(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
রাসুল (সা.)-এর সহিষ্ণুতা : মহানবী (সা.)- এর ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার অবস্থা এমন ছিলো যে, সমস্ত সাহাবায় কেরামদের ধৈর্যও একত্রে তার সমকক্ষ হবে না। এর একটি নমুনা হজরত আবু হুরায়রা (রা.)-এর বর্ণনায় পরিলক্ষিত হয়। তিনি বলেন, ‘একবার এক বেদুঈন মসজিদে পেশাব করে দিলো। সাহাবিরা এ কান্ড দেখে রাগে রোষে তেড়ে এলেন। রাসুল (সা.) তখন তাদের থামিয়ে বললেন, ‘তাকে তোমরা ছেড়ে দাও। যেখানে সে পেশাব করেছে, তাতে পানি ঢেলে দাও। স্মরণ রেখো, তোমাদের আসানী সৃষ্টিকারী হিসেবে পাঠানো হয়েছে। দুর্বিষহ বিড়ম্বনা সৃষ্টিকারী হিসেবে নয়।’ (বোখারি, কিতাবুল অজু)
রাসুল (সা.)-এর বদান্যতা : বদান্যতা-দানশীলতা একটি মহৎ গুণ। এর পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রতিফলন মহানবী (সা.)-এর মাঝেই ঘটেছিলো। প্রিয়নবী (সা.) নিতান্তই দরিদ্র্য ও অসহায়ের ন্যায় দিনাতিপাত করতেন। তথাপি পৃথিবীর কোনো রাজা-বাদশাহের দান দক্ষিণা তার ধারে কাছে পৌঁছতে পারেনি। এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ মিলে তিরমিজি শরিফে। নবীজি (সা.)-এর কাছে একবার নব্বই হাজার দিরহাম আসলে তিনি একটি মাদুরের উপর উপবেশ করে সেখান থেকে সমুদয় দিরহাম বণ্টন করে দিলেন। বণ্টণ শেষ হওয়ার পরক্ষণেই এক ভিখারি এসে হাজির। নবী কারিম (সা.) বললেন, ‘আমার কাছে এখন কিছুই নেই। তাই আমার নাম বলে কারো কাছ থেকে কিছু নিয়ে নাও। পরে আমি তা পরিশোধ করে দিবো।’ ( খাসায়েলে নববী)
ইয়াতিম-অসহায়দের প্রতি দয়া : রাসুল (সা.) ইয়াতিম ও অসহায়দের প্রতি অপরিসীম দয়া-অনুকম্পা ও অনুগ্রহ প্রদর্শন করতেন। বহু অনাথের মুখে তিনি মধুর হাসি ফুটিয়েছেন। একবার ঈদগাহে যাওয়ার পথে ইয়াতিম এক বাচ্চাকে কাঁদতে দেখে প্রিয় নবীজি তাকে আদর দিয়ে দুঃখ-দুর্দশার কথা জিজ্ঞেস করলেন। সব শুনে রাসুল (সা.) তাকে নিজ বাড়িতে নিয়ে এলেন। গোসল করিয়ে সুন্দর কাপড় পরিয়ে ঈদগাহে নিয়ে গেলেন। অনন্তর তাকে বললেন, ‘হে বৎস! আমি যদি তোমার বাবা হই, আয়শা যদি তোমার মা হয় আর ফাতেমা যদি তোমার বোন হয়, তাহলে কি তুমি সন্তুষ্ট?’ ছেলেটি সমস্বরে জবাব দিলো, হ্যা, অবশ্যই। এবার তার রসনায় আনন্দের হাসি বিকশিত হলো।
অমুসলিমদের প্রতি সদাচার : রাসুল (সা.) মুসলমান এবং ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের প্রতি যেরূপ সদাচারণের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতেন, তদ্রæপ অমুসলিম বা অন্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গেও করতেন এবং সর্বদা তাদের প্রতি সৎ মনোভাব প্রকাশ করতেন। একবার এক ইহুদি আল্লাহর হাবিবকে মারতে এসে তার মেহমান বনে গেলো। রাতে রাসুল (সা.) যথাসাধ্য আপ্যায়ন করে শোয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। কিন্তু শয়ন প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করে ইহুদি লোকটি বিছানায় পায়খানা করে চলে গেলো। সকালে হুজুর (সা.) তার কোনো সন্ধান পেলেন না। রাসুল (সা.)-এর চেহারা মুবারক মলিন হয়ে গেলো। আফসোস আর আক্ষেপ করে বলতেছিলেন, ‘হায়! আমি বুঝি তার যথাসাধ্য আপ্যায়ন করতে পারিনি’। এমনিভাবে একবার এক বেদুঈন এসে প্রিয়নবী (সা.)-এর চাদর ধরে এতো জোরে টনতে লাগলো যে, গলায় ফাঁস লাগার উপক্রম হলো এবং জোর গলায় বলতে লাগলো, ‘হে মুহাম্মদ! আমাকে কিছু দাও’। রাসুল (সা.) তখন তার দিকে ফিরে হেসে কিছু দেয়ার নির্দেশ দিলেন। (বোখারি, মুসলিম)
জীবজন্তুর প্রতি সদাচার : প্রিয়নবী (সা.) শুধু মানুষের প্রতিই সদাচারণ করেছেন, এমন নয়। বরং তিনি আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সৃষ্ট অন্যান্য প্রানী ও জীবজন্তুর প্রতিও অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত সদাচারণ প্রদর্শন করতেন। একবার এক সফরে দুজন সাহাবি একটি পাখির বাসা থেকে দুটি পাখির ছানা নিয়ে এলেন। মা পাখিটি তার বাচ্চার সঙ্গে সঙ্গে করুণ সুরে মুক্তির আবেদন জানাতে লাগলো। প্রিয় নবীজি এ অবস্থা দেখে বললেন, ‘এ পাখি ধরে কেনো এই মা পাখিটাকে অধীর করে তুলেছো? বাচ্চা দুটি ছেড়ে দাও। উভয়ে বাচ্চা দুটি ছেড়ে দিলো। ( সিরাতুন্নবী : ৬/২৪১) বলা বাহুল্য, জীবজন্তুর ব্যাপারে হুজুর (সা.) উম্মতকে বিস্তারিত নির্দেশনা দিয়েছেন। জীবজন্তুর প্রতি দয়া, অনুগ্রহ, তাদের দানা-পানির ব্যবস্থা এবং ওগুলোকে সাধ্যের অতিরিক্ত কষ্ট না দেয়ার হুকুম দিয়েছেন।
শ্রেণী ও বর্ণবৈষম্য দূরীকরণে রাসুল (সা.) : পৃথিবীর বুকে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অন্যতম মূল কারণ হচ্ছে, মানবজাতির মধ্যে শ্রেণী ও বর্ণবৈষম্য। এর ফলে মানুষ হারিয়ে ফেলে ভ্রাতৃত্ববোধ, বিলীন হয়ে যায় তাদের মধ্যকার পারস্পরিক মায়ামমতা, বন্ধুত্ব ও সৌহার্দপূর্ণ মধুর সম্পর্ক। তাদের জীবনে নেমে আসে শ্রেণী ও বর্ণবৈষম্যের ঘোর অন্ধকার। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত প্রিয়নবী (সা.)-এর আগমনের পূর্বে গোটা পৃথিবী শ্রেণী ও বর্ণবৈষম্যের অতল তলে নিমজ্জিত ছিলো। এর ফলে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ছিলো চরম অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্র পর্যায়ে যুদ্ধংদেহী মনোভাব, এমনকি এর ফলে সামান্য কোনো তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে প্রতিহিংসার কারণে বছরের পর বছর ধরে চালিয়ে যেত ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ। রসুল (সা.) পৃথিবী থেকে এই শ্রেণী ও বর্ণবৈষম্য দূরীকরণের লক্ষে আল কুরআনের নির্দেশ বাস্তবায়ন করাই ছিলো তার দায়িত্বসমূহের মধ্যে অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। ফলে ইতিহাস সাক্ষী, মহানবী (সা.)-এর আমলে মদিনায় ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর সেখানে কোনোরকম শ্রেণী ও বর্ণবৈষম্যের লেশ মাত্রও ছিলো না। অধুনা বিশ্বে এই অশান্ত, অস্থিতিশীলতা শ্রেণী ও বর্ণবৈষম্য দূর করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার একমাত্র উপায় হচ্ছে রাসুল (সা.)-এর অনুসরণ ও আনুগত্য।
মহানবী (সা.)-এর সুন্নাহর আদর্শ সর্বজনীনতায় দিগন্ত বিস্তৃত। আমরা যদি এ দিকসমূহের বাস্তবায়নে দৃষ্টি দেই, তাহলে দেখবো রাসুল (সা.) তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণের মাধ্যমে তা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ফলে অল্পকালের মধ্যেই ইসলামি সভ্যতা সংস্কৃতির শীর্ষচারী অবস্থান মানবজাতি প্রত্যক্ষ করেছে। এ জয়যাত্রার আওতায় যেসব জনপদ এসেছে, সেসব এলাকার জনসাধারণ মহানবীর অনুসারীদের সালাম জানিয়ে গ্রহণ করেছে। যুগ যুগ ধরে, শতাব্দীর পর শতাব্দী কাল পরিক্রমায় যে মানুষ শোষিত-বঞ্চিত, নির্যাতিত-নিপীড়িত ছিলো, তাদের শোষণ-বঞ্চনা, অত্যাচার-নিপীড়নের অবসান ঘটলো। সৃষ্টি হলো ধর্ম-বর্ণ এবং আর্থ সামাজিক শ্রেণী নির্বিশেষে সানন্দ সহাবস্থানের মানব পরিবেশ, বাস্তবে সর্বজনীনতা।
পবিত্র কুরআনে যত সুন্দর, সত্য, সততা, মানবতা ও কল্যাণময় গুণাবলীর কথা বলা হয়েছে, তার নিখুঁত নিখাদ ও পরিপূর্ণ চিত্রায়ন ঘটেছিলো রাসুল (সা.)-এর জীবনাদর্শে। মানব সমাজের উন্নতি, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থিক ও চারিত্রিক সকল ক্ষেত্রে গৌরবময় উত্তরণের পথই হলো অনুসরণীয় আদর্শ। আদর্শহীন কোনো জনগোষ্ঠী পৃথিবীতে সমাদৃত হতে পারে না। তাই আজকের এই করুণ ও অবক্ষয় মুহূর্তেও যদি মুসলিম উম্মাহ ফিরে পেতে চায় তাদের হারানো অতীত, তাহলে তাদের অনুসরণ করতে হবে প্রিয়নবী (সা.)-এর পবিত্র জীবনাদর্শ। সুতরাং সেই আদর্শের পথেই হোক আমাদের নব যাত্রা। আদর্শিক প্রত্যয়ে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠুক আমাদের সমাজ জীবন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন