শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

সুদ ব্যবস্থার ভয়াবহ পরিণাম

| প্রকাশের সময় : ২২ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

আধুনিক অর্থব্যবস্থার একটি হচ্ছে সুদ ব্যবস্থা। সুদ ব্যবস্থা মানুষকে তিলে তিলে ধ্বংস করে। গরীবকে আরো গরীব করে তোলে। সুদখোররা নানা কৌশলে গরীবদের সর্বস্ব লুট করে নিয়ে যায়। এনজিও সংস্থাগুলো সেবার নামে গরীবদের ঋণ দিয়ে জোঁকের মত গরীবদের থেকে চুষে নেয় সুদের টাকা। যথাযথভাবে সুদ পরিশোধে ব্যর্থ হলে গরীবের ভিটে মাটিও এনজিও সংস্থার কাছে সুদের বিনিময়ে দিতে হয়। এই এনজিওরা মূলতঃ সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে কাজ করছে এবং সুদ ব্যবস্থাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিচ্ছে। এরা সুদ ব্যবস্থার প্রসার ঘটিয়ে মানুষকে বেকার, কর্মহীন, অর্থহীন ও ধর্মহীন করছে। বর্তমান বিশ্বের দারিদ্র্য ও বেকার সমস্যার অন্যতমও কারণ হচ্ছে এই অভিশপ্ত সুদ ব্যবস্থা। সুদ ব্যবস্থাই বর্তমানে বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধি করছে। সুদ হচ্ছে প্রকৃতিবিরোধী আর ইসলামের যাকাত ব্যবস্থা হচ্ছে প্রকৃতিগত ব্যবস্থা। যাকাতের অর্থ উপর থেকে নিচে আসে আর সুদের অর্থ নিচ থেকে উপরে উঠে। এজন্যই বলা হয়-সুদ প্রকৃতিবিরোধী। কারণ প্রত্যেক জিনিসই উপর থেকে নিচের দিকে আসে। আর এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কোনকিছুই নিচু থেকে উপরে উঠা স্বাভাবিক নয় : তা হচ্ছে একটা দুর্লক্ষণ। যেমন-পানি যখন আকাশ থেকে নিচে নাজিল হয়, তখন তা হয় প্রত্যেকের জন্যই কল্যাণকর। এমনকি বন্য পশু, জীব-জানোয়ার, গাছপালা ইত্যাদি সবকিছুর জন্যই এটা হয় একটা রহমত স্বরূপ। কিন্তু যখন প্লাবন হয়ে নিচের পানি উপরের দিকে উঠে, তাহলে তা হয় সবকিছুর জন্যই বিপদের কারণ অর্থাৎ গাছপালা, জীব-জানোয়ার তথা হাঁস-মুরগী, গরু-ছাগল ইত্যাদি গৃহপালিত পশু এবং মানবক‚ল-প্রত্যেকের জন্যই একটা মহাবিপদের কারণ। এভাবে দেখা যায়, প্রকৃতির নিয়ম ভঙ্গকারী কোনকিছুই আল্লাহর সৃষ্টির কোনকিছুর জন্যই কল্যাণ বয়ে আনে না। তাই সুদও প্রকৃতির নিয়ম ভঙ্গকারী ব্যবস্থা। তা কোনদিনই মানব সমাজে কোন কল্যাণ বয়ে আনতে পারবে না।
সুদের পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। আল্লাহপাক সেই সুদকে চিরতরে নিষিদ্ধ করেছেন। পবিত্র কোরআনে সুদ নিষিদ্ধের কথা এবং সুদের ভয়াবহ পরিণামের কথা বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে- (১) ‘যারা সুদ খায় তারা সেই ব্যক্তিরই ন্যায় দাঁড়াবে যাকে শয়তান স্পর্শ দ্বারা পাগল করে। ইহা এজন্যই যে, তারা বলে, বেচাকেনা তো সুদের মত। অথচ আল্লাহ বেচাকেনাকে বৈধ এবং সুদকে অবৈধ করেছেন। যার নিকট তার প্রতিপালকের উপদেশ এসেছে এবং যে বিরত হয়েছে, তবে অতীতে যা হয়েছে তা তারই এবং তার ব্যাপার আল্লাহর ইখতিয়ারে। আর যারা পুনরায় আরম্ভ করবে তারাই অগ্নির অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে’ (সূরা বাকারা : আয়াত-২৭৫)। (২) ‘আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দানকে বর্ধিত করেন। আল্লাহ কোন অকৃতজ্ঞ পাপীকে ভালোবাসেন না’ (সূরা বাকারা : আয়াত-২৭৬)। (৩) ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যাহা বকেয়া আছে তা ছেড়ে দাও যদি তোমরা মুমিন হও’ (সূরা বাকারা : আয়াত ২৭৮)। (৪) ‘যদি তোমরা না ছাড় তবে জেনে রাখ যে, ইহা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সহিত যুদ্ধ কিন্তু যদি তোমরা তাওবা কর তবে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই, ইহাতে তোমরা অত্যাচার করবে না বা অত্যাচারিত ও হবে না’ (সূরা বাকারা : আয়াত-২৭৯)। (৫) ‘যদি খাতক (ঋণ গ্রহীতা) অভাবগ্রস্থ হয় তবে স্বচ্ছলতা পর্যন্ত তাকে অবকাশ দাও। আর যদি তোমরা ছেড়ে দাও তবে ইহা তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা জানতে’ (সূরা বাকারা : আয়াত-২৮০)। (৬) ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খাইও না এবং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার’ (সূরা আল-ইমরান : আয়াত-১৩০)। (৭) ‘এবং তাদের সুদ গ্রহণের জন্য যদিও ইহা তাদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এবং অন্যায়ভাবে লোকের ধনসম্পদ গ্রাস করার জন্য। তাদের মধ্যে যারা কাফির তাদের জন্য আমি মর্মন্তুদ শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি’ (সূরা নিসা : আয়াত-১৬১)। (৮) ‘মানুষের ধনে বৃদ্ধি পাবে বলে তোমরা সুদে যা দিয়ে থাক আল্লাহর দৃষ্টিতে তাহা ধন সম্পদ বৃদ্ধি করে না; কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য যে যাকাত তোমরা দিয়ে থাক তাহাই বৃদ্ধি পায়, উহারাই সমৃদ্ধিশালী’ (সূরা রুম : আয়াত-৩৯)।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্তরায় যে ব্যবস্থাটি সেই ঘৃণ্য ব্যবস্থাটিই হচ্ছে সুদ ব্যবস্থা। সুদ ব্যবস্থায় মানবতার কোন কল্যাণ নেই। সুদ ব্যবস্থা অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল ভিত্তি ধ্বংস করে দেয়। মানুষ যাতে অর্থনৈতিক মুক্তি পায় সেজন্য রাসূল (সা.) হাদীসে সকল প্রকার সুদকে চিরতরে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। সুদ ব্যবস্থার ভয়াবহ পরিণাম বিষয়ক কয়েকখানা হাদীস নিম্নে উপস্থাপন করা হল- (১) হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন-আল্লাহপাক চার ব্যক্তিকে জান্নাতে প্রবেশ না করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং তাদেরকে জান্নাতের নিয়ামতসমূহ উপভোগ করার সুযোগও দিবেন না-এরা হল, (১) মদ্যপানে অভ্যস্থ ব্যক্তি (২) সুদখোর (৩) অন্যায়ভাবে ইয়াতীমের মাল ভক্ষণকারী (৪) পিতামাতার অবাধ্য সন্তান (হাকিম)। (২) হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন-‘মিরাজ রজনীতে সপ্ত আকাশে পৌঁছে আমি যখন উপরের দিকে তাকালাম, তখন বজ্রধ্বনি, বিদ্যুৎ চমক ও গর্জন শুনতে পেলাম। অতঃপর আমি এমন এক কওমের নিকট গেলাম, যাদের উদর ছিল এক একটি ঘরের ন্যায় বিস্তৃত। তাদের পেট ছিল সর্প দ্বারা ভরপুর। যা তাদের পেটের বাইরে থেকেই প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে জিব্রাঈল! এরা কারা? তিনি বললেন-এরা সুদখোর স¤প্রদায়’ (মুসনদে আহমদ, ইবনে মাজাহ)। (৩) হযরত ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন-‘সুদের মধ্যে সত্তরের অধিক গুণাহ রয়েছে। আল্লাহর সাথে শিরক করাও তার একটির সমতুল্য’ (বাজ্জাজ)। (৪) হযরত জাবির (রা.) বর্ণিত হাদীসে তিনি ইরশাদ করেন-‘যে সুদ খায়, যে সুদ দেয়, যে সুদের দলীল লেখে এবং যে দুজন সুদের সাক্ষী থাকে তাদের উপর রাসূল (সা.) লা’নত করেছেন। রাসূল (সা.) এটাও বলেছেন-অপরাধের দিক থেকে তারা সকলেই সমান’ (মুসলিম)। (৫) হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন-‘সুদের গুণাহর সত্তর ভাগের ক্ষুদ্রতম ভাগ এই পরিমাণ যে, কোন ব্যক্তি তার মাকে বিয়ে করে’ (ইবনে মাজাহ : পৃষ্ঠা-১৬৪, মিশকাত শরীফ : পৃষ্ঠা-২৪৬)। (৬) হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন-‘লোকদের উপর এমন এক যুগ আসবে যখন একটি লোকও সুদের ব্যবহার থেকে অব্যাহতি পাবে না। সে সরাসরি না খেলেও সুদের ধোয়া বা ধুলা তাকে স্পর্শ করবেই’ (আহমদ, আবু দাউদ, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ)
আমাদের সমাজে অনেক লোক আছেন যারা তথাকথিত ব্যবসার নামে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যাংকে জমা রাখেন। আর ব্যাংক তাদেরকে ১০% বা ২০% হারে লাভ দিয়ে থাকে। এরা ঘরে বসেই বিনাকষ্টে এই টাকা পেয়ে থাকেন। তারা মনে করেন-এটা ব্যবসা। এটা তাদের সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। আসলে এটা সুদ। এই সুদকে তারা খোড়া যুক্তি দিয়ে ব্যবসা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। ব্যবসার নাম নিয়ে সুদের লেনদেন করছেন আমাদের সমাজের অনেকে। ব্যবসা তো হচ্ছে সেটা-যাতে টাকা বিনিয়োগ করা হয়, চিন্তা-ফিকির ও পরিশ্রম করা হয়, লাভ-ক্ষতি উভয়টাকে সর্বান্তঃকরণে মেনে নেয়া হয়। চিন্তা-ফিকির নেই, পরিশ্রম নেই, কোন প্রকার ক্ষতিকে মেনে নেয়া হয় না-সেটাকে কোন বিবেকে ব্যবসা বলা হয়? ব্যাংক থেকে ১০% বা ২০% লাভে বিনা পরিশ্রমে যা পাওয়া যায় তা সরাসরি সুদ। এই সুদের পরিণাম অত্যন্ত করুণ। ইরশাদ হচ্ছে-‘তাদের অনেককেই তুমি দেখবে পাপে, সীমালঙ্গনে ও অবৈধ ভক্ষণে (সুদ, ঘুষ, দুর্নীতিতে) তৎপর : তারা যা করে নিশ্চয়ই তা নিকৃষ্ট” (সূরা মায়িদা : আয়াত-৬২)।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন