বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম বহাল থাকল। সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২৮ বছর আগে করা রিট গত সোমবার খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি নাঈমা হায়দার, বিচারপতি কাজী রেজা-উল-হক ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ বেঞ্চ খারিজের আদেশ দিয়েছেন। আমরা এই রায়কে অভিনন্দন জানাই এবং একে জনগণের অবেগ-অনুভূতির অনুকূল বলে মনে করি। এ-সংক্রান্ত আদেশে বলা হয়েছে, রিট আবেদনকারী কমিটির এই মামলা করার এখতিয়ার নেই। রাষ্ট্রপক্ষের অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা বলেছেন, রাষ্ট্রধর্ম ইসলামসংক্রান্ত রিট আবেদন করার ‘অধিকার’ নেই মর্মে তা খারিজ করে দিয়েছেন আদালত। এ রায়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম ধর্ম বহাল থাকার পাশাপাশি অন্য ধর্মের অধিকারও বহাল থাকল। আদালতের রায়ের পর হেফাজত ইসলামের নেতৃবৃন্দ এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, এতে ইসলামের বিজয় হয়েছে। রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৮ সালের ৫ জুন চতুর্থ জাতীয় সংসদে অষ্টম সংশোধনী পাস হয়। ওই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে অনুচ্ছেদ ২-এর পর ২(ক) যুক্ত হয়। ২(ক)-তে বলা হয়, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে।’ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ৯ জুন এতে অনুমোদন দেন। এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের আগস্ট মাসে ‘স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি’র পক্ষে ১৫ জন নাগরিক হাইকোর্টে রিট দায়ের করেছিলেন। আবেদনকারীদের মধ্যে ১০ জন ইতোমধ্যেই মারা গেছেন। আবেদনকারীদের অন্যতম জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি বদরুদ্দীন উমর রোববার এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, এই মামলার সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। সেই পুরনো মামলা পুনরুজ্জীবিত করা অর্থহীন বলেও তিনি বিবৃতিতে জানিয়েছিলেন।
মামলাটি আদালতে উঠছে শুনেই দেশ অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিল। দেশের তৌহিদি জনতা ফুঁসে উঠেছিল। আন্দোলনের প্রবল ঢেউ সারা বাংলার ধর্মপ্রাণ জনতাকে উদ্বেলিত করে তুলেছিল। শুরুতেই হেফাজতে ইসলাম রিট খারিজের দাবি করে, অন্যথায় দেশ অচল করে দেয়ার দীর্ঘ কর্মসূচি ঘোষণার কথা বলে। মামলার দিন সকালে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার কাছে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম বহাল রাখার দাবিতে স্মারকলিপি প্রদান করেছিল হেফাজতে ইসলাম। হেফাজতে ইসলামের ঢাকা মহানগরের যুগ্ম সদস্য সচিব মাওলানা ফজলুল করিম কাসেমীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের একান্ত সচিবের কাছে এর স্মারকলিপি প্রদান করে। আদালতের রায়ের পর হেফাজতে ইসলামের নেতৃবৃন্দ বলেছেন, ইসলামের বিজয় হয়েছে। বাংলাদেশের ৯৫ ভাগ লোক ইসলাম ধর্মের অনুসারী। এমন দেশে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম না রাখা অবাঞ্ছনীয়। রায়ের প্রতিক্রিয়ায় হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী ও মহাসচিব আল্লামা হাফেজ জুনায়েদ বাবুনগরি বলেন, রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে বহাল রাখায় দেশ মহা বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল থাকায় হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যরা ধর্ম পালনে সম-অধিকার ও সমমর্যাদা পাবে। এদেশের ইসলামবিদ্বেষী অপশক্তি কোনোদিনই সফল হবে না। আলেম, ওলামা ও তৌহিদি জনতার ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম আাগামী দিনে যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতেও ইনশাআল্লাহ কামিয়াবি লাভ করবে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মোহাম্মদ রেজাউল করিম পীরসাহেব চরমোনাই এক বিবৃতিতে ভবিষ্যতে যেন কেউ ইসলামের বিরুদ্ধে এবং ইসলামী সেন্টিমেন্টের বিরুদ্ধে আঘাত করতে না পারে, সে ব্যাপারে সকলকে সতর্ক থাকতে আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস নেতা মাওলানা জালাল উদ্দীন আহমদ বলেছেন, ইসলাম রক্ষায় এদেশের মুসলমানরা সদা সতর্ক রয়েছে। ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ রিট খারিজ প্রসঙ্গে বলেছেন, সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাদ দেয়ার চক্রান্ত করে কিছু নাস্তিক ও বিধর্মী নেতা দেশটাকে অভিশপ্ত ও ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্র করেছিল। খেলাফতে ইসলামীর আমির মাওলানা আবুল হাসনাত আমিনী ও মহাসচিব মাওলানা ফজলুর রহমান এক বিবৃতিতে মাননীয় বিচারপতি, সংশ্লিষ্ট আইনজীবী ও অন্দোলনকারী ধর্মপ্রাণ জনতার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। আওয়ামী ওলামা লীগ, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম, ইসলামী ঐক্যজোট, ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটি, বাংলাদেশ জাতীয় ইসলামী পরিষদ, ইসলামিক ফ্রন্ট, খাদেমুল ইসলাম বাংলাদেশসহ অপরাপর সংগঠনের নেতৃবৃন্দও অনুরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। রায়ের পর সংগত কারণেই ধর্মপ্রাণ জনগণের মন ও ধর্মীয় অঙ্গনে স্বস্তির বাতাস বইছে।
রাষ্ট্রধর্ম বহাল রাখার এ শান্তিপূর্ণ আন্দোলন-সংগ্রামে দেশের সর্বস্তরের ধর্মপ্রাণ মানুষ তাদের ঈমানি দায়িত্বে এগিয়ে এসেছিলেন। আলেমা, উলামা, পীর, মাশায়েখ ও ইসলামী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ জনগণকে পথনির্দেশ দিয়েছেন। মসজিদ, মাদরাসা, খানকা, দরবার ও ইসলামী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সমস্বরে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ও দাবি উঠেছে। গণমাধ্যমের ভূমিকাও ছিল প্রশংসনীয়। আমরা সংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিক মোবারকবাদ জানাই। যারা যেভাবেই রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রাখার সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন তাদের সবাইকে আল্লাহ উত্তম বিনিময় দান করুন। এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে ‘ফতোয়া’ ও ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’-এর মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে আদালতে যাওয়া হচ্ছে। আদালত থেকে রায় নেয়ার প্রয়োজনীয়তা পড়ছে। আমাদের দেশে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধসহ অনেক বিষয় রয়েছে যা নিয়ে কোনো বিতর্ক বা প্রশ্ন তোলা যায় না। একথা সকলেরই জানা, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের একটি বড় উপকরণ ছিল ধর্ম। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্বও ধর্মবিশ্বাসী জনগণের চেতনায়ই সমৃদ্ধ ও সুদৃঢ়। ধর্ম ও নৈতিকতাই মানুষকে সঠিক ও সৎপথ প্রদর্শন করে। সে বিবেচনায় এসব নিয়ে বিতর্ক সমাজকে বিপথগামী করতে পারে। আমরা মনে করি, কোনো মহলই যাতে এসব বিষয় নিয়ে ভবিষ্যতে কোনো বিতর্ক সৃষ্টি করতে না পারে তার কার্যকর উদ্যোগ নেয়া জরুরি। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলে আন্তরিক হবেন বলে দেশবাসী প্রত্যাশা করে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন