বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও সাবেক সেনাপ্রধান এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান (বীরউত্তম) এর আজ ৮২তম জন্ম বার্ষিকী। বাংলাদেশের জন্ম, বিকাশ এবং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও স্বনির্ভরতা অর্জন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতিটি ধাপের সাথে জড়িয়ে আছে তাঁর নাম। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন এবং পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে রণাঙ্গনে সরাসরি যুদ্ধ পরিচালনা করেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ‘বীরউত্তম’ খেতাব প্রদান করে। মুক্তিযুদ্ধের পর জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হন এবং ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল গঠন করেন। তিনি চার বছর বাংলাদেশ শাসন করার পর ১৯৮১ সালের ৩০ মে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন।
জিয়াউর রহমান ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি বগুড়া জেলার বাগবাড়ী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ডাক নাম ছিলো কমল। পিতার নাম ছিল মনসুর রহমান এবং মাতার নাম ছিল জাহানারা খাতুন ওরফে রানী। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে জিয়াউর রহমান ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর পিতা তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের কলকাতা শহরে এক সরকারি দপ্তরে রসায়নবিদ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন উত্তাল সময়ে তাঁর শৈশবের কিছু সময় বগুড়ার গ্রামে অতিবাহিত হয় এবং এসময় স্থানীয় স্কুলে অধ্যয়নও করেন। ১৯৪৭ সালে ভারতভাগের পর তাঁর পিতা চাকরিসূত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি শহরে চলে যান। তখন জিয়া করাচির একাডেমি স্কুলে ভর্তি হন। ঐ স্কুল থেকে তিনি ১৯৫২ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে মাধ্যমিক, তারপর ১৯৫৩ সালে করাচিতে ডি. জে. কলেজে ভতির্র পর একই বছরে তিনি কাকুল মিলিটারি একাডেমিতে অফিসার ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৫৫ সালে তিনি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশনপ্রাপ্ত হন। সামরিক বাহিনীতে তিনি একজন সুদক্ষ প্যারাট্রুপার ও কমান্ডো হিসেবে সুপরিচিতি লাভ করেন এবং স্পেশাল ইন্টেলিজেন্স কোর্সে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। করাচীতে দুই বছর চাকরি করার পর ১৯৫৭ সালে তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলি হয়ে আসেন। তিনি ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগ (আইএসআইএ) কাজ করেন।
১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে অংশ নেয়া ছিল তাঁর সেনাজীবনের স্মরণযোগ্য ঘটনা। ওই যুদ্ধে একটি কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে খেমকারান সেক্টরে তিনি ও তাঁর অনুগত বাঙালী সৈনিকরা অসীম বীরত্বের পরিচয় দেন। যুদ্ধের পরে সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য পাকবাহিনীর যেসব কোম্পানি সর্বাধিক বীরত্বসূচক পুরস্কার লাভ করে, জিয়াউর রহমানের কোম্পানি ছিল এদের মধ্যে অন্যতম। এই যুদ্ধে বীরত্বের জন্য পাকিস্তান সরকার জিয়াউর রহমানকে হিলাল-ই-জুরাত খেতাবে ভূষিত করে। এছাড়াও জিয়াউর রহমানের ইউনিট এই যুদ্ধে বীরত্বের জন্য দুটি সিতারা-ই-জুরাত এবং নয়টি তামঘা-ই-জুরাত পদকসহ মোট ১১টি পদক লাভ করে।
এই যুদ্ধের পরে বিশ্বের সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় বাঙালীরা ভীতু ও কাপুরুষ নয়, তারা যুদ্ধ করতে জানে, প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করতে পারে। আরেকটি বিষয় ওই সময় বাঙালীরা অনুভব করে, পাকিস্তানিরা কেবল পশ্চিমের প্রতিরক্ষা নিয়েই ভাবে পূর্বদিকের নিরাপত্তা বিষয়ে তারা আগ্রহী নয়। ফলে ৬৬ থেকে দুর্বার হয়ে ওঠে ৬ দফা ও স্বাধীকার আন্দোলন। জনমত ক্রমশ ঝুঁকে পড়ে আওয়ামী লীগ তথা বঙ্গবন্ধুর দিকে। ’৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরংকুশ বিজয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে অপরিহার্য ও অনিবার্য করে তোলে।
১৯৭০ সালে একজন মেজর হিসেবে তিনি চট্টগ্রামে নবগঠিত অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড পদের দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র বাঙালীদের ওপর বর্বরোচিত হামলা চালায় সে রাতে পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বন্দী হন। (পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ চলে যান আত্মগোপনে। জনগণ তখন দিশেহারা হয়ে পড়লেও সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্ন প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। এই সঙ্কটময় মুহূর্তে মেজর জিয়াউর রহমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করে বিদ্রোহ করেন। ২৬ মার্চ এবং ২৭ মার্চ তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।
যোদ্ধা হিসেবে তিনি বেতার ভাষণে বলেন ‘আমি, মেজর জিয়া, বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মির প্রাদেশিক কমান্ডার-ইন-চিফ, শেখ মুজিবর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। আমি আরো ঘোষণা করছি যে, আমরা শেখ মুজিবর রহমানের অধীনে একটি সার্বভৌম ও আইনসিদ্ধ সরকার গঠন করেছি যা আইন ও সংবিধান অনুযায়ী কর্মকান্ড চালিয়ে যেতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের সরকার জোট-নিরপেক্ষ নীতি মেনে চলতে বদ্ধপরিকর। এ রাষ্ট্র সকল জাতির সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখবে এবং বিশ্বশান্তির জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। আমি সকল দেশের সরকারকে তাদের নিজ নিজ দেশে বাংলাদেশের নৃশংস গণহত্যার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার আহŸান জানাচ্ছি। শেখ মুজিবর রহমানের সরকার একটি সার্বভৌম ও আইনসম্মত সরকার এবং বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পাবার দাবিদার।’
মেজর জিয়ার এই ঘোষণা ভারতীয় সম্প্রচার মাধ্যম এবং বিবিসি ঘনঘন প্রচার করলে মুক্তিযুদ্ধের গতি ও ব্যাপকতা তীব্রতর হয়। তিনি ও তাঁর বাহিনী লড়াইয়ের ময়দানে সব সময় সামনের সারিতে থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন এবং বেশ কিছু সময় তাঁরা চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চল মুক্তিযোদ্ধাদের নিযন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হন। পরে অবশ্য পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অভিযানের মুখে কৌশলগতভাবে তাঁরা সীমান্ত অতিক্রম করেন। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে ওই সরকার প্রথমে তাকে ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দেয়। তিনি চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, রাঙ্গামাটি, মিরসরাই, রামগড়, ফেনী প্রভৃতি স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেন। তিনি সেনা-ছাত্র-যুব সদস্যদের সংগঠিত করে পরবর্তীতে ১ম, ৩য় ও ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এই তিনটি ব্যাটালিয়নের সমন্বয়ে মুক্তিবাহিনীর প্রথম নিয়মিত সশস্ত্র ব্রিগেড জেড ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে জিয়াউর রহমান, যুদ্ধ পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালের এপ্রিল হতে জুন পর্যন্ত ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার এবং তার পর জুন হতে অক্টোবর পর্যন্ত যুগপৎ ১১ নম্বর সেক্টরের ও জেড-ফোর্সের কমান্ডার হিসেবে তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি একাধিক বিদেশি মিডিয়ায় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হিসেবে ইন্টারভিউ দেন, যা বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বে জনমত গড়ে উঠতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। বিভিন্ন ভারতীয় গণমাধ্যমে জিয়াউর রহমান ও সঙ্গীদের বিভিন্ন সাহসিকতাপূর্ণ অভিযানের বিবরণ প্রকাশিত হয়।
স্বাধীনতার পর প্রত্যাশা অনুযায়ী তাকে বঙ্গবন্ধু সেনাপ্রধান না করলেও তিনি একজন অনুগত দেশপ্রেমিক সেনাকর্মকর্তা হিসেবে সেনাবাহিনী পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। নির্লোভ ও সৎ জীবনযাপন, রাজনীতি থেকে দূরে থাকায় জুনিয়র অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী হয়ে উঠে। ’৭৫ এর মাঝামাঝিতে তাঁকে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান করে কার্যত সম্মানজনকভাবে (নাকি কৌশলে) কমান্ড থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। ওই বছরই আগস্টে বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে একদল সেনা সদস্যের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। মোশতাক সরকার অতঃপর সেনাপ্রধান শফিউল্লাহর মেয়াদ শেষে তার চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করে জিয়াকে সেনাপ্রধান করেন। তবে তিনি যেন সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তার না করতে পারেন সে জন্য জেনারেল ওসমানি ও জেনারেল খলিলুর রহমানকে বসিয়ে দেন। এ ধরনের খেলায় শেষ পর্যন্ত খালেদ মোশারফ উদ্যোগী হয়ে ক্যু করে জিয়াকে সেনাপ্রধান পদ থেকে সরিয়ে দেন, মোশতাক সরকারের পতন ঘটান এবং বঙ্গবন্ধুর খুনিদের স্বপরিবারে বিমানে বিদেশে পালানোর সুযোগ দেন। খালেদের এই পদক্ষেপ সাধারণ মানুষ ও সিপাহীদের কাছে ভারতপন্থী অভ্যুত্থান হিসেবে বিবেচিত হলে সংঘটিত হয় সিপাহী বিদ্রোহ বা সিপাহী জনতার বিপ্লব, যার অনিবার্য নায়ক হয়ে ওঠেন জিয়াউর রহমান। দেশেবাসী আবার শুনতে পায় একটি বরাট কণ্ঠ, ‘আমি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বলছি ...’। দেশবাসী জিয়াকে মেনে নেন। বিস্ময়করভাবে জিয়াউর রহমান পূরণ করেন বঙ্গবন্ধুর শূন্যতা। ’৭৫ পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমান যে বিপুল জনপ্রিয়তা ও আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আবির্ভূত হন ইচ্ছা করলে তিনি সাদ্দাম হোসেন , গাদ্দাফী, জেনারেল নে উইন বা সুহার্তোর মত আজীবন বা দীর্ঘকালীন প্রেসিডেন্ট বা অন্যকোন পদে থাকতে পারতেন। তিনি কিন্তু সে পথে যাননি। তিনি হেঁটেছেন গণতন্ত্রের পথেই। সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য এই জনপ্রিয় সেনাপতি ও নেতার বিরুদ্ধে ছোট বড় ১৮ বা ১৯টি অভ্যুত্থান ঘটায়, যার একটিতে তিনি শাহাদতবরণ করেন।
১৯৮১’র মে মাসের ৩০ তারিখের কালো রাতে নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হয়ে জিয়ার উজ্জ্বল, বর্ণাঢ্য জীবনের সমাপ্তি হলেও তার জনপ্রিয়তা একটুকু কমেনি।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও নির্বাহী সদস্য
বগুড়া প্রেসক্লাব
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন