এ, কে, এম, ফজলুর রহমান
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
মানুষের হায়াত বা জীবন পরিক্রমা খুবই দীর্ঘ। এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমাকে আয়েম্মায়ে মুজতাহেদীন পাঁচটি ভাগে বিভক্ত করে বিশ্লেষণ করেছেন। প্রথমত, নূরানী হায়াত বা নূরানী জীবন। এই জীবনের সীমা-পরিসীমা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না। দ্বিতীয়ত, রূহানী জীবন। নূর হতে রূহে রূপান্তরিত জীবন। এই জীবনের সীমা-পরিসীমাও মানুষের জানার বাইরে। এ সম্পর্কে আল্লাহই ভালো জানেন। তৃতীয়ত, হায়াতুদ দুনিয়া বা দুনিয়ার জীবন বা পার্থিব জীবন বা জাগতিক জীবন। এই জীবনের শুরু হয় তখন যখন মাতৃজঠরে ভ্রƒণ একশত বিশ দিন অবস্থান গ্রহণের পর পরিচ্ছন্ন হয় ও তাতে রূহ সঞ্চার করা হয়। এই জীবনের শেষ প্রান্ত হচ্ছে মৃত্যু। চতুর্থত, বরযখী জীবন। এ জীবন কবরে অবস্থান হতে হাশরে উত্থান পর্যন্ত দীর্ঘ। উহার পরিসীমাও মানুষের জানা নেই। পঞ্চমত, আখেরাতের অনন্ত জীবন। এর কোনো শেষ নেই, ইতি নেই।
আল কোরআনে হায়াত (জীবন) শব্দটি ৭১ বার এসেছে। সম্বন্ধপদ ‘হায়াতি কুম’ রূপে এসেছে একবার। সম্বন্ধপদ ‘হায়াতুনা’ রূপে এসেছে তিনবার। সম্বন্ধপদ ‘লি হায়াতি’ রূপে এসেছে একবার। আর ‘আল হায়াত্তয়ান’ রূপে এসেছে একবার। মোটকথা মহান রাব্বুল আলামিন ৭৭ বার হায়াত বা জীবন প্রসঙ্গটি আল কোরআনে উল্লেখ করেছেন। হায়াত বা জীবনই হচ্ছে সৃষ্টিকুলের আসল উপাদান। এই উপাদানকে কেন্দ্র করেই প্রতিটি সৃষ্টি নিজ নিজ উদ্দেশ্য পূরণের জন্য কাজ করে এবং লক্ষ্য ও অভীষ্টের দিকে এগিয়ে যায়। হায়াত বা জীবনের মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে জীবকুলের যাবতীয় কর্মকা- বন্ধ হয়ে যায়। তাই পবিত্র কোরআনুল কারিম হায়াত বা জীবন সম্পর্কে সে দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। সর্বাগ্রে সেদিকে নজর দেয়া উচিত বলে আমরা মনে করি। আর আমরা এ কথাও বিশ্বাস করি যে, হায়াত বা জীবনের আসল অর্থ আল কোরআনুল কারিম হতেই উদ্ধার করা সহজতর হবে। আসুন, এবার সেদিকে লক্ষ করা যাক।
পরম কৌশলী ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত কোরআনুল কারিমে ইরশাদ করেছেন :
১। ইরশাদ হয়েছে : সুতরাং তোমাদের যারা এরূপ (কোরআনের কিছু অংশে বিশ্বাস ও কিছু অংশে অবিশ্বাস) করে তাদের একমাত্র প্রতিফল দুনিয়ার জীবনে হীনতা এবং কিয়ামতের দিন তারা কঠিনতম শাস্তির দিকে নিক্ষিপ্ত হবে। (সূরা বাকারাহ : আয়াত- ৮৫, রুকু-১০)। এই আয়াতে ‘হায়াতুদ দুনিয়া’ দুনিয়ার জীবন (মায়ের পেট হতে জন্ম গ্রহণের পর মৃত্যু পর্যন্ত ) কালের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
২। ইরশাদ হয়েছে : তারাই পরকালের বিনিময়ে দুনিয়ার জীবন (হায়াতুদ দুনিয়া) ক্রয় করে। (সূরা বাকারাহ : আয়াত-৮৬, রুকু-১০)। এই আয়াতেও দুনিয়ার জীবনের কথা বলা হয়েছে।
৩। ইরশাদ হয়েছে : তুমি নিশ্চয়ই তাদেরকে জীবনের প্রতি সমস্ত মানুষ এমন কি মুশরিক অপেক্ষা অধিক লোভী দেখতে পাবে। (সূরা বাকারাহ : আয়াত-৯৬, রুকু-১১)। এই আয়াতেও জীবন বলতে দুনিয়ার জীবনকে বুঝানো হয়েছে।
৪। ইরশাদ হয়েছে : আর তোমাদের জন্য কিসাসের মধ্যে জীবন রয়েছে, যাতে তোমরা সাবধান হতে পার। (সূরা বাকারাহ : আয়াত-১৭৯, রুকু-২২)। বস্তুত প্রতিশোধ গ্রহণ করার জন্য হত্যার দাবি করা হলো কিসাসের আভিধানিক অর্থ। আর অন্যায়ভাবে কেউ কাউকে হত্যা করলে বিনিময়ে হত্যাকারীকে হত্যা করার যে বিধান রয়েছে ইসলামী পরিভাষায় তাকে কিসাস বলে। কিসাসের মধ্যে জীবন রয়েছে কথার অর্থ হলোÑ কিসাসের বিধান অন্যায় হত্যা বন্ধ করে দুনিয়ার জীবনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদান করেছে।
৫। ইরশাদ হয়েছে : মানুষের মধ্যে এমন ব্যক্তি আছে, দুনিয়ার জীবন সম্বন্ধে যার কথাবার্তা তোমাকে চমৎকৃত করে এবং তার অন্তরে যা আছে সে সম্বন্ধে সে আল্লাহকে সাক্ষী রাখে। (সূরা বাকারাহ : আয়াত-২০৪, রুকু-২৫)। এই আয়াতেও দুনিয়ার জীবনের কথাই তুলে ধরা হয়েছে।
৬। ইরশাদ হয়েছে : যারা সত্য প্রত্যাখ্যানকারী কাফের তাদের নিকট দুনিয়ার জীবন সুশোভিত। তারা মুমিনদেরকে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করে থাকে। (সূরা বাকারাহ : আয়াত-২১২, রুকু-২৬)। এই আয়াতেও দুনিয়ার জীবনের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে।
৭। ইরশাদ হয়েছে : এসব (নারী, সন্তান, রাশিকৃত স্বর্ণ রৌপ্য, চিহ্নিত অশ্বরাজি, গবাদিপশু এবং ক্ষেতখামারের প্রতি আসক্তি) মানুষের নিকট মনোরম করা হয়েছে। এসব দুনিয়ার জীবনের ভোগ্য বস্তু। (সূরা আলে ইমরান : আয়াত-১৪, রুকু-২)। এখানেও দুনিয়ার জীবনের কথা বলা হয়েছে।
৮। ইরশাদ হয়েছে : এই দুনিয়ার জীবনে যা তারা ব্যয় করে তার দৃষ্টান্ত হিমশীতল বায়ু। যা সে জাতি নিজেদের ওপর জুলুম করেছে তাদের শস্যক্ষেত্রকে আঘাত করে বিনষ্ট করে। (সূরা-আলে ইমরান : আয়াত-১১৭, রুকু-১২)।
৯। ইরশাদ হয়েছে : আর দুনিয়ার জীবন ছলনাময় ভোগ ব্যতীত কিছুই নয়। (সূরা আলে ইমরান : আয়াত-১৮৫, রুকু-১৯)।
১০। ইরশাদ হয়েছে : সুতরাং যারা পরকালের বিনিময়ে দুনিয়ার জীবন বিক্রয় করে, তারা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করতে থাকুক। (সূরা নিসা : আয়াত-৭৪, রুকু-১০)।
১১। ইরশাদ হয়েছে : তোমরা দুনিয়ার সম্পদের আকাক্সক্ষায় বিভোর অথচ আল্লাহর নিকট অনায়াসে লভ্য সম্পদ প্রচুর রয়েছে। (সূরা নিসা : আয়াত-৯৪, রুকু-১৩)।
১২। ইরশাদ হয়েছে : তোমরা ইহজীবনে তাদের পক্ষে বিতর্ক করছ, কিন্তু কিয়ামতের দিন আল্লাহর সম্মুখে কে তাদের পক্ষে তর্ক করবে? (সূরা নিসা : আয়াত-১০৯, রুকু-১৬)।
১৩। ইরশাদ হয়েছে : পার্থিব জীবন তো ক্রীড়া-কৌতুক ছাড়া আর কিছুই নয়। (সূরা আল-আনয়াম : আয়াত-৩২, রুকু-৪)।
১৪। ইরশাদ হয়েছে : পার্থিব জীবন যাদেরকে প্রতারিত করে তুমি তাদের সঙ্গ বর্জন কর। (সূরা আল-আনয়াম : আয়াত-৭০, রুকু-৮)।
১৫। ইরশাদ হয়েছে : তারা বলবে, আমরা আমাদের অপরাধ স্বীকার করলাম, বস্তুত পার্থিব জীবন প্রতারিত করে ছিল। (সূরা আল-আনয়াম : আয়াত-১৩০, রুকু-১৬)।
১৬। ইরশাদ হয়েছে : বল, পার্থিব জীবনে বিশেষ করে কিয়ামতের দিনে এই সমস্ত নেয়ামত তাদের জন্য যারা ইমান আনে। (সূরা আরাফ : আয়াত-৩২, রুকু-৪)।
১৭। ইরশাদ হয়েছে : যারা তাদের দীনকে ক্রীড়া কৌতুক রূপে গ্রহণ করেছিল এবং দুনিয়ার জীবন যাদেরকে প্রতারিত করেছিল। (সূরা আরাফ : আয়াত-৫১, রুকু-৬)।
১৮। ইরশাদ হয়েছে : যারা গো-বৎসকে উপাস্য রূপে গ্রহণ করেছে দুনিয়ার জীবনে তাদের ওপর তাদের প্রতিপালকের ক্রোধ ও লাঞ্ছনা আপতিত হবে। (সূরা আরাফ : আয়াত-১৫২, রুকু-১৯)।
১৯। ইরশাদ হয়েছে : তোমরা কি পরকালের পরিবর্তে দুনিয়ার জীবনে পরিতুষ্ট হয়ে গেছ? (সূরা তাওবাহ : আয়াত-৩৮, রুকু-৬)।
২০। ইরশাদ হয়েছে : পরকালের তুলনায় দুনিয়ার জীবনের ভোগের উপকরণ তো অকিঞ্চিত কর। (সূরা তাওবাহ : আয়াত-৩৮, রুকু-৬)
২১। ইরশাদ হয়েছে : আল্লাহ তো উহার (সম্পদ ও সন্তান- সন্তুতি) দ্বারাই তাদেরকে দুনিয়ার জীবনে শাস্তি দিতে চান। (সূরা তাওবাহ : আয়াত-৫৫, রুকু-৭)
২২। ইরশাদ হয়েছে : যারা আমার সাক্ষাতের আশা পোষণ করে না এবং দুনিয়ার জীবনেই পরিতৃপ্ত এবং এতেই নিশ্চিন্ত থাকে...। (সূরা ইউনুস : আয়াত-৭, রুকু-১)
২৩। ইরশাদ হয়েছে : হে মানুষ! তোমাদের জুলুম বস্তুত তোমাদের নিজেদের প্রতিই হয়ে থাকে, দুনিয়ার জীবনের সুখ ভোগ করে নাও, পরে আমারই নিকট তোমাদের প্রত্যাবর্তন...। (সূরা ইউনুস : আয়াত-২৩. রুকু-৩১)।
২৪। ইরশাদ হয়েছে : দুনিয়ার জীবনের দৃষ্টান্ত যেমন আমি আকাশ হতে বারিবর্ষণ করি যা দ্বারা ভূমিজ উদ্ভিদ ঘন সন্নিবিষ্ট হয়ে উদগত হয়...। (সূরা ইউনুস : আয়াত-২৪, রুকু-৩)।
২৫। ইরশাদ হয়েছে : তাদের জন্য আছে সুসংবাদ দুনিয়ার জীবনে ও আখেরাত বা পারলৌাকিক জীবনে। (সূরা ইউনুস : আয়াত-৬৪, রুকু-৭)। এই আয়াতে দুনিয়ার জীবন এবং আখেরাত বা পারলৌকিক জীবনের কথা সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। আখেরাত বা পারলৌকিক জীবন দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগকে বলা হয় বরযাখী জীবন। যা মৃত্যুর পর কবরস্থ হওয়া থেকে হাশরের মাঠে উত্থান পর্যন্ত প্রলম্বিত। আর দ্বিতীয় ভাগকে বলা হয় অনন্ত জীবন, যা হাশরের মাঠে উত্থান হতে অনন্তকাল পর্যন্ত প্রলম্বিত। (অসমাপ্ত)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন