বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

সনাতন ধর্মে নারী

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান | প্রকাশের সময় : ২৯ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

সনাতন ধর্মে নারীর প্রতি সহিংসতা বিরুদ্ধে। নারী যেন কোন সহিংসতার শিকার না হয় তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সনাতন ধর্মে উল্লেখ রয়েছে কোন কোন ক্ষেত্রে ধর্মের নামে নারী নির্যাতিত হয়, নারী সহিংসতার শিকার হয়। এ মূলে রয়েছে পুরুষ সমাজের নারীকে বশীভূত রাখার প্রভূসুলভ অসুস্থ মানসিকতা এবং কখনো কখনো ধর্মের অপব্যাখ্যা ও অপব্যবহার। বর্তমান বিশ্বের সর্বত্র নারী নানাভাবে সহিংসতার শিকার। খুন, গুম, অপহরণ, উত্যক্তকরণ, মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন, বৈষম্য, ধর্ষণ প্রভৃতি নারীদের জীবনযাত্রা বিভীষিকাপূর্ণ করে তুলেছে। নারীদের ক্ষেত্রে যদি ধর্মীয় প্রদত্ত নির্দেশনা ও আইনগুলো সবাই মেনে চলতো তাহলে নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা এমন প্রকট আকার ধারন করতো না। এ প্রবন্ধে ধর্মে নারীদের অবস্থা ও অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। ধর্মীয়ভাবে তাদের প্রতি বৈষম্য ও নির্যাতনের যে কোন সুযোগ নেই তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আর ধর্মীয় আইনসমূহ যে একান্তই নারীর প্রতি সংবেদশীল তা প্রমাণ করা হয়েছে। প্রবন্ধটি ভাবে নারীর প্রতিরোধে সচেতনতা তৈরি করবে, এ বিষয়ক আইনগুলো জানা থাকায় ধর্মের ভিত্তিতে নারীকে নির্যাতনের শিকার বানানোর পথরুদ্ধ করবে এবং ধর্মসমূহের অনুসারীদের মধ্যে সমপ্রীতির মেলবন্ধন তৈরিতে ভূমিকা রাখবে।
যম্মান্নোদ্বিমতে লোকে লোকোন্নোদ্বিমতে চযঃ। হর্ষামর্ষ ভয়োগ বেগে মুক্তো যঃসচমে প্রিয়। বা যা থেকে কোন প্রাণি উদ্বেগপ্রাপ্ত হয় না এবং যিনি স্বয়ং কোনো প্রাণি কর্তৃক উত্ত্যক্ত হন না, যিনি হর্ষ, অর্ঘষ, ভয় ও উদ্বেগ হতে মুক্ত, তিনি আমার প্রিয়। এ শ্লোক হতে বুঝা যায়, যিনি সত্যই অহিংস ব্রতে স্থিত, তাঁকে কেউ হিংসা করে না। যিনি অচদ্বষ্টা সর্বভূতানাং। বা যিনি সকল প্রাণির প্রতি দ্বেষ রহিত তিনি আমার প্রিয়। তাই কেবল নারীকে নয় বরং জগতের সমস্ত প্রাণির প্রতি ভালবাসা এবং সকলের প্রতি অহিংস আচরণ সনাতন ধর্মের মূল শিক্ষা।
যেখানে নারীগণ সম্মানিত হন সেখানে দেবগণ প্রীত হন। যেখানে নারীগণ সম্মানিত হন না, সেখানে সকল কর্ম নিস্ফল হয়। বহু কল্যাণকামী তপতা, ভ্রাতা, পতি ও দেবর কর্তৃক কন্যা সম্মানীয় ও ভূষনীয়। যেখানে ভগিনী, পত্নী, কন্যা ও ভ্রাতৃবধূ প্রমুখ দুঃখ করেন, সে বংশ শীঘ্রই বিনষ্ট হয়। যেখানে এরা দুঃখ করেন না, সে বংশ সবসময় উন্নতি করে। মনুসংহিতায় রয়েছে মন্ত্র নার্যত্ত পৃদ্যন্তে রমন্তে তত্র দোতা, যত্রৈতা¯ত্ত ন পৃদ্যন্তে সর্বস্ত্রতা ফলাঃ ক্রিয়া।
সনাতন ধর্মেও রয়েছে, যারা মারাত্মকভাবে সহিংস আচরণ করেছে তাদের জন্য কাঠোর শান্তি ব্যবস্থা আইনে থাকতে হবে এবং নির্দ্বিধায় সেটি প্রয়োগ করতে হবে। শাস্তি না পেলে অপরাধী আরো বেশি অপরাধ করার সাহস পাবে এবং অন্যরাও একই অপরাধ সংঘটনে উৎসাহিত হবে। মহাভরতে নির্দেশ রয়েছে, ভূমি হরণকারী, গৃহে অগ্নিদানকারী, বিষ প্রয়োগকারী, স্ত্রীর উপর নির্যাতনকারী এবং অপহরণকারীকে মৃত্যুদন্ড দিতে হবে। আততায়ীকে নির্বিচারে হত্যা করবে। যারা কর্তন করে তাদের রাজা উদ্বেগজনক দন্ড দ্বারা চিহ্নিত করে নির্বাসিত করবেন।
সনাতন ধর্মে নারীকে নানাভাবে সম্মানিত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বৃহদাণ্যক উপনিষদে বলা হয়েছে, সৃষ্টিকর্তা বিরাট পুররু। তিনি আপন সৃষ্টি বৈচিত্রকে উপলব্ধি করার জন্য নারীসত্তা সৃষ্টি করেছেন। তিনি আত্মবেদমগ্র আসীদেক এবং সেৎকাময়ত জায়া মে স্যাহ অর্থাৎ সৃষ্টির পূর্বে সৃষ্টিকর্তাই একমাত্র ছিলেন। তিনি কামনা করলেন, আমার জায়া উৎপন্ন হোক। উপনিষদের এ বাণী প্রকৃতপক্ষে নারী জাতির মহিমাকেই নির্দেশ করে। বিয়ের মাধ্যমে একজন পুরুষ ও একজন নারী দাম্পত্য জীবনে আবদ্ধ হয়। এ সময় যে ধর্মীয় অনুশাসনের ভেতর দিয়ে বিয়ের কাজ সম্পন্ন হয় সেগুলোর মূল্যবোধ ধারণ করলে কোনো স্বামীই স্ত্রীকে নিপীড়ন করতে পারে না। বিয়ের মন্ত্রে বলা হয়, যদিদং হৃদয়ং তব তদিদং হৃদয়ং মম অর্থাৎ তোমার হৃদয় আমার হোক, আমার হৃদয় তোমার হোক। বৈদিক মন্ত্রে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলা হয়, হে বধু! তুমি সুমঙ্গলী হয়ে পাতিগৃহে প্রবেশ কর। আমাদের এবং চতুস্পদ জীবের মঙ্গলবহ হও। তুমি কল্যাণনেত্রা হও, পতির মঙ্গল বিধান কর। গৃহপালিত পশুদের হিতকারিণী হও। তোমার মন সুন্দর হোক, তোমার তেজ শোভন হোক। তুমি বীরজনীন, দেবপরায়ণা এবং সকরের সুখদায়িনী হও। নববধুকে লক্ষ্য করে আরও বলা হয়েছে, সম্রাজ্ঞী শ্বশুরে ভব সম্রাজ্ঞী শ্বস্রাং ভব। ননান্দরি সম্রাজ্ঞী ভাব সম্রাজ্ঞী অধিদেবৃষুঃ\
অর্থাৎ তুমি শশুরের উপর সম্রাজ্ঞী হও, শাশুরির উপর সম্রাজ্ঞী হও, ননদের উপর সম্রাজ্ঞী হও এবং দেবরের উপরও সম্রাজ্ঞী হও। মহাভারতে বলা হয়েছে, ভাষা মানুষের অর্ধাংশ এবং শ্রেষ্ঠতম সখা। ভাষা, ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষের মূল। ভাষাযুক্ত ব্যক্তিরাই ক্রিয়াবান হতে পারেন। ভাষা থাকলেই গৃহীর কর্তব্য পালন করা সম্ভব। ভাষা থাকলে আনন্দ ও শ্রীলাভ হয়। প্রিম্বদা ভার্ষা জনবিরল স্থানে সখার, ধর্মকার্যে পিতার এবং রোগে মাতার কাজ করে থাকেন। ধর্মীয় বিধান মেনে যে স্ত্রী এমন আচরন করেন সনাতন ধর্মীয় কোন পুরুষ তার সঙ্গে কোনক্রমেই সহিংস আচরণ করতে পারে না। সনাতন ধর্মে নারী জাতি। অর্থাৎ মাকে যেমন ভক্তি শ্রদ্ধা করা উচিত নারীকেও তেমনি শ্রদ্ধা ও সম্মান দেখানো কর্তব্য। শাস্ত্রে বলা হয়েছে, মাতৃবৎ পরদারেষু যঃপশ্যতি সপন্ডিত অর্থাৎ যিনি পরস্ত্রীকে মায়ের মত করে দেখেন তিনিই পন্ডিত।
সনাতন ধর্মে মাকে স্বর্গের চেয়েও শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী। অন্যত্র বলা হয়েছে, মাতা কিল মনুস্যণাং দৈবতানাং চ দৈবতম অর্থাৎ মাতা মনুষ্য এবং দেবতারও দেবতা। সনাতন ধর্মে ব্রহ্ম এবংব্রহ্মশক্তি অভিন্ন। শাস্ত্রে ব্রহ্মশক্তিকে মাতৃরূপে কল্পনা করা হয়েছে। দেবী চন্ডী, দূর্গা, লক্ষী, সরস্বতী, কালী প্রভৃতি দেবীগণ মাতৃজাতিরই প্রতিনিধি। অমিতভক্তে তাঁরা পূজিত হয়ে থাকেন। সনাতন ধর্মীয় শিক্ষা সঠিকভাবে ধারণ করলে, মেনে চললে, অনুসরণ ও অনুশীলণ করলে কোনো হিন্দুর পক্ষে নারীকে নিপীড়ন করা ও নির্যাতন করা সম্ভব হবে না। নারীর প্রতি সহিংস আচরণ করা অসম্ভব হবে।
সনাতন ধর্মীয় আইন নারী নির্যাতন সমর্থন করে না বরং নারীকে নির্যাতন থেকে সুরক্ষার জন্য সর্বোতভাবে চেষ্টা করে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধের জন্য যেমন বিস্তারিত ও সুনির্দিষ্ট আইন প্রদান করা হয়েছে তাতে সনাতন ধর্মের অনুসারী কোনো ব্যক্তির পক্ষে ধর্মীয় কারণেই কোনো ধরনের নারী নির্যাতনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। সনাতন ধর্মের নারী নীতিও একান্তভাবে এটাই প্রমাণ করে ধর্মগুলোর নিষ্ঠাবান কোনো অনুসারী নারী নির্যাতন করতে পারে না। এমনকি তাদের সামনে কোনো নারী নির্যাতনে শিকার হতে পারে না। ধর্মীয় শিক্ষা ও আবেগের জন্যই তারা নারীকে নির্যাতন থেকে রক্ষা করতে তৎপর হয়ে ওঠেন। সকল ধর্মানুসারী লোকের মধ্যে তাদের স্ব স্ব ধর্ম অনুসারে নারী নির্যাতন প্রতিরোধক শিক্ষা ও বিধি সমূহের নির্মোহ, নিরপেক্ষ এবং সঠিক প্রচারণা চালানো হলে এবং তাদেরকে ধর্মীয় আর্দশ ও চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা গেলে বাংলাদেশে সমন্বিতভাবে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সম্ভব হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন