শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

ভারতের চাপে নতুন কৌশলে বিএসইসি

০ শর্তের জালে ডিএসই’র অংশীদারিত্বে চীনা প্রস্তাব আটকে গেল

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ২২ মার্চ, ২০১৮, ৯:০৫ পিএম

০ হাজার হাজার কোটি টাকার চীনা বিনিয়োগ আটকে যাচ্ছে
০ বিশ্লেষকদের মতে- কাজ না দেয়ার কৌশল
০ বিএসইসি’র সিদ্ধান্তহীনতায় ডুবছে শেয়ারবাজার
দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) কৌশলগত বিনিয়োগকারী নির্ধারণ নিয়ে তালবাহানা শেষ হচ্ছে না। কৌশলগত বিনিয়োগকারী ইস্যুতে ডিএসইকে শর্তের জালে আটকে দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। ভারতের চাপে চীনের প্রতিষ্ঠানকে বিনিয়োগের সুযোগ না দিয়ে নতুন করে শর্ত আরোপ করে সংশোধনের জন্য বলা হয়েছে। শর্তগুলো পূরণ করে পুনরায় আবেদন করলে তা বিবেচনায় নেবে কমিশন। আর এর মাধ্যমে চীনের প্রায় এক হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব আটকে গেলো। ডিএসই’র অংশীদারিত্ব বিক্রি নিয়ে ভারতের চাপে চীনের সাথে বাংলাদেশের মানসিক দ্ব›দ্ব চলছে। আর তাই বাংলাদেশে চীনের হাজার হাজার কোটি টাকার কৌশলগত বিনিয়োগ প্রস্তাবগুলো একের পর এক আটকে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ ও জ্বালানি খাতে একটি বড় বিনিয়োগের প্রস্তাব নাকচ হয়েছে। নতুন করে শর্তারোপ অংশীদারিত্ব না দেওয়ার কৌশল মনে করছে পূজিবাজার বিশ্লেষকরা। এতে করে চীনের অন্যান্য প্রকল্পগুলোও হুমকির মুখে পড়ার আশংকা করছেন বিশ্লেষকরা।
সূত্র মতে, ডিএসই’র কৌশলগত অংশীদার নির্ধারণ নিয়ে গত মঙ্গলবার জরুরী সভায় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) নতুন করে কয়েকটি শর্ত আরোপ করে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএসই’র একজন পরিচালক জানান, চীন হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে শর্তহীনভাবে। এটা অন্য কেউই করবে না। অপরদিকে ডিএসই সূত্র জানিয়েছে, আগামী সপ্তাহে চীনা প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসবে। এরপর শর্তগুলো পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। ফলে অনেকাংশই ঝুলে গেলো ডিএসইর কৌশলগত বিনিয়োগকারী নির্ধারণের বিষয়।
পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর আবু আহমেদ বলেন, চীনের কনসোর্টিয়ামের চেয়ে আর কোনো ভালো প্রস্তাব ছিল না। বিএসইসি প্রস্তাবটি গ্রহণ করেও সংশোধন করতে পারতো। ফলে পুরো প্রক্রিয়াটি ঝুলে গেল। তিনি বলেন, কৌশলগত বিনিয়োগকারী নেয়ার ক্ষেত্রে অনেক সময় ব্যয় করা হয়েছে। এ ধরনের অবস্থান শেয়ারবাজারের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। যা ঠিক হয়নি। একই সঙ্গে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ স্বার্থরক্ষা করতে পারছে কি না সে প্রশ্ন উঠেছে। এসব সিদ্ধান্তের পেছনে ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা থাকতে পারে বলে মনে করেন তিনি। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং মার্কেটের ভালো দিক বিবেচনা করে চীনকে অংশীদারিত্ব দেয়া উচিত ছিল বলে উল্লেখ করেন এই শেয়ারবাজার বিশ্লেষক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএসই’র এক পরিচালক বলেন, ডিএসই’র অংশীদারিত্ব নিয়ে ভারতের চাপ স্পষ্ট। শেয়ার বিক্রি নিয়ে আলোচনার জন্য ভারতের অন্যতম শেয়ারবাজার ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিক্রম লিমা ১১ ফেব্রæয়ারি ঢাকায় আসেন। তিনি ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাজেদুর রহমানের সাথে বৈঠক করে নানাভাবে তাদের দেশের প্রতিষ্ঠানের কাছে শেয়ার বিক্রিতে চাপ প্রয়োগ করেছেন বলে উল্লেখ করেন।
একের পর এক চীনা বিনিয়োগ প্রস্তাব আটকে যাওয়া এবং শেয়ারাবাজারের অংশীদারিত্ব নিয়ে ভারতের চাপ বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর ইনকিলাবকে বলেন, একটি ভূ-রাজনৈতিক খেলা হচ্ছে। তিনি বলেন, বিনিয়োগ আমাদের প্রয়োজন। এক্ষেত্রে কেউ পাবে কেউ পাবে না। কারো খুশি-অখুশি বিবেচ্য নয়। কারণ যা-ই থাকুক না কেন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের দিকটি প্রাধান্য পাবে এটাই কাম্য। ভারতের চাপের বিষয়ে সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, আমরা সন্দেহ করছি। কিন্তু যদিও থাকে তাহলে তা উতরানো উচিত বলে মনে করেন তিনি। হুমায়ুন কবীর বলেন, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দেশের স্বার্থ ও প্রক্রিয়াগত নানা জটিলতা থাকে। বিনিয়োগের ধরণ ও পরিমাণের উপর অনেককিছু নির্ভর করে। স্বচ্ছতার অনেক ব্যাপার থাকে। তবে বড় বিনিয়োগ থমকে যাওয়ায় এমন ধারণা আছে যে আমরা চীন ও ভারতের টানাটানির মধ্যে পড়ছি কি না উল্লেখ করেন তিনি।
চীনকে অংশিদারিত্ব না করতে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) নতু ৫টি শর্ত দিয়ে বলা হয়েছেÑ দেশের শেয়ারবাজারের স্বার্থে ডিএসইকে আরেকবারের মতো সুযোগ দেয়া হলো। শর্তে যা রয়েছেÑ শেয়ার পারচেজ এগ্রিমেন্টে (এসপিএ) এমন কোনো শর্ত রাখা যাবে না যা স্থানীয় আইনের সাংঘর্ষিক। পাশাপাশি ডিএসইর সাধারণ শেয়ারহোল্ডার ও বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট উন্নয়নে বিরুদ্ধে না যায়। এমন কোনো প্রস্তাব রাখা চলবে না যা পালন করতে ডিএসইর বিদ্যমান মেমোরেন্ডাম এবং আর্টিকেলস অব অ্যাসোসিয়েশন সংশোধন করতে হয়। এসপিএসহ কৌশলগত ইস্যু চূড়ান্ত করে কমিশনে জমা দেওয়ার আগে ডিএসইর শেয়ারহোল্ডারদের অনুমোদন নিতে হবে। কৌশলগত বিনিয়োগকারী ইস্যুতে গঠিত কমিটির প্রতিবেদন ডিএসইর সাধারণ সভায় উপস্থাপন করতে হবে। ডিএসইর সাধারণ সভার সিদ্ধান্তপত্র, এসপিএসহ কনসোর্টিয়ামের অন্যান্য কাগজাদি নিয়ে কমিশনে চূড়ান্ত আবেদন করতে হবে।
এদিকে শেয়ারবাজারে চীনা বিনিয়োগ প্রস্তাব ফেরত পাঠানোর পর চীনের আরো কিছু বিনিয়োগ প্রস্তাব বাস্তবায়ন না হওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার চীন। মেগা প্রকল্প পদ্মা সেতুসহ দেশের অনেক প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগ আছে। বিশেষ করে অবকাঠামো খাতে চীন বিনিয়োগে বেশি আগ্রহী। কিন্তু দুই দেশের কৌশলগত স্বার্থ আছে এমন দীর্ঘ মেয়াদি বড় প্রকল্পে চীনা বিনিয়োগ নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ নিয়ে ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের দ্ব›দ্ব আছে। চীন ইতোমধ্যে মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে। মালদ্বীপের সা¤প্রতিক পরিস্থিতিতে চীনের প্রভাব সুস্পষ্ট। চীনের এই প্রভাবকে ভারত চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করছে। এমন পরিস্থিতিতে চীনের বড় প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশ হয়তো এখন এগোতে চাইছে না। আগামী নির্বাচন আগে সরকার এসব প্রকল্প নিয়ে না-ও এগোতে পারে।
এ ছাড়া বাংলাদেশে জ্বালানি খাতে বিনিয়োগে চীন আগ্রহ দেখিয়ে আসছে। বাংলাদেশে তিনটি গ্যাস ক্ষেত্রের ২০০ কোটি ডলারের সম্পদ চীনের হিমালয় এনার্জির কাছে বিক্রয়ে চুক্তি করেছিল যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান শেভরন। উৎপাদন অংশীদারিত্ব চুক্তি (পিএসসি) অনুযায়ী জ্বালানি খাতে এ ধরনের বিনিয়োগ হস্তান্তরের ক্ষেত্রে সরকারের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। শেভরনের এই সম্পদ চীনা কোম্পানির কাছে বিক্রির ব্যাপারে সম্মত হয়নি সরকার। চীনা প্রতিষ্ঠানটির অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে পেট্রোবাংলা। শেষ পর্যন্ত শেভরন সম্পদ বিক্রির পরিকল্পনা পরিত্যাগ করে।
শাকিল রিজভী স্টক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও ডিএসই’র সাবেক পরিচালক শাকিল রিজভী ইনকিলাবকে বলেন, চীন একটি বড় বিনিয়োগকারী দেশ। দেশের স্বার্থেই বড় বিনিয়োগকারী ধরে রাখা দরকার। আর চীনা বিনিয়োগের জন্য যেখানে পুরো বিশ্ব উদগ্রীব। তিনি বলেন, চীনা প্রস্তাব গ্রহণ করা উচিত। এটা আমাদের শেয়ারবাজারের জন্য বড় সুযোগ। একই সঙ্গে চীনের প্রস্তাবটি গ্রহণ করে অন্যান্য সমস্যা থাকলে তা দূরীকরণে নতুন করে শর্ত দেয়া যেত বলে উল্লেখ করেন শাকিল রিজভী। তিনি বলেন, ছোট-খাট বিষয়গুলো আপোশ করে চীনা বিনিয়োগের বড় সুযোগ দ্রæত গ্রহণ করা উচিত। শেয়ারবাজারের অংশীদারিত্ব নিয়ে ভারতের অনৈতিক চাপ সম্পর্কে শাকিল রিজভী বলেন, এখনও বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন তাই সরাসরি কাউকে দোষারোপ করা যাবে না।
উল্লেখ্য, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের কৌশলগত অংশীদার হতে চার মাস আগে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসইর) আহŸানে চীন ও ভারতের দুটি কনসোর্টিয়াম বা জোট গঠন করে দরপত্র জমা দেয়। কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসেবে ডিএসইর প্রতি শেয়ারের জন্য চীনা প্রতিষ্ঠান শেনজেন ও সাংহাই স্টক একচেঞ্জ দর প্রস্তাব করেছে ২২ টাকা। বিপরীতে প্রায় একই পরিমাণ শেয়ার কেনার জন্য ১৫ টাকা দরপ্রস্তাব করে ভারতীয় ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের (এনএসই) নেতৃত্বাধীন বিনিয়োগকারীদের আরেকটি কনসোর্টিয়াম। চীনের প্রতিষ্ঠানটি ২৫ শতাংশ শেয়ারের দাম ধরেছে ৯৯২ কোটি টাকা। এ ছাড়া কারিগরি সহায়তা বাবদ ৩০০ কোটি টাকা দেয়ার প্রস্তাব করে। অপর দিকে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানটির দর ছিল ৬৭৬ কোটি টাকা।
ঢাকা স্টক একচেঞ্জ যাচাই-বাছাই করে গত ১৯ ফেব্রæয়ারি ডিএসই চীনের সাংহাই এবং সেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জকে নিয়ে গঠিত কনসোর্টিয়ামকে কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসেবে বেছে নেয়। আর ভারতের এনএসইর নেতৃত্বে গঠিত জোটটি দরপ্রস্তাবে পিছিয়ে থেকে নানাভাবে অনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে ডিএসইর অংশীদার হতে।
পরে ডিএসই’র এ প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি)। তারা একটি পর্যালোচনা কমিটি করে। ওই কমিটি গত ১৫ মার্চ তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। তাই গত মঙ্গলবার বিএসইসি চীনের শেনজেন ও সাংহাই স্টক একচেঞ্জ নিয়ে গঠিত কনসোর্টিয়ামের প্রস্তাব সংশোধন করতে ফেরত পাঠিয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন