বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

গণতন্ত্রের ভবিষ্যত

মো. তোফাজ্জল বিন আমীন | প্রকাশের সময় : ৫ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

যে গণতন্ত্রের জন্য দেশের মানুষ যুদ্ধ করেছে, সে গণতন্ত্র আজ শৃঙ্খলিত। শুধু কল্পনা করা যায়, বাস্তবে ধরাও যায় না, ছোঁয়াও যায় না। অথচ কম বেশি সবাই গণতন্ত্রের পূজারী। গণতন্ত্রের কথা ক্ষমতায় যাওয়ার প্রাক্কালে শোনা গেলে ক্ষমতায় গেলে ক্ষমতাসীনদের সেই গণতন্ত্রের কথা স্মরণ থাকে না। গণতন্ত্রের আবরণে যখন স্বৈরতান্ত্রিক জুলুম-নির্যাতনের শাসন চেপে বসে তখন সমাজ বা রাষ্ট্রে শান্তি বিরাজ করে না। জনগণের মুখের ভাষা বোঝার মতো জ্ঞান তখন জনপ্রতিনিধিদের থাকে না। আমরা যদি পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাবো, অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কোথাও দীর্ঘ মেয়াদের জন্য সুফল বয়ে আনেনি। আইনের শাসনকে উপক্ষো করে, মানুষের কথা বলার স্বাধীনতাকে হরণ করে কোনো রাষ্ট্রই উন্নয়নের মহাসড়কে যেতে পারেনি। নজির হিসেবে জিম্বাবুয়ের কথা বলা যেতে পারে। জিম্বাবুয়ের শতবর্ষী রাষ্ট্রনায়ক হওয়ার মনোবাসনা ছিল মুগাবের। কিন্তু ৯৩ বছর বয়সে এসে ক্ষমতা হারাতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। প্রথম দিকে মুগাবেকে বলা হতো মুক্তির নায়ক বা মুক্তিদাতা। কিন্তু ক্ষমতায় আসার খুব অল্প সময় পরই মুগাবে হয়ে ওঠেন স্বৈরাচারী শাসক। রাজনৈতিক ভিন্নমতালম্বীদের পিষে ফেলতে মুগাবে কুন্ঠাবোধ করেননি। তার মতো রাষ্ট্র নায়কদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ওইসব মুক্তির নায়কেরা ক্ষমতায় আসেন ফুলের মালা আর জনগণের অফুরন্ত ভালোবাসা নিয়ে। জনগণ তাদের নেতাকে স্বাগত জানাতে রাজপথে নামতেও কার্পণ্য করে না। তাঁরা চায় নেতার ভালোবাসা। কিন্তু ক্ষমতার আসনে বসার পর মানবতাবাদী শাসকের চেহারা যখন পাল্টে যেতে শুরু করে তখনই পরিস্থিতি পাল্টে যায়। যারা তাকে সম্মান, শ্রদ্ধা, ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়েছিল তারাই তখন প্রতিবাদী হয়ে উঠেন। আর তখন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নায়ক বিদায় নেন জনগণের ধিক্কার, অবহেলা, অনাদর আর ঘৃণার মধ্য দিয়ে। পৃথিবীর কোথাও অন্যায় চিরস্থায়ী হয় না।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি যখন হেরে গিয়েছিল তখন জার্মান জেনারেল এরিক লুডেনডফ অভিযোগ করে বলেছিলেন যে, ‘আমাদের বিরুদ্ধে ব্রিটেনের গভীর অপপ্রচারের কারণেই আমরা হেরে গেছি’। এরিক লুডেনডফের এই উক্তিটিকে হিটলার খুবই গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন। যে কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই শুধু প্রোপাগান্ডার জন্য বিশেষভাবে ড. জোসেফ গোয়েবলসের মতো লোককে নিযুক্ত করেছিলেন। কিন্তু তারপরও শেষ রক্ষা হয়নি হিটলারের। ক্ষমতার কাছে অসহায় হয়ে যাওয়ার ইতিহাস অনেক পুরানো। বাংলাদেশেও এটি একেবারে নতুন নয়! তবে এমন ভয়ানকরূপে আগে কখনো দেখা মেলেনি। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় যেখানে বলা হয়ে থাকে জনগণই সব ক্ষমতার উৎস, সেখানে আজ জনগণের অসহায়ত্ব দিন দিন বেড়েই চলেছে। গণতন্ত্রের এই যুগে বিএনপির কালো পতাকা প্রদর্শনের কর্মসূচিকেও পুলিশ লাঠিপেটা করে পন্ড করে দেয়। বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে দলটির কালো পতাকা মিছিলের কর্মসূচিকে পুলিশ যে কায়দায় বাধা দিয়ে ভন্ডুল করে দিয়েছে তা কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক দেশের সরকারের আচরণ হতে পারে না। খালেদা জিয়ার কারাদÐকে কেন্দ্র করে বিএনপি হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি দিতে পারতো। কিন্তু সে ধরনের কোনো কর্মসূচি না দিয়ে কালো পতাকা প্রদর্শনের মতো নিরীহ ও নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি দিয়েও পুলিশের লাঠিপেটা থেকে রেহাই পায়নি। সরকারের তরফে বলা হয়েছিল, সরকার কারও রাজনৈতিক অধিকার ক্ষুণœ করছে না। সরকার কোনো দলের গণতান্ত্রিক অধিকারে বাধা দেয় না। জ্বালাও-পোড়াও থেকে সরে এসে সুষ্ঠু রাজনৈতিক আন্দোলন করলে প্রয়োজনে বিএনপিকে সহযোগিতা করা হবে। কিন্তু এই আশ্বাসের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই পুলিশ বিএনপির কালো পতাকা কর্মসূচিকে ভন্ডুল করে দিয়েছে।
একটি সমাজ ও রাষ্ট্রে যখন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সহনশীলতা ও মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় বিরাজ করে তখন সেখানে অন্যায়-অবিচার-জুলুমের মাত্রা বাড়তে থাকে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরোধী দল ও ভিন্নমতালম্বীদের কথা বলার অধিকার তো দিতে হবে। আদালতের রায় পক্ষে বা বিপক্ষে গেলে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখানো তো আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। সূর্যের আলো ছাড়া দিন যেমন অচল তেমনি চাঁদের আলো ছাড়াও রাত অচল। যে কোনো গণতান্ত্রিক দেশে বিরোধী দল ছায়া সরকারের ভূমিকা পালন করে থাকে। বিরোধীদলবিহীন সরকার যে স্বৈরাচারী হয়ে উঠে তার প্রমাণ তো ভুরি ভুরি দেয়া যাবে। রাজনীতি এখন আর রাজনীতির জায়গাতে নেই, যে কারণে প্রতিহিংসার রাজনীতির শিকার হচ্ছে দেশ, সমাজ ও রাষ্ট্র। আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্য অবশ্য এখন নানা রঙে-রসে ভরপুর। বিরোধীদল গণতন্ত্রসম্মত কোনো কর্মসূচি দিলে তারা বলেন, ওদের আন্দোলন করার মুরোদ নেই। আবার আন্দোলনের কর্মসূচি দিলে বলে, ওরা দেশে অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করছে। সেতুমন্ত্রী বিএনপিকে বলেছেন, আপনারা যদি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করেন তাহলে ঘরে বসে করুন, অফিসে করুন, রাস্তায় কেন? পুলিশের বেষ্টনীতে থেকে অন্যকে অনেক সবক দেয়া যায়। কিন্তু নিপীড়নের মাত্রা অনুধাবন করা যায় না। সরকার মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও বাস্তবে গণতন্ত্র দেখতে চায় না। দেশে এখন যে রাজনৈতিক সংকট ও হানাহানি চলছে তার একটি সমাধানের পথ বের করতে না পারলে গণতন্ত্রের ভবিষ্যত হবে অনিশ্চিত। নিষ্পেষিত হবে দল মত নির্বিশেষে সব শ্রেণী পেশার মানুষ। গণতন্ত্রের পথকে রুদ্ধ করে আইয়ুব খান উন্নয়নের জোয়ার প্রচার করেও ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেননি। এদেশের জনগণ উন্নয়নের গালভরা বুলি শুনতে চায় না, গণতন্ত্রের অবস্থিতিও দেখতে চায়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন