শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

মিয়ানমারের গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন

প্রকাশের সময় : ১ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

অর্ধশতাধিক বছর পর প্রথমবারের মত একজন বেসামরিক ব্যক্তির প্রেসিডেন্ট পদে শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারে গণতন্ত্রের নবযাত্রা সূচিত হল। অনেক ধোঁয়াশা ও আশঙ্কার বাতাবরণ পেরিয়ে গত বুধবার এনএলডি নেতা থিন কিউ মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছেন। গত নভেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সুচি’র নেতৃত্বাধীন ন্যাশানাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) শতকরা ৮০ শতাংশ ভোট পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে সক্ষম হয়। অবশ্য আরো সিকি শতাব্দী আগেও মিয়ানমারের জনগণ গণতন্ত্রের পক্ষে রায় দিয়েছিল। ১৯৯০ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে সু চি’র দল এনএলডি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পরও ক্ষমতায় যেতে পারেনি। দেশটির সামরিক বাহিনী নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছিল। একই সাথে তারা গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সুচিকেও গৃহবন্দি করে রেখেছিল। নেত্রীকে বন্দি করে রাখলেও সুচি’র দল এবং মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী জনগণ কখনো দমে যায়নি। সু চি’র এনএলডি’র পতাকা তলে শামিল হয়ে জনগণ গণতন্ত্রের জন্য সুদীর্ঘ লড়াইয়ে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে। এভাবে জনগণের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মধ্যদিয়ে অর্ধশতাধিক বছরের সামরিক স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের ইতিহাসকে পেছনে ফেলে মিয়ানমার গণতন্ত্রের পথে তার নবযাত্রা শুরু করল। মিয়ানমারের নতুন প্রেসিডেন্ট থিন কিউ, গণতন্ত্রের মানসকন্যা হিসেবে পরিচিত নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অং সান সুচি ও তার দল এনএলডি, সর্বোপরি মিয়ানমারের গণতন্ত্রকামী জনগণের প্রতি আমাদের অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে মিয়ানমারে গণতন্ত্রের সুবাতাস আমাদের জন্য স্বস্তি ও প্রেরণাদায়ক বিষয়। মিয়ানমারে গণতন্ত্রের যাত্রা কখনো মসৃণ ছিল না। এখন নতুন প্রেক্ষাপটে একজন বেসামরিক প্রেসিডেন্ট দেশটির সর্বোচ্চ শাসনকর্তা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পরও নানাবিধ আশঙ্কা ঘুরপাক খাচ্ছে। অর্ধশতাধিক বছরের সামরিক শাসনের সময় দেশটির শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সামরিক বাহিনীর যে প্রাধান্য তৈরী করেছিল তা’ থেকে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তীর্ণ হওয়া এখনো অনেকটাই অনিশ্চিত। এখনো সেখানকার পার্লামেন্টের ১৬৬টি আসন সামরিক বাহিনীর জন্য সংরক্ষিত আছে। অতএব পুরনো আইনের সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত গণতান্ত্রিকভাবে একজন বেসামরিক প্রেসিডেন্ট দায়িত্বভার গ্রহণ করলেও শাসনব্যবস্থা সামরিক বাহিনীর প্রভাবাধীন থাকছে, এটা প্রায় নিশ্চিত। সেনাশাসকদের প্রণীত আইনী জটিলতার কারণে গণতন্ত্রের জন্য জীবনের সুদীর্ঘ সময় কারাবরণকারী জনপ্রিয় নেত্রী অং সান সুচি রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারেননি। সেনাসমর্থিত প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের স্থলাভিষিক্ত হয়ে যৌথ পার্লামেন্টে দেয়া প্রথম ভাষণে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট থিন কিউ সংবিধান পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। পূর্ণ গণতন্ত্রের জন্য গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি সংবিধান রচনা ও বাস্তবায়ন পর্যন্ত জনগণকে ধৈর্য ধারণের আহ্বান জানিয়েছেন নতুন প্রেসিডেন্ট।
মিয়ানমারের নতুন প্রেসিডেন্ট পার্লামেন্টে দেয়া তার প্রথম ভাষণে সে দেশের জনগণের সুদীর্ঘ লালিত আকাক্সক্ষা ও প্রত্যাশা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। নভেম্বরে অনুষ্ঠিত পার্লামেন্ট নির্বাচনকে অবাধ, অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষভাবে বাস্তবায়নের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীও তাদের দেশকে গণতন্ত্রের নবযাত্রার ট্রেনে তুলে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এখন একটি নতুন সংবিধান রচনার মধ্য দিয়ে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তীর্ণ হতে সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিরা কি ভূমিকা পালন করেন তা-ই দেখার বিষয়। গণতন্ত্রের জন্য মিয়ানমারের জনগণের সুর্দীঘ আকাক্সক্ষা ও সংগ্রামের যে বিজয় ইতিমধ্যে অর্জিত হয়েছে তা’ থেকে আর পিছিয়ে পড়ার সুযোগ নেই। দীর্ঘ সেনাশাসনে মিয়ানমার যে সব নাগরিক ও সামাজিক বৈষম্যের শিকার হয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসাই সেখানকার বর্তমান সরকারের জন্য সবচে’ বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষত, রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিকত্ব ও নাগরিক অধিকারের ইস্যুটির ন্যায়সঙ্গত সমাধানের দিকেই বাংলাদেশসহ বিশ্ব সম্প্রদায়ের সতর্ক দৃষ্টি থাকবে। একটি সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণের কোন সুযোগ থাকেনা। নতুন প্রেসিডেন্টের প্রতিশ্রুতি অনুসারে প্রত্যাশিত নতুন সংবিধানে রোহিঙ্গা মুসলমানসহ মিয়ানমারে বসবাসরত সকল জাতিগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ সমান সুযোগ সুবিধা লাভ করবে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী মাত্রই এটা প্রত্যাশা করবে। শুধুমাত্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অগ্রযাত্রা বা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সম্পৃক্ত সাংবিধানিক ব্যবস্থাই বৈষম্যহীন সামাজিক-রাজনৈতিক প্রত্যাশা নিশ্চিত করতে পারে। মিয়ানমারে গণতন্ত্রের এই নবযাত্রা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের সকল গণতন্ত্রকামী জনগণের জন্য এক নতুন দৃষ্টান্ত ও অনুপ্রেরণার বিষয় হয়ে উঠবে। কারণ, সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পদার্পণ করতে আমাদের সামনেও অনেক প্রতিবন্ধকতার দেয়াল। জনগণের সম্মিলিত রাজনৈতিক প্রয়াসে কোন কিছুই অসাধ্য নয়। মিয়ানমারের জনগণ বিশ্বের সামনে তারই একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।        

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন