টাঙ্গাইলের সখিপুর উপজেলায় বন বিভাগের জমির পরিমাণ ৫০ হাজার একর। বন বিভাগের এ জমি সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত। ইনকিলাবে প্রকাশিত এ খবরে জানানো হয়েছে, এই ৫০ হাজার একর জমির মধ্যে ৩০ হাজার একর জমি স্থানীয় প্রভাবশালীরা দখল করে নিয়ে পোল্ট্রি ফার্ম, ফ্যাক্টরি, বাড়িঘর নির্মাণ করেছে। কিছু জমি কৃষি কাজেও তারা ব্যবহার করছে। খবরে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতর ৮৫টি করাতকল গড়ে উঠছে। বন বিভাগের বৃক্ষ কর্তন করে এসব করাতকলে টুকরো টুকরো করে পাচার করা হচ্ছে। এই অবৈধ দখল উচ্ছেদ ও জমি উদ্ধার বন বিভাগের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। ক্ষমতাসীন দলের লোকজন দখলের সঙ্গে জড়িত থাকায় বন বিভাগের স্থানীয় কর্মকর্তারা কিছুই করতে পারছেন না। টাঙ্গাইলের ডিএফও জানিয়েছেন, লোকবল সঙ্কট ও রাজনৈতিক কারণে বন বিভাগের জমি বেদখল হয়ে যাচ্ছে। খবরে বর্ণিত এই বিবরণ ও দখলচিত্র শুধু দুঃখজনক নয়, উদ্বেগজনকও বটে। বলা বাহুল্য, কোনো সংরক্ষিত বনাঞ্চলের অবস্থাই এর চেয়ে ভালো নয়। তাবৎ সংরক্ষিত বনাঞ্চলেই অবৈধ দখল ও বৃক্ষবিনাশ অব্যাহত আছে। সব দখল ও বৃক্ষবিনাশের সঙ্গেই স্থানীয় প্রভাবশালী মহল, ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী এবং বন বিভাগের একেেশ্রণীর কর্মকর্তা জড়িত। পরিকল্পিত বৃক্ষায়ন, বনায়ন এবং পরিবেশিক ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের বৃহত্তর লক্ষ্য সামনে রেখেই দেশের বিভিন্ন স্থানে সংরক্ষিত বনাঞ্চল গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু কোনো সংরক্ষিত বনাঞ্চলেই এই লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হচ্ছে না। অবৈধ দখল এবং নির্বিচার বৃক্ষ নিধন ও চুরিই এ জন্য প্রধানত দায়ী। বন বিভাগের অক্ষমতা, অপারগতা এবং দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতাও কম দায়ী নয়।
প্রশ্ন উঠতে পারে, সংরক্ষিত বনাঞ্চল যদি সংরক্ষিতই না থাকে, বনের জমি যদি বেদখল হয়ে যায় কিংবা বৃক্ষকর্তনে বন উজাড় হয় তাহলে নামকাওয়াস্তে এই সংরক্ষিত বনাঞ্চলের দরকার কি? বিদ্যমান বাস্তবতায় সংরক্ষিত বনাঞ্চল থাকা আর না থাকা সমান কথা। কিন্তু দেশের প্রয়োজনে পরিবেশ-প্রতিবেশের প্রয়োজনে, জীবনবৈচিত্র্য সংরক্ষণের প্রয়োজনে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে, প্রয়োজন রয়েছে ব্যাপক বৃক্ষায়নের। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ বনভূমি রক্ষা করতে পারছে না, বৃক্ষের নিরাপত্তা দিতে পারছে না। লোকবল স্বল্পতাই এর একমাত্র কারণ নয়। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্বল অবস্থানও এর উল্লেখযোগ্য বড় কারণ। সরকার একদিকে বনায়ন-বৃক্ষায়নের কথা বলছে অন্যদিকে সরকারি দলের লোকজনকে বনভূমি দখল ও বৃক্ষনিধন থেকে নিবৃত করতে পারছে না। এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ড চলতে পারে না। এমনও দেখা যাচ্ছে, সরকার স্বয়ং সংরক্ষিত বনাঞ্চলে স্থাপনা বা কারখানা করার অনুমতি দিচ্ছে। সাম্প্রতিক এক খবরে জানা গেছে, মহেশখালীর সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের অধীন ইস্টার্ন রিফাইনারি একটি অপরিশোধিত তেলের ডিপো তৈরির জন্য পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের কাছে ১৯১ একর জমি চেয়েছে। সংরক্ষিত বনাঞ্চলে তেলের ডিপো কিভাবে হতে পারে? আমরা আশা করি, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এই অনুমতি দেবে না। সরকারকে স্পষ্ট করে জানাতে হবে, সংরক্ষিত বনাঞ্চলের চরিত্র বদল করা যাবে না, তাতে কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। সরকার সুন্দরবন সংলগ্ন রামপালে ভারতের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা নিয়ে বিরোধিতা ও প্রতিবাদ অব্যাহত আছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রে দীর্ঘমেয়াদে সুন্দরবনের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করবে। এমতাবস্থায়, বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিষয়টি সরকারের পুনর্বিবেচনা করা উচিত বলে আমরা মনে করি।
পরিবেশগত ভারসাম্য ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে কোনো দেশের মোট আয়তনের অন্তত ২৫ শতাংশে বনভূমি থাকা উচিত। আমাদের দেশে আছে ১০ শতাংশের নিচে। এরপর যদি সংরক্ষিত বনাঞ্চল সঙ্কুচিত হয়, বৃক্ষনিধন চলতে থাকে তাহলে প্রতিক্রিয়া কি হবে, তা সহজেই আন্দাজ করা যায়। নদী বন, পাহাড়, প্রকৃতির ভারসাম্য সংরক্ষণ করে। আমাদের বনভূমি পর্যাপ্ত নয়। ভারতের পানি রাজনীতির কারণে নদ-নদী অস্তিত্ব হারাচ্ছে। অন্যদিকে চলছে বেপরোয়া পাহাড় কর্তন। আবহাওয়ার পরিবর্তনজনিত কারণে দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশেষ করে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, খরা, বন্যা ইত্যাদি বাড়ছে। এই প্রেক্ষপটে বনভূমি সঙ্কুচিত হলে, বৃক্ষ উজাড় হলে, উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী উচ্ছেদ হলে আগামীতে দেশে অভাবিত বিপর্যয় নেবে আসবে। আশঙ্কার এই দিকটি বিবেচনায় নিয়ে সংরক্ষিত বনাঞ্চল রক্ষাই শুধু নয়, বাড়াতে হবে। উপকূলে সবুজায়ন, বৃক্ষায়ন, বৃক্ষবেষ্টনীর কর্মসূচি জোরদার করতে হবে। নদী রক্ষাসহ সার্বিক পানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সরকার এসব কাজে অধিকতর গুরুত্ব প্রদান করবে, আমরা এটাই প্রত্যাশা করি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন