রংপুর সিটি কর্পোরেশন বা রসিক নির্বাচন শেষ হয়েছে। ফলাফল সকলেই জেনে গেছেন। গতবারের তুলনায় এবার আওয়ামী লীগের ভোট কমেছে ৪৩ হাজার ৮ শত ৫৫ টি। সারা দেশের মানুষ বলছে, দেশ ব্যাপী আওয়ামী লীগের জন সমর্থনে বিশাল ধ্বস নেমেছে। তার ছায়াপাত ঘটেছে ঝন্টুর প্রায় ৪৪ হাজার ভোট কম পাওয়ায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিএনপি প্রার্থী কাওসার জামান বাবলা তৃতীয় হলেন কেন? মাত্র ৩৫ হাজার ১ শত ৩৬ ভোট পেলেন কেন? বলতে পারেন, গতবার তারা পেয়েছিল ২১ হাজার ২ শত ৩৫ ভোট। এবার তো তারা ১৩ হাজার ৯ শত ১ ভোট বেশি পেয়েছে। আওয়ামী লীগের ভোট যেখানে অনেক কমেছে সেখানে বিএনপির ভোট কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু বিএনপির ভোট কি মাত্র ১৩ হাজার ৯ শত বা ১৪ হাজার বাড়ার কথা ছিল? এটা তো আরো অনেক বেশি বাড়ার কথা ছিল।
ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের প্রার্থী এটিএম গোলাম মোস্তফা পেয়েছেন ২৪ হাজার ৬ শত ভোট। তিনি যদি প্রার্থী না হতেন এবং কেন্দ্রীয়ভাবে বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোটের সাথে যদি ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের হাই কমান্ডের একটি আন্ডারস্ট্যান্ডিং থাকতো তাহলে তো এই সাড়ে ২৪ হাজার ভোট বিএনপির বাক্সে পড়তো। তাহলে বিএনপির ভোট হতো ৫৯ হাজার ৭ শত ৩৬ ভোট।
একাধিক দৈনিক পত্রিকায় প্রশ্ন উঠেছে, জামায়াতে ইসলামীর ভোট গেল কোথায়? রংপুর শহরের স্থানীয় লোকেরা বলছেন, জামায়াতের ভোট ছিল অন্তত ৪০ থেকে ৪৫ হাজার। এখন যারা এ সম্পর্কে লিখছেন তারা বলছেন, জামায়াতের ভোট গেছে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার লাঙ্গল মার্কা বাক্সে। তাহলে ২০ দলীয় জোটের মধ্যে থাকা সত্বেও জামায়াতের ভোট জাতীয় পার্টির বাক্সে গেল কিভাবে? এই প্রশ্নটি এখন বিভিন্ন মহলে উচ্চারিত হচ্ছে। কিন্তু উত্তরটি যাই হোক না কেন, সেটি চ‚ড়ান্ত পরিণামে সরকারপক্ষে যায় না বলে বিষয়টি নিয়ে অনেক পত্রপত্রিকা নীরব রয়েছে। তবে একটি মহল বলছেন জামায়াতে ইসলামীর সামনে প্রধান টার্গেট ছিল আওয়ামী লীগ। তারা যদি বিএনপিকে ভোট দিতেন তাহলে অনেক ভোট আওয়ামী লীগের ঝন্টু বেশি পেতেন এবং জাতীয় পার্টির মোস্তাফিজার রহমান মোস্তাফিজের ভোট সমপরিমাণে কমতো। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর জয় লাভের একটি ক্ষীণ সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু যেহেতু তাদের টার্গেট ছিল আওয়ামী লীগকে হারানো তাই তারা এ ক্ষেত্রে কোনো রিস্ক নিতে চাননি। তারা একথাও বলছেন, এই ৪০ হাজার ভোট ধানের শীষে পড়লেও ধানের শীষের জয় লাভের সম্ভাবনা ক্ষীণ ছিল। গাঁও গ্রামে যে ভাষা বলা হয় সেই ভাষা ধার করে বলা যায় যে, যেহেতু বিএনপি প্রার্থীর জয় লাভের সম্ভাবনা কম ছিল তাই তাদের ভাষায় তাদের ভোট তারা পঁচাতে চাননি। সে ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তাফিজের ভোট অনেক কমে যেত।
\দুই\
এটি তো হলো সাধারণ হার জিতের হিসাব নিকাশ। কিন্তু ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের ক্যান্ডিডেট খাড়া করা এবং জামায়াতের ভোট ভিন্ন বাক্সে চলে যাওয়ার পেছনে কি কোনো আদর্শিক কারণ আছে? বিএনপি কি এ ব্যাপারে কিছু ভাবছে? এই আদর্শিক দিক নিয়ে তারা কি কোনো গবেষণা করছে? একটি দল যদি শুধু মাত্র ইলেকশন নিয়ে অথবা ক্ষমতায় যাওয়া নিয়েই সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকে তাহলে জনগণকে তারা ধরে রাখবে কিভাবে? সেই বৃটিশ আমল বলুন, বাংলাদেশ আমল বলুন, আর এখনকার অবস্থা বলুন, জনগণকে তো সব সময় একটি রাজনৈতিক আদর্শ এবং এক বা একাধিক ইস্যুর স্বপ্ন দেখাতে হবে। রাজনৈতিক দল বা নেতা নেত্রীদের কাজকাম এবং কথাবার্তায় সেই আদর্শের প্রতিচ্ছবি দেখলে তারা সেই দল বা নেতার পেছনে কাতারবন্দি হয়। অন্য কথায় জনগণকে স্বপ্ন দেখাতে হয়। ভারত ভাগের আগে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং মুসলিম লীগ উপমহাদেশের মুসলমানদেরকে একটি মুসলিম রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তাই যেসব মুসলমান ভারত বিভক্তির পরেও ভারতে থেকে গেছেন তারাও মুসলিম লীগ তথা পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। পাকিস্তান আমলে শেখ মুজিব তথা আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের বাঙ্গালীদেরকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তাই জনগণ সেই সময় তাদের পেছনে দাঁড়িয়েছিল। ৭৫ এর পর মরহুম জিয়াউর রহমান জনগণকে ভারতীয় আধিপত্য থেকে মুক্তি এবং আওয়ামী অপশাসন থেকে মুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তাই তিনি জীবনে কোন দিন রাজনীতি না করেও একটি রাজনৈতিক দলের জন্ম দিয়েছিলেন, যে দলটি রাজনীতিতে সবচেয়ে জনপ্রিয় দল এবং জিয়াউর রহমান নিজে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতায় পরিণত হয়েছিলেন।
যে ইসলামী মূল্যবোধ, আধিপত্যবাদ থেকে মুক্তি, এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের স্বপ্ন নিয়ে বিএনপির জন্ম হয়েছিল এবং পরবর্তীতে এই তিনটি আদর্শের ভিত্তিতে যে ২০ দলীয় জোট গঠিত হয়েছিল, আজ বিএনপি সেই তিনটি আদর্শ আঁকড়ে ধরে আছে, তেমনটি এখন আর মনে হয় না। বিগত ৩ বছর ধরে ভারত সম্পর্কে তারা মুখ বন্ধ রেখেছে। ইসলামী মূল্যবোধ সম্পর্কেও তাদের মুখে কোনো কথা শোনা যায় না। ১০ বছর ধরে তারা ক্ষমতায় নাই। ১০ বছর ক্ষমতায় না থাকলে একটি দল আন্দোলনমুখী হয়ে ওঠে। কিন্তু বিএনপির ক্ষেত্রে মনে হচ্ছে সব উল্টো। তারা ক্ষমতা থেকে যত দূরে থাকছে ততই তারা আন্দোলন ও রাজপথ বিমূখ হচ্ছে। তাই যদি না হবে তাহলে ২০১৫ সালে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনসমূহে তাদের পোলিং এজেন্টদের তাড়িয়ে দেওয়া হলো। অথচ তারা বিনা বাক্য ব্যয়ে বেরিয়ে আসল কেন? রুহুল কবির রিজভি বলেছেন, এবারও নাকি রংপুরের অনেকগুলি কেন্দ্র থেকে তাদের এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা কোনো প্রতিরোধ করলেন না কেন?
\তিন\
সত্যি কথা বলতে কি, লক্ষ লক্ষ মানুষ রয়েছে যারা মনেপ্রাণে বিএনপির সমর্থক। যারা চায়, যে কোনো গণতান্ত্রিক পন্থায় এবং নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে এই সরকারের পতন। এসব মানুষ সাধারণ মানুষ। তারা বিএনপির সমর্থক। সে জন্যই বিএনপির নিকট তাদের প্রত্যাশা অনেক বেশি। এখন হাটেবাজারে গেলে জনগণকে প্রকাশ্যে বলতে শোনা যায়, বিএনপি কি করছে? পিয়াজের দাম ১৪০ টাকা। মানুষ তাদের বাপ দাদা চৌদ্দ গোষ্ঠির আমলে এমন কথা শোনেনি। একটি বড় পিয়াজ এবং একটি ডিমের দাম সমান। যে মানুষ এই বর্তমান সরকারের শুরুতে তাদের ঘরবাড়ির বিদ্যুতের বিল দিত ৫০০ টাকা আজ তাদের সেই বিল গুনতে হচ্ছে ৫ হাজার টাকা। চালের বাজার অবিশ্বাস্য। কেজিপ্রতি গত সপ্তাহেও ছিল ৭০ টাকা। এখন কিছুটা কমে হয়েছে ৬০-৬৫ টাকা। অথচ এই আওয়ামী লীগই তাদের প্রথম মেয়াদে ১০ টাকা কেজিতে চাল খাওয়াতে চেয়েছিল। জ্বালানি গ্যাস সব জিনিসের দাম রকেটের গতিতে বেড়েছে। ২০ টাকার ওষুধ এখন ৮০-১০০ টাকা। ডাক্তারের ফি ৩০০ টাকা থেকে ১২০০ টাকা। খুব শীঘ্রই সেটি হতে যাচ্ছে ১৫০০ টাকা। যে সার্জিক্যাল অপারেশন ছিল ১ লক্ষ ২০ হাজার থেকে দেড় লক্ষ টাকা সেই সার্জারি এখন ৫ লক্ষ টাকা।
জনগণের নাভিশ্বাস উঠেছে। তাদের প্রত্যাাশা ছিল, এই অবিশ্বাস্য এবং অকল্পনীয় দ্রব্যমূল্য নিয়ে জনগণের পক্ষে বিএনপি মাঠে নামবে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হলো, জনগণের এই সীমাহীন দুর্ভোগ দেখেও মাঠে নামা তো দূরের কথা, এই বিষয়ের ওপর এককভাবে কোনো সংবাদ সম্মেলনও তারা করেনি। তাই মানুষ প্রশ্ন করছে, কিভাবে বিএনপি জনগণের দল হয়? কিভাবে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে?
\চার\
বিএনপির সমস্ত বক্তব্য এবং বক্তৃতা বিবৃতির মূল সুর হলো একটিই। আর সেটি হলো, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। তাদের সব শ্রেণীর নেতার মুখে একই বুলি, গণতন্ত্র। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার গুরুত্ব যে কত সীমাহীন সেটি আমরা অস্বীকার করি না। কিন্তু সাধারণ মানুষ, ঐ মুটে-মজুর, রিক্সাওয়ালা, চাষী, অফিসের পিয়ন-পেয়াদা, কেরানী, যাদের নুন আনতে পানতা ফুরায়, তাদের কাছে গণতন্ত্র প্রাইম ফ্যাক্টর নয়। তাদের দৈনন্দিন জীবন এবং যেসব ঘটনায় তাদের ঈমান আকিদা আন্দোলিত হচ্ছে সেসব ঘটনার প্রতিবাদ এবং সেই সব ঘটনাকে রুখে দাঁড়ানোর জন্য বিএনপি মাঠে নামবে এবং জনগণকে সেই আন্দোলনে শরিক করবে, এমন উদ্যোগ জনগণ বিএনপির নিকট থেকে আশা করেছিল। এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর অন্তত ৪ শত ব্যক্তি গুম হয়েছে। তাদের ১০ শতাংশও ফিরে আসেননি। অবশিষ্টদের ভাগ্যে কি ঘটেছে সেটা তাদের ঘনিষ্ঠ এবং নিকট জন আজও জানেন না। তারা কি বেঁচে আছেন? নাকি তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে? তারা যদি মারা গিয়ে থাকেন তাহলে তাদের লাশ টাও তারা পাচ্ছেন না কেন?
এই ধরণের অসংখ্য প্রশ্ন মানুষের মনে। কিন্তু এগুলোর কোনো জবাব নাই। জনগণের যন্ত্রণা, জনগণের আর্তিকে ধারণ না করলে জনগণ একটি দলের নীবর সমর্থক হতে পারে। কিন্তু সেই দলের জন্য তারা জীবনপাত করবে না। আরেকটি হলো, জাতির অস্তিত্ব, জাতীয় সার্বভৌমত্ব এবং ধর্মবিশ্বাস। এসবের ওপর আঘাত আসলে যদি সেই রাজনৈতিক দলটি সেই আঘাতকে রুখে দাঁড়াতে চায় তাহলে জনগণ আন্দোলনে শরিক হয়। দুঃখের বিষয়, বিএনপি বিগত ৩ বছরে এসবের কোনটাতেই সম্পৃক্ত হয়নি এবং তার অবস্থানও পরিস্কার করেনি। এর ওপর রয়েছে সরকারের দমন নীতি এবং জুলুমের ষ্টীম রোলার। ফলে সাময়িকভাবে হলেও বিএনপি মুখ থুবড়ে পড়েছে। ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।
ওপরে উল্লেখিত কারণ সমূহ এবং আরো অন্যান্য কারণে জামায়াতে ইসলামী সহ ইসলামী দলগুলোর সাথে বিএনপির যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে সেটি দূর করতে না পারলে আগামীতে আওয়ামী লীগের ঝটিকা বাহিনী তাদের কোথাও দাঁড়াতেই দেবে না। এই কথাটি তাদেরকে আগামীতে মনে রাখতে হবে। না হলে জনসমর্থন যতই থাকুক, বিজয়ের মুকুট তাদের মাথায় উঠবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন