বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

সুনামগঞ্জের হাওরে সবুজের সমারোহ

ফসল হারানোর শঙ্কা এবারও কাটছে না কৃষকের

আজিজুল ইসলাম চৌধুরী, সুনামগঞ্জ থেকে : | প্রকাশের সময় : ২৫ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

গত বছরের ক্ষতি মাথায় নিয়ে সুনামগঞ্জের কৃষকরা এবারও বোরো ধান আবাদ করেছেন। ইতোমধ্যে তারা ধান গাছের গোড়ার আগাছা পরিষ্কার করেছেন। ফসলের মাঠ এখন সজীব-সতেজ। জেলার বিস্তীর্ন হাওরগুলো সবুজ রুপ লাভ করেছে। যে দিকে চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। এ যেন সবুজের সমারোহ। ধান গাছে থোর বের হতে শুরু করেছে। ধান গাছের চারা চৈত্রের বাতাসের সাথে খেলছে। ধান গাছ বাতাসের ধাক্কায় হেলেদোলে পড়ছে। হাওরের এমন দৃশ্য কৃষকদের পুলকিত করে তোলে। বোরো ফসলের উপর নির্ভরশীল এ অঞ্চলের কৃষকরা আগামী বৈশাখ মাসে ধান গোলায় তোলার স্বপ্ন দেখছেন। এ ধানকে নিয়েই তারা স্বপ্ন দেখছেন আগামী দিনের। ধান গোলায় উঠলে কৃষকদের পরিবার আনন্দময় হয়ে উঠবে। নতুবা বিষাদের ছায়া নেমে আসবে। গত বছর ফসল হারিয়ে এ জেলার কৃষকরা স্বর্বসান্ত হয়েছে। গত বছরের মার্চের শেষ ও এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের বৃষ্টি হয়েছিল কৃষকের কাল। এ বৃষ্টি হাওরের বাঁধ ভেঙে নিয়ে যায় (ডুবে যায়) সকল ফসল। তাই জেলা বাসীর দৃষ্টি এখন হাওরের বেড়ী বাঁধ নির্মানের দিকে। ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২৮ ফেব্রæয়ারীর মধ্যে জেলার সব কয়টি বেড়ী বাঁধ নির্মান করার কথা থাকলেও তা হয়নি। দু‘দফা সময় বাড়ালেও এখনও কিছু বাঁধে কাজ চলছে। তাই ফসল হারানোর শঙ্কা এবারও কাটছে না কৃষকদের। তাদের ভয় গত বছরের মত এবারও অতিবৃষ্টি, আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে বাঁধ ভেঙে স্বপ্ন চুরমার করে দেয় কিনা।
সূত্র মতে জেলার ১১টি উপজেলায় এবার ২ লাখ ২১ হাজার ৭৫০ হেক্টর ভূমিতে বোরো আবাদ করা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় ৫২টি হাওরে বেড়ী বাঁধ (ফসলরক্ষা বাঁধ) নির্মাণের জন্য ৯ শত ৬৪ টি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। বরাদ্দ দেয়া হয় ১ শত ২২ কোটি টাকা। এ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করছে স্থানীয় ভাবে গঠিত পিআইসি (প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশেন কমিটি)। গত বছর হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণে পাউবোসহ বাঁধ নির্মাণকারীদের বিরুদ্বে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। ঠিকাদার ও পাউবোর কর্মকর্তাদের বিরুদ্বে দুর্নীতির মামলা করে দুদক। সুনামগঞ্জ আইনজীবি সমিতির পক্ষ থেকে অ্যডভোকেট আব্দুল হক বাদী হয়ে আরেকটি দুর্নীতির মামলা করেন পি আইসি, ঠিকাদার ও পাউবোর কর্মকর্তাদের বিরুদ্বে। গত বছর জেলার সব কয়টি হাওরের বাঁধ ভেঙে আড়াই হাজার কোটি টাকারও বেশী ফসল ডুবে যায়। সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ হয় জেলার ৩ লক্ষাধিক কৃষক পরিবার। এই ক্ষতির প্রভাব পড়ে সকল শ্রেণি পেশার মানুষের উপর। জেলার সর্বত্র দেখা দেয় অভাব অনটন। ধান-চালের দাম বেড়ে গেলে এ অঞ্চলের হাওর পারের মানুষ কাজের সন্ধানে ছুটে যায় দেশের বিভিন্ন স্থানে। গত বছরের ফসল বিপর্য়য়কে সামনে রেখে এবার পানি সম্পদ মন্ত্রনালয় বাঁধ নির্মাণে নতুন নীতিমালা করে। বাদ দেয়া হয় ঠিকাদারি প্রথা। নীতিমালা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট হাওরের কৃষক এবং যাদের জমি হাওরে রয়েছে তাদের সমন্বয়ে পি আইসি গঠিত হয়। সরাসরি সংযুক্ত করা হয় জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে তদারকি করছে। বিভিন্ন উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তারা দাবি করছেন জেলার হাওর রক্ষা বাঁধ প্রকল্পগুলোর কাজ প্রায় শেষ। কিছু কিছু প্রকল্পে (বাঁধে) ড্রেসিং, লেভেলিংসহ মাটি মজবুত করার কাজ চলছে। জামালগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা শামীম আল ইমরান, দিরাই উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মঈনউদ্দিন ইকবাল ও ধর্মপাশা উপজেলার নির্বার্হী কর্মকর্তা মো: মামুন খন্দকার জানান তাদের উপজেলার প্রকল্পগুলোর কাজ প্রায় শেষ। এবার কাজ ভাল হয়েছে। দিরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মঈন উদ্দিন ইকবাল ইনকিলাবকে বলেন তুফান খালী বাঁধ নিয়ে অনেকেই নানা কথা বলেছেন। এবার এ বাধ মজবুত ও সুন্দরভাবে নির্মাণ হয়েছে। জগন্নাথপুর ও শাল্লা উপজেলার কৃষকরা বলছেন কিছু প্রকেল্পর কাজ এখনও চলছে। শাল্লা উপজেলায় কয়েকটি প্রকল্পের কাজে ধীর গতি হওয়ায় ‘হাওর বাঁচাও, সুনামগঞ্জ বাঁচাও‘ আন্দোলনের ব্যানারে মানব বন্ধন হয়েছে। দিরাই ,শাল্লাসহ বিভিন্ন এলাকার কৃষকরা অভিযোগ তুলেছেন বাঁধের গোড়া থেকে পি আইসির সদস্যরা এক্সেভেটর দিয়ে বাধের গোড়া থেকেই গর্ত করে বাঁধে মাটি তুলেছেন। ফলে সামান্য বৃষ্টিপাতে বাঁধ ভেঙে ফসল ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষকরা।
অপ্রয়োজনীয় বাঁধ নির্মাণ : ১১টি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অপ্রোয়জনীয় বাঁধ নির্মাণের অভিযোগ তুলেছেন কৃষকরা। যেখানে বাঁধ নির্মাণের প্রয়োজন নেই সেখানে বাঁধ নির্মান করা হয়েছে। এতে সরকারের বিপুল পরিমান অর্থ অপচয় হয়েছে বলে মনে করছেন তারা। হাওর বাঁচাও, সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি মুক্তিযোদ্বা এডভোকেট বজলুল মজিদ চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার কাজ ভাল হয়েছে। তবে আমরা বিভিন্ন হাওর ঘুরে দেখেছি অনেক স্থানে কিছু অপ্রয়োজনীয় বাঁধ নির্মান করা হয়েছে। বিশ্বম্বরপুর উপজেলার বিভিন্নস্থানে অপ্রোয়জনীয় বাঁধ নির্মাণ করে সরকারের টাকা অপচয় করা হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় এ প্রকল্পগুলো কার স্বার্থে নেয়া হয়েছে আমরা জানি না। তিনি আরো বলেন শুধু সুনামগঞ্জ সদর উপজেলায় এভাবে অন্তত ১৫ থেকে ২০টি অপ্রয়োজনীয় বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। আমরা বিভিন্নস্থানে নির্মিত অপ্রয়োজনীয বাঁধের একটি তালিকা তৈরী করার চেষ্টা করছি। বাঁধ নির্মাণে বিলম্বের কারণ : সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন এবার অনেক হাওরে পানি নামতে দেরি করেছে। তাই সময় মত বাঁধ নির্মাণে হাত দেয়া সম্ভব হয়নি। দেরিতে কাজে হাত দেয়ায় কাজ শেষ করতে দেরি হয়েছে। তাছাড়া স্থানীয় পি আইসি সদস্যদের কিছু গাফিলতিতে রয়েছেই। এমনকি স্থানীয়ভাবে কাজের প্রকল্প নির্ধারণ ও প্রাক্কলন তৈরীতে বিলম্ব হওয়ায় নির্ধারিত সময়ে কাজ শুরু করা যায় নি। কিছু কিছু এলাকায় প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করতেও কিছুটা দেরী হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে স্থানীয় কৃষকরা বলছেন হাওর থেকে পানি দেরীতে নামার বিষয়টিতো আছেই তবে শুরুতেই পাউবোর ও স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বয়হীনতা ছিল। ফলে কাজ শুরু করতে দেরী হওয়ায় শেষ করতে দেরী হচ্ছে।
পানি সম্পদ মন্ত্রীর একাধিকবার হাওর পরিদর্শন : পানি সম্পদমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব গ্রহণের পর মন্ত্রনালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে দু‘বার সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওর পরিদর্শন করেছেন। তিনি হাওরের বিভিন্ন বাঁধ নির্মাণ সরেজমিন দেখেছেন। কথা বলেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন হাওরের কৃষকদের সাথে। হাওরের সমস্যা বুঝতে চেষ্টা করেছেন। তিনি কৃষকদের উদ্দ্যেশ্যে বার বার বলেছেন এবার সবাই মিলে হাওর রক্ষা করতে হবে। যার যে ভাবে সহযোগীতা দরকার সে ভাবেই বাঁধ নির্মাণসহ হাওর রক্ষায় সহযোগীতা করতে হবে। প্রয়োজনীয় বরাদ্ব দেয়া হবে। বাঁধ ভালভাবে নির্মাণ করতে হবে। বাঁধের কারণে যেন কৃষকদের সর্বনাশ না হয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরও সেই ভাবেই কাজ করার নির্দেশনাও দিয়েছেন তিনি। গতবছর হাওর রক্ষা বাঁধের জন্য বরাদ্দ ছিল ৬৮ কোটি টাকা। এবার পানিসম্পদ মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বরাদ্দ বাড়িয়েছেন। দেয়া হয়েছে ১ শত ২২ কোটি টাকা। পানিসম্পদ মন্ত্রীর হাওর পরিদর্শনকালে হাওর রক্ষায় তার আন্তরিকতা দেখে স্থানীয় কৃষকরা অভিভূত হয়েছেন। জামালগঞ্জের ভান্ডা-মাখরখলা এলাকায় হাওর পাড়ে এক কৃষক সমাবেশ শেষে কোন কোন কৃষক মন্ত্রীর জন্য হাত তুলে দোয়া করেছেন। কেউ কেঊ বলেছেন “সব মন্ত্রীরা যদি এমন হতো“। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: আবুবকর সিদ্দিক ভুঁইয়া ইনকিলাবকে বলেন, বাঁধের কাজ প্রায় শেষের দিকে। সার্বিক দিক থেকে বলা যায় ৯ শত ৬৪ টি প্রকল্পের ৮৯ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। কিছু প্রকল্পের কাজে মাটি লেভেলিং, ড্রেসিং, মজবুতকরণসহ দুর্বাঘাস লাগানো হচ্ছে। জগন্নাথপুর উপজেলার একটি প্রকল্পের কাজ চলমান থাকায় তিনি বলেন এর মধ্যেই এটির কাজ শেষ হয়ে যাবে। বিভিন্ন স্থানে অপ্রয়োজনীয় বাঁধ নির্মাণের অভিযোগ সম্পর্কে পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন,এ বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসকের সাথে কথা হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় বাঁধের বিলের বাকী বিল না দেওয়ার নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন