ইসলাম আল্লাহর মনোনীত একমাত্র পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা হিসাবে জীবনের সব ক্ষেত্রের মতো ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও কল্যাণও অকল্যাণের বিষয়গুলো স্পষ্ট করে বর্ণনা করেছে। ব্যবসা সম্পর্কে আল কুরআনের মৌলিক কথা হলো: ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরস্পরের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। তবে ব্যবসা করবে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে এবং কখনো (স্বার্থের কারণে) একে অপরকে হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি অত্যন্ত মেহেরবান।’ (আল-কুরআন, সূরা আন্ নিসা, আয়াত ২৯।) ‘আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম।’ (আল কুরআন, সূরা বাকারা, আয়াত ২৭৫।) আদর্শ ইসলামী শাসনের যুগে ক্রয়-বিক্রয় ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আল্লাহর দেয়া বিধি-বিধান পুরোপুরি মেনে চলা হতো। ফলে সেখানে বর্তমান যুগের ন্যায় বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষতার উন্মেষ না ঘটলেও সমাজের সর্বস্তরে কল্যাণের বারিধারা প্রবাহিত ছিল। বর্তমান বিজ্ঞান ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সমাজ-সভ্যতার সকল ক্ষেত্রকে দশ কদম এগিয়ে দিলেও, অনৈতিক কর্মকান্ড আমাদেরকে আজো পিছনের মজবুত খুঁটিতে বেঁধে রেখেছে। দুর্নীতি ও দুরাচার আমাদের পিছু ছাড়ছে না। বিশেষত বাংলাদেশে এ সংকট আরো প্রকট। নৈতিকতার মত মৌল উপাদানকে বিজ্ঞানের সাথে যুক্ত করার সুপারিশ করা যেতে পারে। কারণ নৈতিকতাহীন বিজ্ঞান পৃথিবীকে নৈরাজ্যের দিকেই ঠেলে দিয়েছে।
এখানে ক্রয়-বিক্রয় বা ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত বিধি-বিধান বর্ণনা করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। কারণ আলহামদুলিল্লাহ ক্রয়-বিক্রয় ও ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত অনেক বই-পুস্তক বাজারে এসেছে। আমাদের দৈনন্দিন ক্রয়-বিক্রয় ও ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কিছু নৈতিক বিষয় তুলে ধরাই মূল লক্ষ্য, যেগুলোকে আমাদের ব্যবসায়ীরা কোন ক্ষেত্রে কম গুরুত্ব দেন আবার কোনো ক্ষেত্রে আদৌ গুরুত্ব দেন না। বাংলাদেশ সহ সারাবিশ্বে ইসলামী ব্যাংকিং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা করেছে তার প্রেক্ষিতে ইসলামী অর্থনীতি সম্পর্কে আরো বেশি করে জানার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে। আলহামদুলিল্লাহ ইসলামী অর্থনীতিবিদগণ বসে নেই, চাহিদার পাশাপাশি ইসলামী শরীয়ার আলোকে তাঁরা তথ্যের যোগান দিয়ে যাচ্ছেন। অর্থনীতি আগাগোড়া একটি ব্যবহারিক বিষয়। সাধারণ অর্থনীতির বিষয়াবলীকে ইসলামের আলোকে ঢেলে সাজানো, আধুনিক সমস্যার সমাধান বা পর্যালাচনা করতে গিয়ে ইসিলামী অর্থনীতিও সাধারণের জন্য কিছুটা জটিল রূপ ধারণ করেছে। ফলে সে সমস্ত জটিল বিষয়ের আলোকে যুগ যুগ ধরে চলে আসা ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নৈতিক কর্মকান্ডগুলো ইসলামের আলোকে চিহ্নিত করাও কষ্ট সাধ্য ব্যাপার। ইসলামী অর্থনীতির এক বিরাট অধ্যায় হলো ক্রয়-বিক্রয় (ইুঁরহম ্ ঝবষষরহম)। একে ইসলামী অর্থনীতির ভিত্তিই বলা চলে। কারণ ট্রেডিশনাল অর্থনীতির ভিত্তি যদি সুদ হয় এবং একে ঘিরেই তা আবর্তিত হয়, তবে ইসলামী অর্থনীতির ভিত্তি ক্রয়-বিক্রয় (ইুঁরহম ্ ঝবষষরহম)-কে ঘিরে আবর্তিত হওয়াই স্বাভাবিক।
ক্রয় বিক্রয়ের সংজ্ঞা ও পরিচিতি : ‘ব্যয়’ শব্দটি দুই বিপরীত অর্থবোধক তথা ক্রয়-বিক্রয় উভয় অর্থেই ব্যবহৃত হয়। যেমন ইবনে উমর রা. নবী স. থেকে বর্ণনা করেন; ‘তোমাদের কেউ যেন অন্য কারো ক্রয়ের উপর ক্রয় না করে।’ (জামে তিরমিযী ও হাকিম।) তবে ‘ব্যয়’ এর প্রকৃত অর্থ বিক্রয়। কারণ ক্রয়ের জন্য ‘শিরা’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। (আল মাওদুআতুল ফিকহিয়্যা, ১ম খÐ ১ম সং, কুয়েত ১৪০৭ হি।) প্রকৃতপক্ষে যেখানে ক্রয় সেখানেই বিক্রয়, আর যেখানে বিক্রয় সেখানে ক্রয়। কারণ যে ক্রয় করেছে তার নিকট আর একজন বিক্রয় করেছে এবং যে বিক্রয় করেছে তার কাছ থেকে আর একজন ক্রয় করেছে। সুতরাং ‘ব্যয়’ উভয় অর্থই বোঝাবে। ব্যয় ও শিরা এর শাব্দিক অর্থ হলো: একটি জিনিসকে অন্য জিনিসের সাথে বিনিময় করা। হানাফী মাযহাব মতে এর পারিভাষিক অর্থ হলো ‘কাউকে একটি মালের বিনিময়ে অন্য মালের মালিক বানিয়ে দেয়া।’ অন্য মতে ‘পারস্পরিক সম্মতিক্রমে একটি মালকে অন্য মালের সাথে বিনিময় করা। (হিদায়া, বুযু পর্ব, বুরহানুদ্দীন মারগীনানী (রঃ)।) অন্য মতে ‘একজনের মাল অপরজনের মালের সাথে পারস্পরিক স্বেচ্ছা সম্মতির ভিত্তিতে বিনিময় করাকে ক্রয়-বিক্রয় বলে।’ (আলমগীরী ৩য় খÐ।) ফিকহের গ্রন্থাবলীতে ‘কিতাবুল বুয়ূ’ বলতে পণ্যের ক্রয়-বিক্রয়, শিল্প-উৎপাদন ও বাণিজ্যিক লেনদেন সবকিছুকেই বুঝায়। (ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত মাস্লা-মাসায়েল, সম্পাদনা পরিষদ, ইফারা প্রকাশন, মে-২০০৫।)
ব্যবসা-বাণিজ্য : আরবী তিজারাত পরিভাষাটি বহুল প্রচলিত একটি শব্দ, যার অর্থ ব্যবসা-বাণিজ্য। আল কুরআনের আট-নয়টি আয়াতে শব্দটির উল্লেখ আছে। ইমাম রাগিবের ব্যাখ্যায় শব্দটির অর্থ করা হয়েছে ‘মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে মূলধন বিনিয়োগ ও ব্যবহার করা। (মুফরাদাত, ইমামরাগিব ইস্পাহনী।) ক্রয়-বিক্রয়ের প্রক্রিয়াকে মূলত তিজারাত বলা হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারা হিদায়াতের বিনিময়ে ভ্রষ্টতা ক্রয় করেছে। ফলে তাদের ব্যবসা মোটেই লাভজনক হয়নি। এরা সুপথপ্রাপ্ত নয়।’ (আল কুরআন, সূরা বাকারা, আয়াত-১৬।) উল্লেখিত আয়াতে হিদায়াত ও ভ্রষ্টতাকে পণ্য ও মূল্য বলা হয়েছে এবং এ কর্মটিকে তিজারাত বলা হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যকে আল্লাহ তাআলা হালাল করেছেন এবং এটিকে আয়-উপার্জনের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা পরস্পরের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। তবে পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসা-বাণিজ্য অনুমোদিত এবং কখনো একে অপরকে হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি অত্যন্ত মেহেরবান।’ (আল-কুরআন, সূরা আন্ নিসা, আয়াত ২৯।) ‘আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম।’ (আল কুরআন, সূরা বাকারা, আয়াত ২৭৫।)
ব্যবসা-বাণিজ্যে হালাল-হারাম : পূর্বেই বলা হয়েছে যে, মানুষের জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হলো ক্রয়-বিক্রয় ও ব্যবসা-বাণিজ্য। এ কারণে পবিত্র কুরআন ও হাদীসে এর উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু আজ মানুষ বিশেষত মুসলমানরা এ হালাল ব্যবসার সাথে বিভিন্নভাবে হারামের মিশ্রণ ঘটিয়েছে। খাদ্যদ্রব্যসহ অন্যান্য জিনিসে ভেজাল মেশানো, মজুদদারীর মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ফায়েদা লুটা, প্রতারণাপূর্ণ দালালীর মাধ্যমে উচ্চ দাম হাঁকা, মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের নিমিত্ত লোভনীয় বিজ্ঞাপন ও কৃত্রিম উপায় অবলম্বন করা, মিথ্যা শপথ করা, বিক্রিত মালের দোষ ত্রæটি গোপন করা, ঙাবৎ ও ঁহফবৎ রহাড়রপরহম এর মাধ্যমে ফায়েদা হাসিল করা, বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে উঁঃু, ঠধঃ না দেয়া, চোরাই কারবার করা, সরকারের প্রাপ্য কর ফাঁকি দেয়া, মাপে বা ওজনে কারচুপি করা ইত্যাদি সকল প্রকার অপকৌশল আল কুরআন ও হাদীসের আলোকে অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ এর অন্তর্ভুক্ত। মাপে কারচুপির ব্যাপারে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘ধ্বংস তাদের জন্য যারা মাপে কম দেয়। তাদের অবস্থা এই যে, লোকদের থেকে নেবার সময় পুরো মাত্রায় নেয় এবং তাদেরকে ওজন করে বা মেপে দেবার সময় কম দেয়। এরা কি চিন্তা করে না, একটি মহাদিবসে এদেরকে উঠানো হবে?’ (আল কুরআন, সূরা আর মুতাফফিফীন, আয়াত ১-৬।)
এছাড়া কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে ওজনে ও মাপে কারচুপি করার কঠোর নিন্দা করা হয়েছে এবং সঠিকভাবে ওজন ও পরিমাপ করার জন্য কড়া তাগিদ দেয়া হয়েছে। সুরা আনআম এ বলা হয়েছে, ‘ইনসাফ সহকারে পুরো মাত্রায় ওজনও পরিমাপ করো। আমি কাউকে তার সামর্থের চাইতে বেশির জন্য দায়িত্বশীল করি না।’ আয়াত ১৫২। সূরা বণী ইসরাঈলে বলা হয়েছে, ‘মাপার সময়পুরো মাপবে এবং সঠিক পাল্লা দিয়ে ওজন করবে।’ (আয়াত ৩৫।) সূরা আর রহমানে তাকীদ করা হয়েছে: ওজনে কারচুপি করো না, ঠিক ঠিকভাবে ইনসাফের সাথে ওজন করো এবং পাল্লায় কম করে দিয়ো না।’ (আয়াত ৮-৯।) মাপে কম-বেশী করার জন্য হযরত শো’আইব আ. এর স¤প্রদায় আল্লাহর গযবে নিপতিত হয়।
প্রতারণাপূর্ণ বিভিন্ন ব্যবসা সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল স. এর বাণী নিম্নরূপ :
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত। এক ব্যক্তি নবী স. এর নিকট বললো যে, ক্রয় বিক্রয়ে সে প্রতারিত হয়। তিনি বললেন, যখন তুমি খরিদ করবে তখন বলবে, যেন ধোঁকা না দেয়া হয়।’ (সহীহ্ বুখারী।) আবু হুরায়রা রা. বলেছেন, আমি রাসুলুল্লাহ স.-কে বলতে শুনেছি: ‘মিথ্যা শপথের দ্বারা পণ্য সামগ্রী বিক্রি হয়ে যায় বটে কিন্তু এতে বরকত বা কল্যাণ লুপ্ত হয়ে যায়।’ (সহীহ্ বুখারী।)
আবদুল্লাহ ইবনে আবু আওফা রা. হতে বর্ণিত। ‘এক ব্যক্তি তার পণ্যদ্রব্য বিক্রির জন্য বাজারে নিয়ে মুসলমানদের ফাঁকি দেয়ার জন্য আল্লাহর নামে শপথ করে এবং বলে ঐ মাল সে যত দামে কিনেছে তা এখনও কেউ বলেনি। তখন এ আয়াত নাযিল হয় : ‘যারা আল্লাহর সাথে কৃত চুক্তি ও নিজেদের শপথ তুচ্ছ মূল্যে বিক্রয় করে।’ (সহীহ্ বুখারী।) হযরত উমর রা. বলেছেন, ‘নবী স. প্রতারণাপূর্ণ দালালী করতে নিষেধ করেছেন। (সহীহ্ বুখারী।) হাকীম ইবনে হিযাম রা. থেকে বর্ণিত। নবী স. বলেছেন, ‘ক্রেতা ও বিক্রেতা ক্রয়-বিক্রয় শেষে পরস্পর বিচ্ছিন্ন না হওয়া পর্যন্ত ক্রয়-বিক্রয় বাতিল করার এখতিয়ার থাকে। যদি তারা উভয়ে সত্য কথা বলে এবং দোষ বর্ণনা করে, তাহলে এ ক্রয়-বিক্রয়ে উভয়কেই বরকত দান করা হয়। কিন্তু যদি মিথ্যা কথা বলে ও দোষ গোপন করে, তাহলে তাদের ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’ “সহীহ্ বুখারী।” আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত। নবী স. বলেছেন, ‘তোমরা (বিক্রয়ের পূর্বে) উষ্ট্রীও বকরীর বাঁটে দুধ জমিয়ে রেখো না।’ (সহীহ্ বুখারী) হারাম দ্রব্য যা মানুষের সার্বিক ক্ষতি সাধন করে সেগুলোর ব্যবসা করা এ অন্যায়ের অন্তর্ভুক্ত। যেখানে অপর ব্যক্তি, পক্ষ, গোষ্ঠী, সমাজ ও দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা অবশ্যই কুরআন-হাদীসের আলোকে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার অন্তর্ভুক্ত হবে।
ব্যবসার গুরুত্ব ঃ ক্রয়-বিক্রয়, ব্যবসা-বাণিজ্য, উৎপাদন ওবণ্টন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মানুষের গোটা জীবনের এক বিশাল অংশ দখল করে আছে এবং তা মানুষের জীবনকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে থাকে। তাই ইসলামী অর্থনীতিতে ব্যবসায়ের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ বাঁচার জন্য মানুষের রিযিকের প্রয়োজন। এ রিযিক পৃথিবীতে সংগ্রাম করে আহরণ করতে হবে। রিযিক আহরণের জন্য মানুষকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিভিন্ন পেশা গ্রহণ করতে হয়। তাছাড়া পণ্য দ্রব্যাদির আদান-প্রদান এমন একটি প্রয়োজন, যা না হলে মানব জীবন অচল হয়ে পড়ে। কারণ আমার নিকট যা আছে অন্যের নিকট তা নাই, আবার আমার যা নাই তা অন্যের নিকট আছে। তাই পারস্পরিক বিনিময়ের জন্য ইসলামী শরীয়ত ক্রয়-বিক্রয়কে জায়েয ঘোষণা করেছে। (চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন