বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

ইসলামে যা নিন্দনীয় ও নিষিদ্ধ

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ | প্রকাশের সময় : ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
নবীজীবনে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার অপছন্দনীয়তা
১. হজরত আয়েশা (রা.) বলেন-‘হজরত উসমান ইবনে মাজউন (রা.)-এর স্ত্রী খুব সুন্দরী ছিলেন। আতর লাগাতেন। বেশ দামি দামি পোশাক পরতে পছন্দ করতেন।’ একবার হজরত আয়েশা (রা.) তাকে বেশ ময়লাযুক্ত কাপড় পরাবস্থায় দেখতে পেলেন। জিজ্ঞেস করলেন- ‘তোমার এই অবস্থা কেনো?’ জবাবে স্ত্রীলোকটি বললেন- ‘আসলে কয়েকজন সাহাবি (রা.) [যাদের মাঝে হজরত আলী (রা.), হজরত আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা.), হজরত উসমান ইবনে মাজউন (রা.) রয়েছেন] ইবাদতের জন্য নিজেদেরকে দুনিয়ার সমস্ত কাজ থেকে অবসর নিয়েছেন। স্ত্রীদের থেকে দূরে সরে গেছেন। গোশত খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। সারাদিন রোজা রাখছেন। রাতভর নামাজে দাঁড়িয়ে রইছেন। এই পরিস্থিতিতে আমি আমার স্বামীর সামনে এমন খুব সেজেগুজে আসাটা ভালো মনে করছি না, যেনো তিনি আমার প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে পড়েন।’ এরপর যখন রাসুল (সা.) ঘরে এলেন, তখন হজরত আয়েশা (রা.) পুরো ঘটনা খুলে বললেন। রাসুল (সা.) শুনে তাঁর জুতা মোবারক তুললেন। বাঁ-হাতের তর্জনী (শাহাদত) আঙুলে উঁচিয়ে ধরলেন। দ্রæত তাদের কাছে পৌঁছুলেন। ফের তাদের কাছেই তাদের অবস্থা জিজ্ঞেস করলেন। জবাবে তারা বললেন- ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমাদের উদ্দেশ্য ভালোর জন্যই।’ রাসুল (সা.) বললেন- ‘আমি এমন শরিয়ত নিয়ে প্রেরিত হয়েছি, যা আঁকাবাঁকামুক্ত, সহজিয়া-ধরনের শিক্ষা দেয়। আমি শরিয়তে নতুন কিছু উদ্ভাবনের জন্য প্রেরিত হইনি। খবরদার! একটি সম্প্রদায় ধর্মে নতুন কিছু উদ্ভাবন আরম্ভ করেছিলো, পরে সেগুলি তাদের ওপর আবশ্যক করা হয়েছিলো। কিন্তু তারা তা পালন করতে সক্ষম হয়নি। খবরদার! গোশত খাও। স্ত্রীদের কাছে যাও। আর রোজা কখনও রাখো, কখনও ছাড়ো। কয়েকটি রাতে নামাজ পড়ো, কয়েকটি রাতে শুয়ে পড়ো। কেননা আমায় এমন সহজিয়া ধর্ম পালনের আদেশ করা হয়েছে।’ (আল মুজামুল কাবির : ৭৬১৭)।
২. হজরত আয়েশা (রা.) থেকে আরেকটি বর্ণনায় এমন রয়েছে, হজরত উসমান ইবনে মাজউন (রা.)-এর স্ত্রী খাওলা বিনতে হাকিম (রা.) হজরত আয়েশা (রা.)-এর কাছে আসা-যাওয়া করতেন। একবার তিনি খুব অপছন্দনীয় অবস্থায় এলেন। তখন হজরত আয়েশা (রা.) তাকে জিজ্ঞেস করলেন-‘এ কী অবস্থা করেছো নিজের?’ জবাবে তিনি বললেনÑ‘আমার স্বামী রাতভর ইবাদত-বন্দেগিতে কাটান। সারাদিন রোজা রাখেন। তো আমি কার জন্য সেজেগুজে থাকবো?’ তখনই রাসুল (সা.) হজরত আয়েশা (রা.)-এর ঘরে এলেন। হজরত আয়েশা (রা.) রাসুল (সা.)-এর কাছে ঘটনাটি খুলে বললেন। সেই মুহূর্তেই রাসুল (সা.) হজরত উসমান ইবনে মাজউন (রা.)-এর কাছে গেলেন। বললেনÑ‘ধর্মে নতুন কিছু উদ্ভাবন করা আমাদের জন্য শরিয়তসম্মত নয়। তোমার জন্য কী আমার আদর্শে ধর্মের কোনো নমুনা নেই? খোদার কসম, আমি তোমাদের মাঝে সবচেয়ে বেশি আল্লাহকে ভয় পাই। আর তার সীমারেখাকে সবচেয়ে বেশি সংরক্ষণকারীও আমিই।’ (মুসনাদে আহমদ : ২৫৯৩৫, সহিহ ইবনে হাব্বান : ৯, মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক : ১০৩৭৫, মুজামুস সাহাবা : ১৭৮৭, আল মুজামুল কাবির : ৮২৪০, আল আহকামুশ শারইয়্যাহ : ৩/২৬৩)।
৩. হজরত আনাস (রা.)-সূত্রে বর্ণিত। রাসুল (সা.)-এর ইবাদত সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করবার জন্য তিনজন লোক রাসুল (সা.)-এর স্ত্রীদের ঘরে এলেন। যখন তাদেরকে রাসুল (সা.)-এর ইবাদত সম্বন্ধে বলা হলো, তখন তারা এটাকে অতি সাধারণ মনে করলো। পরস্পর বলতে লাগলোÑ‘ইবাদত-বন্দেগিতে আমরা কোথায়, আর রাসুল (সা.) কোথায়? তাঁর তো আগত-বিগত সব গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে। তাই তাঁর ইবাদত কম হবার ফলে তাঁর মর্যাদা তো কমে যাবে না।’ ফের তাদের মধ্য হতে একজন বলে ওঠলোÑ‘আমি তো ভাবছি আজ থেকে সর্বদাই রাতভর নামাজ পড়তে থাকবো।’ আরেকজন বললোÑ‘আমি সর্বদাই রোজা রাখবো। কখনও রোজা ছাড়বো না।’ তৃতীয় আরেকজন বলে ওঠলোÑ‘আমি আজ থেকে স্ত্রীলোকদেরকে এড়িয়ে চলবো। কখনও বিয়েশাদি করবো না।’ তখনই রাসুল (সা.) এসে পড়লেন তাদের মাঝে। জিজ্ঞেস করলেনÑ‘তোমরা কী এমন এমন কথা বলছিলে? অথচ আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমি তো তোমাদের মাঝে সবচেয়ে বেশি আল্লাহকে ভয় করি, সবচেয়ে বেশি তাকওয়া-পরহেজগারি অবলম্বন করি; কিন্তু আমি তো কখনও নফল রোজা রাখি, কখনও ছেড়ে দিই। কখনও সারারাত নামাজ পড়ি, কখনও শুয়ে থাকি। আর আমি তো নারীদেরকে বিয়েও করেছি। সুতরাং যে আমার এই পথপন্থার উল্টো করলো, সে আমার আদর্শভুক্ত নয়।’ (সহিহ বোখারি : ৫০৬৩, সহিহ ইবনে হিব্বান : ৩১৭, সুনানে কুবরা লিল বায়হাকি : ১৩৮৩০, সুনানে সুগরা লিল বায়হাকি : ১৮১০)।
৪. হজরত আনাস (রা.) বলেন, ‘সাহাবায়ে কেরামের মধ্য হতে কিছু লোক রাসুল (সা.)-এর স্ত্রীদের কাছে রাসুল (সা.)-এর ভেতরগত ইবাদত-বন্দেগির ব্যাপারে জানতে চাইলেন। সব শুনে তাদের কিছু লোক বললেনÑ‘আমি বিছানায় আর আরাম করতে যাবো না।’ কিছু লোক বললেনÑ‘আমি বিয়ে করবো না।’ কিছু লোক বললেনÑ‘আমি রোজা রাখবো। কখনও রোজা ছাড়বো না।’ অন্য বর্ণনায় রয়েছেÑকিছু লোক বললেনÑ‘আমি গোশত খাবো না।’ এসব কথা রাসুল (সা.)-এর কানে পৌঁছুলো। তখন তিনি বিশেষ ভাষণ দেবার জন্য দাঁড়িয়ে গেলেন। আল্লাহর প্রশংসা বয়ান করে বলতে লাগলেনÑ‘লোকদের কী অবস্থা হলো, তারা এমন এমন কথা বলতে আরম্ভ করেছে! অথচ আমি কখনও নফল রোজা রাখি, কখনও ছেড়ে দিই। কখনও রাতভর নফল নামাজ পড়ি, কখনও শুয়ে পড়ি। আমি তো নারীদেরকে বিয়েও করেছি। সুতরাং যে আমার এই পথপন্থা থেকে বিমুখ হয়ে যাবে, সে আমার দলভুক্ত নয়।’ (সহিহ মুসলিম : ৩৪৬৯, সুনানে নাসাই : ৩২১৭, মুসনাদে আহমদ : ১৪০৭৭, সহিহ ইবনে হিব্বান : ১৪, মুসনাদে বাজ্জার : ৬৮০৭, সুনানে বায়হাকি : ৫৩০৫, মুস্তাখরাজে আবি উওয়ানা : ৩২২৩)।
৫. হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) বলেন, আমার শ্রদ্ধেয় পিতা হজরত আমর ইবনুল আস (রা.) কুরাইশের একজন নারীর সঙ্গে আমায় বিয়ে করিয়ে দিলেন। যখন স্ত্রী আমার কাছে এলো, তখন আমি তাকে এজন্য দেখতে লাগলাম, যেনো আমার মাঝে নামাজ, রোজাসহ যাবতীয় ইবাদতের আরও আগ্রহ জন্মে। পিতা হজরত আমর ইবনুল আস (রা.) ঘরে প্রবেশ করে আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেনÑ‘স্বামীকে কেমন পেলে?’ স্ত্রী বললোÑ‘উনি উত্তম মানুষ।’ অথবা সে বললোÑ‘উনি উত্তম পুরুষ। কারণ উনি কেবল আমাদের পর্দাই খোলেননি, আর না কেবল আমাদের জন্য বিছানায়ই কদম রেখেছেন। পিতা হজরত আমর (রা.) রাসুল (সা.)-এর কাছে গিয়ে পুরো বিষয়টি আলোচনা করলেন। রাসুল (সা.) বললেনÑ‘তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো।’ আমি হাজির হয়ে গেলাম। রাসুল (সা.) আমায় জিজ্ঞেস করলেনÑ‘রোজা কীভাবে রাখো?’ আমি বললামÑ‘রোজই, ইয়া রাসুলাল্লাহ!’ রাসুল (সা.) বললেনÑ‘হপ্তায় কেবল তিনদিন রোজা রেখো।’ আমি বললামÑ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার মাঝে তো এর চেয়ে বেশি রোজা রাখার শক্তি রয়েছে।’ রাসুল (সা.) বললেনÑ‘লাগাতার দুদিন রেখো, এর পরের দিন ছেড়ে দিও।’ আমি আবারও বিনীতস্বরে বললামÑ‘আমি তো এর চেয়েও বেশি রাখার শক্তি রাখি।’ রাসুল (সা.) বললেনÑ‘হজরত দাউদ (আ.)-এর মতো রোজা রাখাই শ্রেষ্ঠ রোজা রাখা। সেটাই রাখো। তা হলোÑএকদিন রোজা রাখো, অন্যদিন ছেড়ে দাও।’ (সহিহ বোখারি : ৫০৫২, সুনানুত তিরমিজি : ২৩৮৯, সুনানে কুবরা লিন নাসাই : ২৭১০)।
ইমাম আহমদ (রহ.) ও অন্যান্য ইমামদের বর্ণনায় রয়েছেÑরাসুল (সা.) তাকে জিজ্ঞেস করলেনÑ‘তুমি কী দিনভর রোজা রাখো?’ হজরত আবদুল্লাহ (রা.) জবাবে বললেনÑ‘জী।’ জিজ্ঞেস করা হলোÑ‘রাতভর নামাজ পড়ো কী?’ বললেনÑ‘জী।’ রাসুল (সা.) বললেনÑ‘কিন্তু আমি তো কখনও (নফল) রোজা রাখি, কখনও রোজা রাখি না। কখনও (নফল) নামাজ পড়ি, কখনও শুয়ে পড়ি। আর আমি তো আমার সহধর্মিনীদের সঙ্গে মোলাকাতও করি। তাই যে আমার এই আদর্শচ্যুত হবে, সে আমার দলভুক্ত নয়।’ (মুসনাদে আহমদ : ৬৪৭৭, মুজামুস সাহাবা : ১৪৭৪)।
৬. হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.)-এর শ্রদ্ধেয়া মা হজরত উম্মে নুবাইয়া বিনতে হাজ্জাজ (রা.) সবসময় রাসুল (সা.)-কে হাদিয়া পাঠাতেন। রাসুল (সা.) একবার তাদের ঘরে গেলেন। কুশলাদির পর বললেনÑ‘আবদুল্লাহর কী অবস্থা?’ হজরত উম্মে নুবাইয়া (রা.) বললেনÑ‘সে ভালো আছে। কিন্তু দুনিয়াবিমুখ হয়ে গেছে।’ রাসুল (সা.) জানতে চাইলেনÑ‘সেটা কীভাবে?’ তিনি বললেনÑ‘সে নিজের ওপর ঘুম হারাম করেছে। কখনও ঘুমোয় না। রোজা ছাড়ে না কখনোই। গোশত খায় না। বৌয়ের হক আদায় করে না।’ রাসুল (সা.) জানতে চাইলেনÑ‘কোথায় সে এখন?’ বললেনÑ‘এইতো কিছুক্ষণ হলো বাইরে গেছে। এসেই পড়বে হয়তো।’ রাসুল (সা.) বললেনÑ‘যখন আসে, আমার কথা বলে অপেক্ষা করতে বোলো।’ খানিকবাদে তিনি এসে পড়লেন। রাসুল (সা.) তাকে বললেনÑ‘তোমার আত্মারও তোমার প্রতি অধিকার আছে, তোমার স্ত্রীরও তোমার ওপর অধিকার রয়েছে।’ (মুস্তাদরাকে হাকিম : ৬৯০০)।
৭. হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) একটি কাজ করে তার অনুমতি চাইলেন। কিন্তু কিছু লোক তা থেকে বিরত ও সতর্ক থাকতে লাগলেন। আর এ কথা রাসুল (সা.)-এর কানে পৌঁছুলো। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, রাসুল (সা.) গোস্বা হয়ে তাদের কাছে গেলেন। তাঁর রাগ হবার চিহ্ন তাঁর চেহারা মোবারকে স্পষ্ট হতে লাগলো। আল্লাহর প্রশংসা করে তিনি একটি ভাষণ দিলেনÑ‘লোকদের কী হলো, তারা এমন জিনিস থেকে বিরত থাকছে, যা স্বয়ং আমি করে থাকি। আল্লাহর শপথ! লোকদের মাঝে আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি আমিই জানি এবং ভয় করি।’ (সহিহ বোখারি : ৬১০১, সহিহ মুসলিম : ৬২৫৭, আল আদাবুল মুফরাদ : ৪৩৬, শরহুস সুন্নাহ : ৯৯, মুশকিলুল আসার : ৫৮৮২)।
৮. হজরত মুসলিম কোরাইশি (রা.) বলেন, আমি একবার রাসুল (সা.)-এর কাছে আজীবন রোজা রাখার ব্যাপারে প্রশ্ন করি। জবাবে তিনি বললেনÑ‘তোমার ওপর তোমার পরিবার-পরিজনের হক রয়েছে। রমজানের পূর্ণ (ফরজ) ও শাওয়ালের কিছু (নফল) রোজা রেখো। সঙ্গে প্রতি বুধ ও বৃহস্পতিবার (নফল) রোজা রেখো। এগুলির প্রতিদান তোমার জীবনভর রোজা রাখার মতো।’ (সুনানে আবি দাউদ : ২৪৩২, সুনানে তিরমিজি : ৭৫৩, শুআবুল ঈমান : ৩৫৮৬)।
৯. হজরত সাহল ইবনে আবু উমামা (রা.) বলেন, হজরত উমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.)-এর খেলাফতকালে তিনি এবং তাঁর বাবা হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.)-এর কাছে গেলেন। দেখলেন তিনি বেশ সাদাসিধে-ধরনের নামাজ পড়ছেন। যেমন মুসাফিরের নামাজ হয়, অনেকটা ঠিক তেমন। যখন তিনি সালাম ফেরালেন, তখন তাঁর বাবা বললেনÑ‘হজরত! আপনি ফরজ নামাজ পড়লেন নাকি কোনো নফল নামাজ আদায় করলেন?’ হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) বললেনÑ‘ফরজ নামাজ পড়েছি। রাসুল (সা.) এভাবেই নামাজ আদায় করতেন। আমি এতে কোনো ভুল করিনি। হুবহু তাঁর মতোই আদায় করেছি। তবে হয়তো কোনো ভুলের শিকার হতে পারি।’ ফের বললেনÑরাসুল (সা.) বলেছেনÑ‘নিজের ওপর এমন কঠোরতা কোরো না, যেনো তোমার ওপর কঠোরতা অবলম্বন করা হয়। কেননা একটি সম্প্রদায় নিজেদের ওপর কঠোরতা করেছিলো। ফলে আল্লাহতায়ালাও তাদের প্রতি কঠোরতা আরোপ করেছিলেন। আর এসব তাদেরই অবশিষ্ট পদচিহ্ন, যা তাদের গির্জা ও আবাসসমূহে রয়েছে।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৪৯০৬, মুসনাদে আবি ইয়া’লা : ৩৬৯৪)।
১০. হজরত আবু জুহায়ফা (রা.) বলেন, হজরত আবু দারদা (রা.) ও হজরত সালমান (রা.)-এর পরস্পরের মাঝে ভাই ভাই সম্পর্ক ছিলো। একবার হজরত সালমান (রা.) হজরত আবু দারদা (রা.)-এর ঘরে বেড়াতে গেলেন। তখন তার স্ত্রীকে বেশ অগোছালো দেখে জিজ্ঞেস করলেনÑ‘তুমি এ কী অবস্থা করে রেখেছো নিজের?’ স্ত্রী বললেনÑ‘কারণ আপনার ভাই আবু দারদার দুনিয়ার কোনো জিনিসের প্রয়োজন নেই।’ তখনই হজরত আবু দারদা (রা.) কোথাও থেকে এসে পড়লেন। বললেনÑ‘আমি রোজাদার।’ হজরত সালমান (রা.) বললেনÑ‘তুমি যতোক্ষণ পর্যন্ত আমার সঙ্গে না খাবে, ততোক্ষণ পর্যন্ত আমিও খাবো না তোমার ঘরের খাবার।’ এটা শুনে হজরত আবু দারদা (রা.) তার সঙ্গে খাবার খেলেন। ফের রাতে তিনি নামাজ পড়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। তখন হজরত সালমান (রা.) বললেনÑ‘শুয়ে পড়ো।’ বন্ধুর আবদারে তিনি শুয়ে পড়লেন। কিন্তু খানিকবাদে উঠতে চাইলেন। হজরত সালমান (রা.) বললেনÑ‘ঘুমিয়ে পড়ো।’ তিনি আবার শুয়ে পড়লেন। ফের যখন শেষ রাত হলো, তখন হজরত সালমান (রা.) বললেনÑ‘এখন ওঠো।’ এরপর দুজনেই নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন। নামাজের পরে হজরত সালমান (রা.) বললেনÑ‘নিঃসন্দেহে তোমার ওপর তোমার রবের, তোমার নিজের, তোমার স্ত্রী-পরিবারেরও কিছু হক রয়েছে। তাই প্রত্যেক হকদারের পাওনা হক যথাযথ আদায় করো।’ এ কথা শুনে হজরত আবু দারদা (রা.) রাসুল (সা.)-এর দরবারে গিয়ে পূর্ণ ঘটনা বর্ণনা করলেন। জবাবে রাসুল (সা.) বললেনÑ‘সালমান পূর্ণ সত্য ও সঠিক বলেছে।’ (সহিহ বোখারি : ১৯৬৮, সুনানে তিরমিজি : ২৪১৩, সহিহ ইবনে খোজায়মা : ২১৪৪, সহিহ ইবনে হিব্বান : ৩২০, মুসনাদে বাজ্জার : ৪২২৩, সুনানে দারা কুতনি : ২২৩৫, সুনানে বায়হাকি : ৮৬০৪, তাহজিবুল আসার : ৭৯৩)।
উল্লিখিত হাদিস শরিফে রাসুল (সা.)-এর জীবনাদর্শ বর্ণিত হয়েছে। স্বয়ং রাসুল (সা.)-এর পবিত্র ভাষায়ও এ কথা বর্ণিত হয়েছে, তিনি ভারসাম্যের সঠিক সীমায় প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। অন্যদেরকেও এই মধ্যমপন্থা ও ভারসাম্যের শিক্ষা দিতেন। ধর্মের মাঝে কঠোরতা অবলম্বন, নতুন নতুন কিছু উদ্ভাবন করা তাঁর আদর্শ ও কর্মপন্থা ছিলো না। প্রয়োজন পড়লে রাসুল (সা.) দুনিয়ার কাজও করতেন, কখনও রাতভরও ইবাদতবন্দেগি করতেন, কখনো বা আরামও করতেন। নফল রোজা রাখা, ছাড়ার ক্ষেত্রেও তিনি ভারসাম্যপূর্ণ পন্থার প্রতি খেয়াল রাখতেন। মোটকথা, রাসুল (সা.)-এর জীবনাদর্শ ছিলো ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা থেকে একেবারেই মুক্ত। এই সমস্ত দলিলের মাধ্যমে বোঝা যায়, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা হারাম ও অবৈধ। কোরআনে কারিম এ থেকে নিষেধ করেছে। হাদিস শরিফ ও রাসুল (সা.)-এর জীবনচরিতের মাধ্যমেও এর নিষিদ্ধতা সুস্পষ্ট। এ কারণে উলামায়ে কেরামও এ বিষয়ে মুসলিমউম্মাহকে সতর্ক করেছেন। বোখারি শরিফের ব্যাখ্যাকার হজরত আল্লামা বদরুদ্দিন আইনি (রহ.) ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করাটা নিষিদ্ধ হবার আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেনÑ‘এই আয়াতের মাধ্যমে হজরত উলামায়ে কেরাম ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করাটাকে হারাম ও নিষিদ্ধ হবার ওপর প্রমাণ দেন।’ (উমদাতুল কারি : ২৫/ ৫৭/ বাবে ইকতিদাউ আফআলিন নবী)।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন