মোস্তফা শফিক কয়রা (খুলনা) থেকে : মানবেতর জীবনযাপন করছেন সুন্দরবনের মাঠ পর্যায়ের অতন্দ্র প্রহরী বনরক্ষীরা। সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। শেলা নদীতে ট্যাঙ্কার দুর্ঘটনার পর সুন্দরবন রক্ষায় বিশ্বজুড়ে হৈ চৈ পড়লেও বনকর্মীদের ভাগ্যোন্নয়নে সবাই নীরব। সুবিধাবঞ্চিত এসব বনরক্ষীরা নেই রেশনিং, নেই কোন ঝুঁকিভাতা। সুন্দরবন রক্ষায় তাদের অদম্য ইচ্ছা থাকলেও নানা প্রতিকূলতায় তা ব্যহত হয়।
সূত্র জানায়, বিশ্ব ঐতিহ্য ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন রক্ষায় নিয়োজিত বনকর্মকর্তা- কর্মচারীদের নেই ঝুঁকিভাতা, নেই দূর্গম ভাতা বা রেশনিং সুযোগ সুবিধা। তারপরও তারা জীবনবাজী রাখেন সুন্দনবন রক্ষায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা লবণপানিতে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। তাদের বেতন স্কেল সর্বনিম্ন পর্যায়ে থাকায় তাদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। এমনকি গহীণ বনে চাকরি বলে সরকারি ছুটিগুলোও তারা ভোগ করতে পারেন না পরিবারের সাথে। সুন্দরবনে চাকরিরত অবস্থায় বনবিভাগের কোন কর্মচারী মারা গেলে সরকারের পক্ষ থেকে কোন বেতন ভাতা দেয়া হয় না। অথচ পার্শ্ববতী দেশ ভারতের সুন্দরবনে কর্মরতদের ২ লক্ষ টাকা ঝুঁকি ভাতা দেয়া হয় বলে সূত্র জানিয়েছে। বনরক্ষীরা দীর্ঘদিন থেকে ঝুঁকি ও দুর্গম ভাতার জন্য বন মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন জানিয়ে যাচ্ছেন। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব পেশ করেন। সংসদীয় কমিটি প্রস্তাবটি যাচাই বাছাইও করেন। কিন্তু অজানা কারণে দীর্ঘ দিনেও প্রস্তাবটি আলোরমুখ দেখেনি।
সুন্দরবনের পশ্চিম বনবিভাগ খুলনা রেঞ্জের ভোমরখালী টহল ফাঁড়ির এক বনকর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিশ্ব ঐতিহ্য ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন শুধুই বাংলাদেশের সম্পদ নয়। এটি এশিয়া মহাদেশসহ সারা বিশ্বের সম্পদ। এ সম্পদ রক্ষায় তারা মাঠ পর্যায়ে জীবনবাজী রেখে ডিউটি পালন করেন। কিন্তু তাদের কোন মূল্যায়ন নেই। বনের ভেতর টহলের জন্য নেই কোন আধুনিক নৌযান। এক ফাঁড়ি থেকে অন্য ফাঁড়িতে দ্রæত কোন ভাবে পৌঁছানো যায় না। বনের ভিতর সব জায়গায় মোবাইল নেটওয়ার্ক কাজ করে না। তিনি আরো বলেন, বনদস্যু, বাঘ ও কুমিরের সঙ্গে লড়াই করে তাদের সুন্দরবনে কাজ করতে হয়। ইচ্ছা থাকলেও অনেক কাজ তারা করতে পারেন না। কারণ, ঝুঁকি ভাতা তো দুরের কথা ভাল কাজের কোন প্রশংসাও পাওয়া যায় না। দেশের অন্যান্য বাহিনীর ন্যায় ঝুঁকিভাতা ও রেশনিং সিস্টেম করা হলে বন রক্ষায় তারা আরও নিবেদিত হয়ে কাজ করতে পারবেন বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি আরো বলেন, ন্যূনতম বেতন স্কেরে চাকরি করতে হয়। তাই তাদের জীবন যাত্রার মানও অতি নিম্ন। দুগম ও ঝুঁকিভাতা প্রদানের প্রস্তাব কার্যকর করার জোর দাবি জানিয়েছেন তারা। সুন্দরবনের অনেক টহল ফাঁড়িতে থাকার জায়গা না থাকায় অনেক স্টাফরা বাধ্য হয়ে ছুটি কাটায়।
বন বিভাগ সূত্র জানা গেছে, ৬ হাজার ১৭ কিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ঠ সুন্দরবনের স্থলভাগের পরিমাণ ৪ হাজার ১৪৩ বর্গকিলোমিটার ও জলভাগের পরিমাণে ২ হাজার ৮৭৪ বর্গকিলোমিটার। সুন্দরবন বনবিভাগ পূর্ব ও পশ্চিম এ দুভাগে বিভক্ত। দু’বিভাগে মোট ৪টি রেঞ্জ রয়েছে। সুন্দরবনের মধ্যে শতাধিক খাল রয়েছে। এ সকল খাল নদী পরিদর্শন করার জন্য ৭৬টি ক্যাম্প ও মাত্র ১৭৮ জন বন প্রহরী আছেন। যা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যান্ত কম। সুন্দরবন রক্ষাণাবেক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত লোকবল ও সরঞ্জামাদি নেই।
সুন্দরবন অভ্যন্তরে রয়েছে অসংখ্য নদ-নদী, গাছ-পালা, পশু-পাখি, জীব-জন্তু ও অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদের ভাÐার। বনের অফুরন্ত ও সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের প্রতিটি মুহূর্তে অতন্দ্র প্রহরীর মতো ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করে চললেও সরকারিভাবে এদের না আছে বাড়তি কোন সুযোগ সুবিধা না পায় কোন ঝুঁকি ভাতা। অথচ একই দেশের দুর্গ পাহাড়ি এলাকায় কর্মরত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ (বিজিবি) এমনকি সুন্দরবন এলাকায় নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, র্যাব ও পুলিশ বিভাগের কর্মরত সদস্যদের জন্য সরকারিভাবে ফ্যামিলি রেশন, ঝুঁকি ভাতা দায়িত্ব পালনকালে মৃত্যুর জন্য অনুদানের ব্যবস্থাও রয়েছে। অথচ একই বনাঞ্চল সুন্দরবনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বনের সম্পদ রক্ষায় জীবনের ঝূঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করলেও তাদের জন্য সরকারিভাবে নেই কোন ঝুঁকি ভাতা বা সুযোগ সুবিধা। কর্মরতদের পক্ষে ঝুঁকি ভাতার জন্য করা আবেদন গত কয়েক বছর ধরে ফাইলবন্দি হয়ে রয়েছে সংশ্লিষ্ঠ মন্ত্রণালয়ে। ফলে সঠিক দায়িত্ব পালনের উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন কর্মরতরা। অপরদিকে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্য প্রাণীর আক্রমণ, চিকিৎসার অভাব ও জলদস্যুদের হামলায় গত দু’যুগে ১২ জন বনরক্ষীর মৃত্যু হয়েছে। ১৯৮৮ সালে কচিখালী অভ্যয়ারণ্য কেন্দ্রে বনপ্রহরী কওছার আলী, ১৯৯৮ সালে হরিণটানা ক্যাম্পের বনপ্রহরী জাফর আলী খান, ২০০৪ সালে চট্টগ্রাম উত্তর বনবিভাগের বাগানমালী আব্দুল মোতালেব, ২০০৫ সালে সুন্দরবনের নোওয়াবেঁকী টহল ফাঁড়ির বনপ্রহরী মাহবুবুর রহমান, ২০০৭ দুবলা চরের নৌকা চালক সাইদুর রহমান, ২০০৮ সালে গেওয়াখালী টহল ফাঁড়ির নৌকা চালক সুভাষ চন্দ্র মজুমদার, ঝালিয়া টহল ফাঁড়ির আবু বক্কর সিদ্দিক ও দুবলার চরের মোঃ হারুন অর রশিদ, ২০০৯ সালে মোঃ নজরুল ইসলাম, মরাভোলা ক্যাম্পের আফছার উদ্দীন মোল্যা, কচিখালী অভয়ারণ্যের ফরেস্টার আরফান আলী ও ঘাগরামারীর টহল ফাঁড়ির বনপ্রহরী আবুল বাশার কর্মস্থলে দায়িত্ব পালন কালে অপমৃত্যুর শিকার হন। অপমৃত্যুদের মধ্যে চিকিৎসার অভাবে, ৪ জন বনদস্যুদের গুলিতে, ২জন বাঘের আক্রমণে ও ১ জন জ্বলোচ্ছাসে মৃত্যুবরণ করেন।
ভুক্তভোগী বনকর্মীরা জানান, পুলিশ বিভাগের ন্যায় শতভাগ ফ্যামিলি রেশন, ঝুঁকি ভাতা, কর্মরত অবস্থায় নিহত পরিবারের জন্য এককালীন অনুদান এবং সুন্দরবনসহ অন্যান্য বন বিভাগের জন্য শতকরা ৩০ ভাগ দুর্গম ভাতা পাবার জন্য সংশ্লিষ্ট বন মন্ত্রণালয়ে একটি লিখিত আবেদন করা হলেও এ ব্যাপারে কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশ বনপ্রহরী কল্যাণ সমিতির সুন্দরনবন পশ্চিম আঞ্চলিক শাখার সভাপতি সৈয়দ অলিয়ার রহমান মিলন জানান, তাদের দাবিকৃত আবেদন বন মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ মন্ত্রণালয় গিয়ে লাল ফিতায় আটকে গেছে। পশ্চিম সুন্দরবনের বিভগীয় বন কর্মকর্তা মোঃ সাইদ আলী বলেন, বনবিভাগের স্টাফদের দাবি দাওয়ার বিষয়টি একাধিকবার উদ্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন