শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

আর্মি স্টেডিয়ামে স্বজনদের কান্না

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২০ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

পিতা-মাতা অপেক্ষা করছিলেন সন্তানের লাশের জন্য, স্ত্রী স্বামীর, ভাই বোনের জন্য। অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হচ্ছিল না। কখন আসবে প্রিজনের লাশ। নিহত হওয়ার পর গত একটা স্পতাহ তাদের কেটেছে গভীর শোক, উদ্বেগ-উৎকন্ঠা আর বুকফাটা কাঁন্না। এ কাঁন্না আরো ভারী হলো প্রিয় মানুষের লাশটি কপিনে দেখার পর। নিহতদের কারও মা, কারও বাবা, কারও বোন বা স্ত্রী মরদেহ গ্রহণ করেছেন। শোকে মুহ্যমান স্বজনরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাত ধরে মঞ্চে ওঠে চিরবিদায়ী প্রিয়জনের মরদেহ গ্রহণ করেন। মরদেহবাহী কফিন জড়িয়ে অনেকে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। বুক চাপড়াতে থাকেন বাবা-মা, কফিন জড়িয়ে নির্বাক বসে থাকেন বোন বা স্ত্রী। বড়-ছোট ভাই-বোনরাসহ স্বজনেরা তখন গুমরে কাঁদছিলেন।
গতকাল বিকালে আর্মি স্টেডিয়ামে জানাজার পর মরদেহ হস্তান্তরের সময় এ করুণ দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের আহাজারিতে পুরো এলাকার বাতাস ভারী হয়ে ওঠছিল। স্বজনদের কাঁন্নায় সাধারণ জনতাও নিজেদের সামলাতে পারছিলেন না। উপস্থিত অনেকেই কেঁদে ফেলেন।
বিমানবন্দর থেকে অ্যাম্বুলেন্স আর্মি স্টেডিয়ামে আসার পর সেখান থেকে মরদেহ নামানোর সঙ্গে সঙ্গে সবার চোখ থেকে অঝোর ধারায় ঝরতে থাকে অশ্রæ। মরদেহগুলো কাঁধে বয়ে সেনা সদস্যরা নামিয়ে রাখলেন লালগালিচায় সাজানো মঞ্চে। স্বজনদের চোখ তখন খুঁজছিলো প্রিয়জনের কফিনটা। এপাশে তাকালে গগণবিদারী আহাজারি, ওপাশে তাকালে চোখের কোণে চিকচিক জল। ওদিকে তাকালে নির্বাক চাহনি। এপাশে তাকালে বুক চাপড়ে আহাজারি। ওপাশে তাকালে অশ্রæলুকোতে মুখ আড়ালের ছল। পুরো আর্মি স্টেডিয়াম যেন প্রিয়জনহারাদের বেদনায় শোকাভিভূত হয়ে উঠলো। নেপালে প্লেন দুর্ঘটনায় নিহত ২৩ জনের মরদেহ গতকাল সোমবার বিকেলে ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে অপেক্ষারত স্বজনদের কান্নায় এমন শোকাবহ পরিবেশ তৈরি হয় সেখানে। মরদেহ পৌঁছাতেই কফিন জড়িয়ে স্বজনদের কান্না পরিবেশকে করে তুলে আরও ভারী।
কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বিশেষ প্লেনে করে বিকেল ৪টা ৫ মিনিটে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আনা হয় নিহত ২৩ জনের মরদেহ। সেখানকার আনুষ্ঠানিকতা শেষে জানাজা ও মরদেহ হস্তান্তরের জন্য সোয়া ৫টায় নিয়ে আসা হয় আর্মি স্টেডিয়ামে।
দুর্ঘটনার পর টানা এক সপ্তাহ সীমাহীন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় অপেক্ষা করছিলেন স্বজনরা। দুপুর থেকে সে অপেক্ষার উৎকণ্ঠা যেন আরও বাড়ছিল। প্রিয়জনের মরদেহ আসার অনেক আগেই আর্মি স্টেডিয়ামে ভিড় জমাতে থাকেন স্বজনরা। একটু পর পর খবর নিচ্ছিলেন কখন প্লেন আসবে। জানাজা কখন শেষ হবে। কখন প্রিয় মুখখানি দেখবেন। অবশেষে প্রিয় মানুষটির লাশ পেয়ে শোকে মুহ্যমান নির্বাক স্বজনেরা চোখের পানি মুছতে মুছতে ফিরে গেলেন স্বজনের কপিন নিয়ে।
ভাইয়ের জানাজায় অংশ নিতে গিয়ে
আহত মেহেদি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন
বড় ভাই ও ভাইয়ের শিশু সন্তানের জানাজায় অংশ নিতে এসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন ইউএস বাংলা বিমানের দূর্ঘটনায় আহত মেহেদি হাসান। নেপালে বেড়াতে গিয়ে দুঘর্টনায় আহত হয়েছেন মেহেদি,তার ন্ত্রী, বড় ভাইয়ের স্ত্রী। এঘটনায় নিহত হয়েছেন তার বড় ভাই ও বড় ভাইয়ের শিশু সন্তান। বড় ভাই ও ভাইয়ের ছোট্ট মেয়ে তামারা প্রিয়ন্ময়ীর জানাজায় অংশ নিতে গিয়ে মেহেদী শিশুর মতো শুধু কাঁদছিলেন। তার কাঁন্না দেখে উপস্থিত স্বজনেরাও চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। এসময় সেখানে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়।
গতকাল সোমবার প্রিয়জনদের জানাজায় অংশ নিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে আর্মি স্টেডিয়ামে এসেছেন মেহেদি। এখনো তার হাতে রয়েছে, স্যালাইন দেওয়ার ক্যানোলা, ঘাড়ে রয়েছে আলাদা সাপোর্ট। এই শারীরিক অবস্থায় কেন এলেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভাই আর বাবুটাকে শেষ বিদায় জানাতে এসেছি।’
আনন্দভ্রমণে যাচ্ছিলেন সবাই। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল স্বপ্নের নেপাল। এর আগে কখনো বিদেশেই যাননি মেহেদি হাসান। হয়ে ওঠেনি উড়োজাহাজে ভ্রমণও। তাই স্ত্রী ও ভাইয়ের পরিবারসহ পাঁচজন মিলে যাচ্ছিলেন নেপালে। কিন্তু এমন পরিণতি হবে ভাবেননি মেহেদি। কাঁদতে কাঁদতে এভাবেই বলছিলেন কথাগুলো।
গত সোমবার ইউএস-বাংলার বিএস-২১১ উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হন ৪৯ জন। ওই উড়োজাহাজে ছিলেন, মেহেদি হাসান, তাঁর স্ত্রী সৈয়দ কামরুন্নাহার স্বর্ণা, ভাই ফারুক হোসেন প্রিয়ক, ভাইয়ের স্ত্রী আলামুন নাহার অ্যানি ও ভাইয়ের ছোট্ট মেয়ে তামারা প্রিয়ন্ময়ী। দুর্ঘটনায় নিহত হন, প্রিয়ক ও তাঁর মেয়ে প্রিয়ন্ময়ী। আহত হন,বাকিরা। নেপালে চিকিৎসার পর দেশে এসে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন তাঁরা। মুখ ঢেকে বারবার কাঁদছিলেন মেহেদি। কান্নাভেজা কণ্ঠেই জানান, উড়োজাহাজের পেছনের দিকের পাঁচটি আসনে পাশাপাশি বসেছিলেন সবাই। মেহেদি বসেছিলেন জানালার পাশে। বিধ্বস্ত হওয়ার ১০ থেকে ১৫ মিনিট আগে অবতরণের ঘোষণা দেওয়া হয়। সবাইকে সিট বেল্ট বাঁধতে বলা হয়। সবাই সিট বেল্ট বাঁধেন। ঘোষণা দেওয়ার পরপরই মেহেদি জানালা দিয়ে দেখেন ল্যান্ডিং গিয়ার বের হয়েছে। উড়োজাহাজটি অনেক নিচু দিয়েই উড়ছিল বেশ কয়েক মিনিট ধরে। সবই স্বাভাবিক ছিল। প্রথমে ভূমি স্পর্শ করে ছিটকে পড়ে উড়োজাহাজটি,ভেঙে যায়। মেহেদি ও তাঁর স্ত্রী সামনের ভাঙা অংশ দিয়ে নামতে পারেন। মেহেদি নেমেই নিচে কয়েকজনকে পড়ে থাকতে দেখেন। পরে উদ্ধারকারীরা এসে তাঁদের নিয়ে যান।
জানাজা শেষে আবারও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় মেহেদি হাসান। তাঁর ঘাড়, মাথাসহ বিভিন্ন জায়গায় আঘাত লেগেছে।
ঢাকা মেডিকেল প্রতিনিধি জানিয়েছেন, প্রিয় সন্তান ও স্বামীর লাশ দেখতে হাসপাতাল থেকে আলামুন নাহার অ্যানি গেছেন গাজীপুরের শ্রীপুরে। সেখানে কবর দেওয়া হবে স্বামী প্রিয়ক ও তামারাকে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন