এশিয়ার একমাত্র বৃহৎ প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতে মা মাছের বিচরণ শুরু হয়েছে বলে দৈনিক ইনকিলাবের খবরে বলা হয়েছে। সাধারণ নিয়মানুযায়ী, মুসলধারে বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের মধ্যে হালদায় মা মাছ ডিম ছাড়ে। গত কয়েক দিনে মেঘের গর্জন প্রবল বৃষ্টি ও পাহাড়ি স্রোতের কারণে হালদায় মা মাছের চলাচল শুরু হয়েছে বলে তীরবর্তী ডিম সংগ্রহকারীরা জানিয়েছেন। এদিকে মৎস্য বিভাগের পক্ষ থেকে ডিম সংগ্রহকারীদের জন্য হ্যাচারীগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখা হয়েছে। মা মাছের নিরাপত্তা ও নদী থেকে মা মাছ যাতে মারতে না পারে সে জন্য হালদা নদীর মদুনাঘাট হতে সত্তারঘাট পর্যন্ত ২৫/৩০ কিলোমিটার রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা পাহারা দেয়া হচ্ছে বলেও বলা হয়েছে। প্রতিবছর চৈত্র-বৈশাখ মাসে নানা প্রকার মা মাছ হালদা নদীতে ডিম দিয়ে থাকে। বিশেষ করে রুই, কাতলা, মৃগেল ও কার্প জাতীয় মাছ এখানে ডিম দেয়। বাংলা বছরের শেষপ্রান্তে সাঙ্গু নদী ও পোড়াকপালী, মগদায় খাল ও মাতামুহুরী, কর্ণফুলী নদীসহ হালদা নদীর সাথে সংযুক্ত বিভিন্ন নদী থেকে ডিম দিতে মা মাছগুলো হালদা নদীতে আসে। এইসব নদী এবং আশপাশের খাল ও নদীগুলোতে উপযুক্ত পরিবেশ না থাকাতে মা মাছ হালদা নদীতে আসে ডিম ছাড়তে।
হালদা নদীর গুরুত্ব লিখে বুঝাবার প্রয়োজন নেই। নদী হিসেবে এর গুরুত্ব যতখানি তারচেয়েও প্রাকৃতিক এই মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রের গুরুত্ব অনেক বেশি। দেশে এখন মাছের আকাল চলছে। মিঠা পনির মাছ দিন দিন কমে আসছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মতে, দেশে ৫৪ প্রজাতির মাছ চরম বিপণœ দশায় রয়েছে। সংকটাপন্ন প্রায় ১২০ প্রজাতির মাছ। ইতোমধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে ৪ প্রজাতির মাছ। বাজারে মিঠা পানির মাছ হিসেবে যা বিক্রি হচ্ছে, তার অধিকাংশই চাষের মাছ। এই মাছ নিয়ে যেসব সাবধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে তাতে এ ধরনের মাছ না খাবার পক্ষে অভিমত প্রকাশ করা হচ্ছে। বাস্তবতা হলো এসব না খেয়ে নগরবাসী বা দেশের মানুষের কোন উপায় নেই। ভারতের বৈরি পানিনীতির কারণে মাছের অভয় আশ্রমগুলো হারিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। সেই বিবেচনায় হালদানদীর গুরুত্ব অন্য অনেক বেশিই বলা যায়। রুইসহ কার্প জাতীয় মাছের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র এটি। এই নদীর রুই মাছের রেণু সারা দেশের চাহিদার ৮০ শতাংশ পূরণ করে। তবে বিভিন্ন নৈতিবাচক কর্মকা-ে নদীটি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের স্থাপিত রাবারড্যামের কারণে হালদার পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় মা মাছের ডিম ছাড়া কমে গিয়েছিল। অন্যদিকে যথাযথ উদ্যোগ ও পরিকল্পনা না থাকার কারণেও প্রাকৃতিক এই মৎস্য ভান্ডার হুমকির মুখে রয়েছে বলে খবরে বলা হয়েছে। মানবসৃষ্ট অনাসৃষ্টি হালদার অস্তিত্বের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রথমত পলি জমেছে এবং নদীর বাঁকগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নদীতে হাতজাল, ভাসাজাল, মশারিজাল, ইঞ্জিনচালিত নৌকা, অবৈধ বালি তোলার ড্রেজার মেশিন ব্যবহারের কারণেও নদীটি মাছের ডিম ছাড়ার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে স্রোতস্বীনি এই নদীর যে বাঁকগুলো মাছের নিরাপদ প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হতো গত ৬০ বছরে তা ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। এই বাস্তবতায় হালদানদী এবং হাওড়-বাঁওর খাল-বিল ও নদ-নদীতে মাছের অভয়াশ্রম সংরক্ষণে সচেতন হবার কোন বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে অবশ্যই সকলেরই মনে রাখা দরকার, কাজটা কারো একার নয়। সবাই মিলেই নদীর স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রাখতে হবে।
জীবনরক্ষার্থে সুস্থ জীবন যাপনে মানুষের জীবনে মাছের গুরুত্ব অপরিসীম। মাছ জীবন ধারণের একটি মৌলিক ও নিরাপদ উপাদান। প্রাকৃতিক মাছের মধ্যে ক্ষতিকারক কিছু নেই বললেই চলে। পৃথিবীব্যাপী মাছের ব্যাপক চাহিদা ব্যবহার রয়েছে। মাছকে কেন্দ্র করে আমাদের অর্থনীতির একটি বড় অংশ আবর্তিত হচ্ছে। সবকিছু বিবেচনা করেই এটা বলা যায়, যেহেতু আমাদের দেশে প্রাকৃতিক মাছের ঊৎসের এক বড় অংশের সরবরাহ আসে হালদা নদী থেকে, তাই হালদা নদী ও সেখানে মাছের অভয়াশ্রমকে অত্যাধিক গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা জরুরি। নদী তীরবর্তীরাসহ সকলেই এ ব্যাপারে সচেতন ও যতœবান হবে- এটাই প্রত্যাশিত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন