগঙ্গার তলদেশে জমেছে পলিথিনের স্তর। বুড়িগঙ্গার দূষণ এরই মধ্যে মুন্সীগঞ্জের মোহনা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। নগর, হাওর, উপকূল, পাহাড়ি ও চরাঞ্চল শীর্ষক গবেষণা প্রবন্ধে ওয়াটার এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ বলেছেন, আসলে সুপেয় পানি পাওয়ার ক্ষেত্রে শহরবাসীর ভাগ্যই ভালো, রাষ্ট্রের নেক নজর বেশি। সুপেয় পানি শহরে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে সরকারের আন্তরিকতার পাশাপাশি বরাদ্দও বাড়ে প্রতিবছর। এদিকে অন্য দৈনিকের খবরে বলা হয়েছে, দেশের বরেন্দ্র এলাকার নারীরা গৃহস্থালি কাজে শুধু পানির জন্য দিনে সোয়া সাত ঘণ্টা ব্যয় করছেন। পানি সংগ্রহ সংরক্ষণ ও ব্যবহার বাবদ তারা এই সময় ব্যয় করেন।
পানি সংকট এখন দৃশ্যমান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবমতে, নদীমাতৃক বাংলাদেশে সাড়ে নয় কোটি মানুষ বিশুদ্ধ পানি ব্যাবহার করতে পারছে না। সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশের মানুষ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বিশুদ্ধ পানির অভাব এবং মৌসুমভেদে পানি সংকটের কারণে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিঘিœত হচ্ছে। শিল্পায়ন ও কৃষিকাজও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বলা হচ্ছে, দূষিত পানি পান করার কারণে সম্প্রতি ভয়াবহ আকারে বেড়েছে পানিবাহিত রোগ। বিশেষজ্ঞ ডাক্তাদের অভিমত,দ দূষিত পানি দীর্ঘদিন পান করতে থাকলে আরো জটিল রোগ এমনকি মারণব্যাধি ক্যান্সারও হতে পারে। খোদ রাজধানীতেই সুপেয় পানির তীব্র সংকট চলছে। ওয়াসার সরবরাহ করা পানি চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। এদিকে নদীর পানিকে উৎস করে পাঁচটি শোধনাগার নির্মাণের কথা থাকলেও চালু হয়েছে সায়েদাবাদে একটি শোধনাগারের দুটি পর্যায়। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশে পানি সংকটের মূল কারণ হচ্ছে প্রতিবেশীর বৈরী পানিনীতি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভারত ৪০ বছর ধরে আন্তর্জাতিক নদীর ওপর বাঁধ দিয়ে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নেয়ার কারণেই বাংলাদেশ দিন দিন পানিশূন্য হয়ে যাচ্ছে। এখন তা বিপর্যয়কর বাস্তবতায় উপনীত হয়েছে। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথের মধ্যে হারিয়ে গেছে ২০ হাজার ৪শ’ কিলোমিটার। শুষ্ক মৌসুম এলেই দেশের প্রধান নদ-নদীসহ খালবিল শুকিয়ে যাচ্ছে। দিন দিনই দেশ মরুময়তার দিকে যাচ্ছে। নদ-নদী, খাল-বিল শুকিয়ে যাওয়ার এই নির্মম বাস্তবতা সকলে প্রত্যক্ষ করলেও নদী তথা দেশ বাঁচানোর কোনো তাগিদ কোথাও রয়েছে, তা অন্তত দেখে-শুনে মনে হয় না।
পানির অপর নাম জীবন। পানি না থাকলে কৃষি অর্থনীতি-পরিবেষ্টিত সবকিছুই বিপন্ন হয়ে পড়বে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ মেটাতে যখন পানির সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে উঠেছে, তখন দেখা যাচ্ছে পানিহীন হয়ে পড়তে যাচ্ছে দেশ। অনেকদিন থেকেই পানি ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্ব দিয়ে আসছে দেশের সচেতন মহল। এটাও বারবার বলা হচ্ছে গঙ্গাবাঁধ দেয়া ছাড়া পানি সমস্যার কার্যকর সমাধান করা প্রায় অসম্ভব। তা সত্ত্বেও পানি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নদ-নদীর তীর সংরক্ষণ, ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা এবং বর্ষার পানি ধরে রাখার জন্য বিশেষজ্ঞ মহল গুরুত্ব দিয়ে আসছে। এসবের কোনো কোনো ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্ত থাকা সত্ত্বেও এযাবৎকাল কার্যকর কোনো উন্নতি হয়নি। বরং দেখা যাচ্ছে, এসব কর্মসূচির নামে টাকা লোপাট হচ্ছে। প্রকৃত বিবেচনায় পানি আনার ব্যাপারে যে ধরনের কূটনীতি বা দর কষাকষি করা দরকার সরকার তাতে অনেকটাই সফল হতে পারেনি। কার্যত তারই মাশুল দিচ্ছে জনগণ। জনস্বার্থ রক্ষায় কোনো ধরনের সংকীর্ণনতাই কাম্য নয়। ব্যাপারটিকে কোনো দলের একক করণীয় বলে মনে করারও কোনো কারণ নেই। দলমত নির্বিশেষে পানির চাহিদা রয়েছে। পানি না থাকলে দেশ বাঁচবে না। ভারতীয় স্বার্থ রক্ষার্থে আমরা ভারতকে যতটা সুবিধা দিয়েছি, বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থ রক্ষার্থে তার একাংশও আদায় করতে ব্যর্থ হয়েছি। পানি সংকট এখন আলোচনার পর্যায়ে নেই। পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে যা কিছু করণীয় তার সবটাই করা জরুরি হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে পানি বিশেষ করে সুপেয় পানির যে সংকটের কথা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উল্লেখ করেছে, তাকে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। জাতিসংঘ থেকেই আগেই হুশিয়ার করে দেয়া হয়েছে তৃতীয় বিশযুদ্ধ পানি নিয়ে হতে পারে। এখনই আমাদের পরিপূর্ণ সতর্ক ও সচেতন হওয়ার সময় এসেছে। সংশ্লিষ্টরা সমস্যার গভীরতা ও গুরুত্ব অনুধাবনে সক্ষম হবেনÑএটাই জনগণ প্রত্যাশা করে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন