সুনামগঞ্জের সব হাওরে এখন সবুজ ফসলের সমারোহ। এবার সময়মতো বৃষ্টিপাত হওয়ায় বোরো ধানের ফলন ভালো হয়েছে। ধান গাছ সবুজ-সতেজ রূপ ধারণ করেছে। গাছে থোড় ধরেছে। চোখজুড়ানো ফসল দেখে কৃষক ব্যাপক আশায় বুক বেঁধেছে। তারা অপেক্ষায় আছে, বৈশাখে পাকা ধান ঘরে তুলবে। তবে তাদের এই আশার মাঝে শঙ্কা হয়ে আছে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত, অকাল বন্যা এবং পাহাড়ি ঢল। তাদের এই শঙ্কার কারণ, হাওর রক্ষা বাঁধের সংস্কার কাজ ঠিকমতো না হওয়া। তারা দেখছে, বাঁধ নির্মাণে কোটি কোটি টাকা খরচ হচ্ছে ঠিকই, তবে তা যথাযথভাবে সংস্কার হচ্ছে না। নির্মাণ ও সংস্কারজনিত ত্রুটি কৃষকদের ভাবিয়ে তুলেছে। গতকাল দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার নিয়ে চলছে গাফিলতি। কৃষকরা অভিযোগ করছে, সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার, প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি ও পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষের গড়িমসির কারণে বাঁধ নির্মাণ সময়মতো শেষ হয়নি। বাঁধ সংস্কার ও নির্মাণ কাজ গড়ে ৬০ ভাগের মতো সম্পন্ন হয়েছে। তাও আবার ত্রুটিযুক্ত। এ অবস্থায় বেশি বৃষ্টিপাত এবং অকাল পাহাড়ি ঢল ও বন্যা হলে এসব বাঁধ লাখ লাখ হেক্টর জমির ফসল রক্ষা করতে পারবে না। কৃষকদের সব আশা-আকাক্সক্ষা ও শ্রম প- হয়ে যাবে। ফসলের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হবে।
ফসল রক্ষা, উপকূলীয় অঞ্চল রক্ষা এবং নদীর ভাঙন ঠেকানো বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারে অনিয়ম, দুর্নীতির বিষয়টি নতুন নয়। এসব বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারে প্রতি বছর শত শত কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। প্রতিবারই দেখা গেছে, বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় হয়েছে, অথচ বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার যথাসময়ে যথাযথভাবে হয়নি। বর্ষা মৌসুমে জোয়ার-জলোচ্ছ্বাস ও পানির তীব্র ¯্রােতে বেশিরভাগই বালির বাঁধের মতো ভেসে যায়। এতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতির পাশাপাশি মানুষের বসতভিটা তলিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে জানমালেরও ক্ষতি সাধিত হয়। এর দায় বাঁধ নির্মাণকারীদের কখনো নিতে দেখা যায়নি। তাদের গাফিলতি ও দুর্নীতির কারণে কৃষক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ যে পানিতে ভেসে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে, এ নিয়ে না তাদের কোনো বিচলন রয়েছে, না তারা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে। ফলে বছরের পর বছর ধরে হাওর, নদীতীরবর্তী উপকূল ও দ্বীপাঞ্চলের কোটি কোটি মানুষকে এক অনিশ্চিত জীবনযাপন করতে হচ্ছে। শুধু তাই নয়, ঠিকমতো বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার না করায় প্রতিবছর দেশ অনেক ভূমি হারাচ্ছে এবং লাখ লাখ মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছে। অথচ এসব বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের জন্য অর্থের কোনো অভাব হচ্ছে না। যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হচ্ছে, তাই বরাদ্দ করা হচ্ছে। সময়ও বেঁধে দেয়া হচ্ছে। আমরা দেখছি, বরাদ্দকৃত অর্থ সময়মতো ব্যয় করা হচ্ছে না। শুকনো মৌসুমে বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার করার কথা থাকলেও অধিকাংশ কাজই শুরু করা হয় বর্ষার ঠিক আগে আগে, না হয় ভরবর্ষায়। এর কারণ যে এসব কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু কর্মকর্তা ও ঠিকাদারের দুর্নীতির অভিপ্রায়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বর্ষা মৌসুম শুরুর আগে বা বর্ষায় কাজ শুরুর অর্থই হচ্ছে, একদিকে বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার হবে, অন্যদিকে তা ভেঙে যাবে এবং পুনরায় অর্থ বরাদ্দ হবে। এতে লুটপাটের পথ মসৃণ থাকবে। সুনামগঞ্জ হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রেও সময়মতো কাজ শেষ না করার পেছনে এ ধরনের প্রবণতা লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। হাওর রক্ষা বাঁধের কাজ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শেষ করার কথা থাকলেও পানি উন্নয়ন বোর্ড তা শেষ করতে পারেনি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা হাওরের বাঁধের ৮০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলে দাবি করলেও কৃষকরা তাদের এ দাবির সাথে একমত নয়। তারা বলছে, প্রতিটি হাওরের বাঁধে গড়ে ৬০ ভাগের বেশি কাজ হয়নি। কৃষকরা এ কথাও বলছে, যেসব বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার করা হচ্ছে, সেগুলোর মাটি নেয়া হচ্ছে বাঁধের কাছ থেকে। এর ফলে পাহাড়ি ঢল বা বন্যার পানির তোড়ে এসব বাঁধ ভেঙে যেতে পারে। এ প্রেক্ষিতে কৃষকরা শঙ্কায় আছে, তাদের কষ্টে ফলানো ফসল সঠিক সময়ে ঘরে তুলতে পারবে কিনা।
সঠিক সময়ে সঠিকভাবে বাঁধ সংস্কার ও নির্মাণকাজ করার তাগিদ বিশেষজ্ঞরা বরাবরই দিয়ে আসছেন। তাদের এ তাগিদ যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ খুব একটা আমলে নিচ্ছে না, তা তাদের কাজের ধরন দেখেই বোঝা যায়। মনে করা যুক্তিসঙ্গত যে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কৃষকসহ উপকূলীয় কোটি কোটি মানুষের জীবনমরণ সমস্যার চেয়ে গুটিকয় দুর্নীতিবাজ ব্যক্তির স্বার্থই বড় করে দেখছে। তা না হলে বছরের পর বছর ধরে বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার নিয়ে এত অভিযোগ উঠবে কেন? কেনইবা কৃষক ও উপকূলবাসীকে সবসময় শঙ্কায় থাকতে হবে? এসব প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দরকার। একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজ ব্যক্তির কারণে সরকারের শত শত কোটি টাকা ভেস্তে যাবে আর কিছু লোক আঙ্গুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হবে, তা কোনোভাবেই বরদাশত করা যায় না। আমরা আশা করব, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের কাজ সময়মতো যথাযথভাবে সম্পন্ন হচ্ছে কিনা তা সরেজমিনে গিয়ে তদারকি করবে। এ কাজ করতে ব্যর্থ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কিছু লোকের গাফিলতি ও দুর্নীতির কারণে লাখ লাখ একর জমির ফসল ভেসে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেবে এবং কোটি কোটি মানুষ শঙ্কিত জীবনযাপন করবে, তা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন