শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

নিবন্ধ

পারিবারিক হিংসা থেকে মহিলাদের সুরক্ষা

নি ব ন্ধ

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ১৫ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

পারিবারিক হিংসা থেকে মহিলাদের সুরক্ষা দেয়া সংক্রান্ত আইন ২০০৫ সালে বিধিবদ্ধ করা হয়। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই আইনটি ২০০৬ সালের পঁচিশ অক্টোবর কার্যকর হয়। ক্রমবর্ধমান পারিবারিক হিংসার কবল থেকে মহিলাদের নিশ্চিত সুরক্ষা দেওয়াই এই আইনের প্রধান লক্ষ্য। আশা করা হয় সরকারসমূহ এই আইন প্রয়োগের মাধ্যমে পারিবারিক হিংসার আক্রমণ থেকে মহিলাদের সুরক্ষা দিতে পারবে। ওই মহিলা একটি যৌথ পরিবারের একজন বিবাহিতা স্ত্রী হবেন এমন কথা নয়। যৌথ পরিবারের কোনো মহিলা ওই পরিবারের যে-কোনো সদস্য (পুরুষ বা মহিলা) দ্বারা নির্যাতিত হলে এই আইনে মামলা করতে পারেন। আবার একজন মহিলা একজন পুরুষের সঙ্গে স্বামী-স্ত্রী রূপে বসবাস কালে যদি কোনোভাবে নির্যাতিত হন তাহলে ওই পুরুষ এবং পরিবার যদি যৌথ হয় এবং যদি ওই পরিবারের অন্য কোনো মহিলা বা পুরুষ সদস্য ওই মহিলার উপর অত্যাচার করেন তাহলে তিনিও এই মামলার আওতায় আসবেন। এই ক্ষেত্রে এটা বিচার্য বিষয় হবে, ওই মহিলা ও পুরুষ আইনসঙ্গতভাবে বিবাহিত কিনা। 

যৌথ পরিবারসমূহে স্বামী কিংবা অন্য সদস্যদের বিবিধ কার্যকলাপের মধ্যে ঠিক কোন কোন কার্যকলাপ পারিবারিক হিংসামূলক হিসাবে গণ্য করা হবে এই আইনের ধারা ৩-এ তা সুস্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। ধারা ৫-এ রয়েছে পুলিশ আধিকারিক, ম্যাজিস্ট্রেট ও সুরক্ষা কাজে নিয়োজিত আধিকারিকদের কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্পর্কিত নির্দেশাবলি। পক্ষান্তরে এই আইনের ১৮ থেকে ২২ ধারায় সমাধান, রেহাই বা সুরাহা সম্পর্কিত বিভিন্ন নির্দেশ জারিতে ম্যাজিস্ট্রেটদের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। পারিবারিক হিংসা সংশ্লিষ্ট বিষয়টি যদিও খুবই স্পর্শকাতর এবং একান্তই স্বামী-স্ত্রীর ব্যক্তিগত জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত কিন্তু ঘটনার বিভিন্ন দিক খতিয়ে বিভিন্ন ধারা প্রণয়নের জন্য বিশেষজ্ঞ বা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আধিকারিকের ভূমিকা এই আইনে নেই বলা চলে। পুরো বিষয়টাই মূলত দেখবে বিভিন্ন সরকারি কর্তৃপক্ষ যারা ইতিপূর্বেই নিজ নিজ কাজের চাপে ব্যস্ত যার অনিবার্য ফলস্বরূপ মবাস্তবিক পক্ষেই গার্হস্থ্য হিংসার মতো বড় একটি গুরতর বিষয়ে যথেষ্ট সময় দেওয়া প্রায় অসম্ভব তাদের কাছে।
এই লেখকের বিভিন্ন স্তরে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে বলেই বলছি, বহুক্ষেত্রেই দেখা গেছে, একজন মহিলা হয়তো ঘর থেকে বেরিয়ে ওই ঘরের সদস্যদের বিরুদ্ধে পারিবারিক হিংসার অভিযোগ দায়ের করেছেন, কিন্তু তিনি ওই আইন সম্পর্কে মোটেই অবহিত নন এবং শেষমেষ আবার ওই ঘরেই ফিরে গেছেন। যাদের বিরুদ্ধে তিনি অভিযোগ এনেছিলেন তাদের কাছেই তার ফিরে যেতে হয়েছে। যদিও মহিলা-সুরক্ষামূলক এই আইনের পরিকল্পনায়, গার্হস্থ্য হিংসার কারণে ক্ষুব্ধ বা নিপীড়িত মহিলাকে বিশেষ শেল্টার হোমে অস্থায়ীভাবে রেখে প্রয়োজন তার চিকিৎসার সুযোগ করে দেওয়ারও সংস্থান রয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, বাস্তব ক্ষেত্রে এই ধরনের হোম আমাদের দেশে এখনও চালু হয়নি। যেমন কর্মী স্বল্পতা, দুর্বল, সচেতনতা আর্থিক কাঠামো বা তহবিল। এছাড়াও রয়েছে হিংসার শিকার বহু ভুক্তভোগী মহিলার ভিড়। সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোর দশাও তথৈবচ। আইনি সচেতনতার অভাবে এরকম অনেক নির্যাতিতা মহিলাই অবগত নন যে তাদের সুরক্ষা ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাকে মেনে নিয়ে বাধ্য হয়ে তাকে আবার ওই লোক/লোকগুলোর কাছেই ফিরে যেতে হবে। যার/যাদের বিরুদ্ধে মামলা করে তিনি তাকে/তাদেরকে রাগান্বিত/ক্ষুব্ধ করেছেন। যে-কোনো পারিবারিক সমস্যার অপেক্ষাকৃত সন্তোষজনক সমাধান সূত্র রয়েছে সেই পরিবারের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনদের হাতেই।
বাইরের কোনো কর্তৃপক্ষের ভূমিকার চেয়ে ওদের সহনশীল ও আত্মিক ভূমিকাই সমধিক গুরুত্বপূর্ণ, কার্যকর এবং সুফলদায়ী। একজন মহিলা ঘরের বাইরে সংশ্লিষ্ট কোনও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের যেমন কৌঁসুলি, পুলিশ অফিসার, নিয়োগ কর্তা, ম্যাজিস্ট্রেট, সুরক্ষা আধিকারিক এদের দ্বারস্থ হয়ে মামলা করা মানেই সমস্যাটি প্রকাশ্যে এসে গেল তখন কিন্তু এই সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া পুরোপুরিই ওইসব কর্তৃপক্ষের সম্মিলিত প্রয়াসের উপর নির্ভরশীল হয়ে যায়। এর ফলে সমস্যার দ্রæত সমাধান প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। কারণ দায়িত্বপ্রাপ্ত বাইরের কর্তৃপক্ষসমূহ আরও বহু সরকারি কাজে ব্যস্ত থাকেন। এক্ষেত্রে সমাধান খুব স্বাভাবিক কারণেই বেশ জটিলও হয়ে যাওয়ার সমস্যা রয়েছে। এক্ষেত্রে আরও গুরুত্বপূর্ণ হল সব কর্তৃপক্ষ তো আর সমান সহানুভূতিশীল, বিবেচক বা দরদি নন।
এ হতেও পারে না। পারিবারিক হিংসার মতো একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের অভিন্ন মানসিকতা আশাও করা যায় না। অনুভূতি, উপলব্ধি এবং সমস্যা মূল্যায়নে একের সাথে আর একের বিস্তর ফারাক থেকেই যায়। ফলে, সার্বিক পরিস্থিতির নিরিখে, বাস্তব চিত্রের প্রেক্ষিতে একথা বলা বোধহয় অবান্তর হবে না যে, এহেন সমস্যার প্রকৃত সমাধান সরকারি সংস্থাগুলোর হাতে নয়। সমস্যার সুফলদায়ী সমাধান মূলত তার উপর নির্ভরশীল যার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে কিংবা পরিবারের সেই সদস্যদের উপর যারা এক সময় পারস্পরিক শত্রুতায় ঘরের পরিবেশ বিষিয়ে তুলেছিল। পারিবারিক হিংসার শিকার মহিলাদের সুরক্ষায় প্রণীত এই আইনে সংস্থান রাখা হয়েছে কাউন্সেলিংয়েরও। কিন্তু অভিযোগ নথিভুক্ত হওয়ার পরই ম্যাজিস্ট্রেটরা অভিযোগকারিণী এবং সংশ্লিষ্ট পরিবারের অভিযুক্তদের পরামর্শদানে মুখোমুখি হতে পারেন। অভিযোগ দায়ের করার আগে ম্যাজিস্টেটদের কোনো ভূমিকা নেই। এই লেখকের অভিমত হল, ঘটনার প্রথমাবস্থাতেই যদি কোনো জনকল্যাণমূলক কেন্দ্রে-যেমন ক্লাব, আইনজীবীদের কার্যালয়, এনজিও, এনজিওর কার্যালয়-এমনকি কোনো হিতাকাক্সক্ষী বাড়ি বা প্রবীণ কোনো শান্তিকামী ব্যক্তির বাড়িতে উভয় পক্ষকে নিয়ে আলোচনা বা কাউন্সেলিং শুরু করা যায় তবে সমস্যার সমাধান আরও বেশি মিলবে। অস্বস্তি ভোগান্তি এমনকি আর্থিক ব্যয়বাহুল্য থেকেও পরিবারগুলো বেঁচে যাবে।
তাছাড়া, সবক্ষেত্রেই যে পুরুষ বা স্বামীই সব সংঘাত-সমস্যার জন্য দায়ী তা কিন্তু নয়। অনেক ক্ষেত্রে মহিলার নিজস্ব মতামত, যৌথ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে থাকার অনিচ্ছা বা যৌথ পরিবারেই থাকার অনিচ্ছা এবং স্বামীকে আলাদাভাবে নিয়ে থাকার ইচ্ছা ইত্যাদি সমস্যার আসল কারণ। কিন্তু আইনটি মহিলাদের জন্য তৈরি হওয়ায়, এই মানসিকতার মহিলারা হয়তো ভাবেন, মামলা করলে সব পেয়ে যাবেন। কীভাবে কতটুকু কষ্ট করে, কতটুকু হারিয়ে শেষ-মেশ কতটুকু পাবেন তা তারা বুঝতে পারেন না। মামলা করার আগে দুই পক্ষকে নিয়ে মীমাংসায় বসে দুই পক্ষকেই মামলার বাস্তব সুবিধা ও অসুবিধা বুঝিয়ে দিলে অন্তত কিছু ক্ষেত্রে উভয় পক্ষই মীমাংসায় আসবে আশা করা যায়। নাহলে মহিলা মামলাতো করতেই পারেন।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, অভিযুক্ত বা অভিযুক্তদের জামিন পাওয়ার বিষয়টি অবশ্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ম্যাজিস্ট্রেটের স্বাধীন ও নিজস্ব বিচার প্রক্রিয়ার ওপর। মামলা হলে মীমাংসা করে মামলা শেষ করা যাবে না বলা হয়ে থাকে। কিন্তু এক্ষেত্রে দেখা যায়, আইনি সংস্থানের অপব্যবহার করেন বহু গৃহবধূ এবং তাদের আত্মীয়স্বজনরা। পেশাদারি উপদেষ্টাদের ভুল পরামর্শও অনেক ক্ষেত্রে এর কারণ। আবার আমাদের দেশে বিচার প্রক্রিয়াও দীর্ঘসূত্রী, প্রলম্বিত এবং ব্যয়সাপেক্ষ হওয়ায় দিনের পর দিন বিবাদী পক্ষকে নিকট আত্মীয়স্বজনসহ আদালতের আইনি প্রক্রিয়ায় আটকে থাকতে হয়। এমনকি, বয়স্ক অভিভাবকদেরও হয়রানির শিকার হতে হয়। বহু মেয়ের বিবাহের সম্ভাবনাও প্রশ্নের মুখে পড়ে যায়। বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে বহু মেয়েই বিপন্নতা ও অশনিসংকেতে ভুগতে থাকে।
আমার সুস্পষ্ট অভিমত হল, গৃহবধূ বা পরিবারের যে-কোনো মহিলার সার্বিক কল্যাণের কথা বিবেচনা করে প্রথমেই থানায় বা আদালতে অভিযোগ দায়ের না-করে নির্ভরযোগ্য কোনো মধ্যস্থতার মাধ্যমে, দ্বি-পাক্ষিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে সমস্যার সমাধান করার চেষ্টাই হবে অপেক্ষাকৃত শ্রেয়। অভিযোগ দায়ের হওয়া উচিত একেবারে শেষ পর্যায়ে যখন আর কিছু করার নেই, কারণ পারিবারিক চৌহদ্দির বাইরে বিষয়টিকে নিয়ে যাওয়া মানেই সরকারি কোনো কর্তৃপক্ষ বা অন্যের হাতে সমস্যাটিকে তুলে দেওয়া। এর ফলে সেই মামলা তার নিজস্ব গতিতে ও প্রক্রিয়াতেই চলবে যা প্রলম্বিত হতে বাধ্য। ফলে ভুক্তভোগী বা হিংসার শিকার মহিলা এবং তার আত্মীয়স্বজনদের হাতে মামলার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখাটা অসম্ভব। শুধু কি তাই?
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বিশেষ কিছু না-দেখে এবং বাস্তব অবস্থা উপলব্ধি করে যদি বা শেষপর্যন্ত নির্যাতিত মহিলা কোনো মীমাংসায় আসতে চান তখন স্বামী-স্ত্রীর ভেঙে যাওয়া স্বাভাবিক সম্পর্কের পুনরুদ্ধারে স্বামী ও তার পরিবারের লোকদের মামলার প্রক্রিয়াগত যন্ত্রণার পুঞ্জিভূত দুঃসহ স্মৃতি ও ঘটনাপ্রবাহ কিন্তু সমস্যা সমাধানে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অভিযোগ দায়ের করার এখানেই আসল বিপত্তি। একজন নির্যাতিত বা পীড়িতা মহিলা এটা যখন বুঝতে পারেন তখন ক্ষতি যা হওয়ার হয়েই গেছে।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন