বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

মন্ত্রীর কঠোরতায় সরছে ট্যানারি

প্রকাশের সময় : ৩ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

স্টাফ রিপোর্টার : সরকারের পক্ষ থেকে দফায় দফায় সময় আর সুযোগ-সুবিধা দিলেও ট্যানারি স্থানান্তর না হওয়ায় কঠোর অবস্থান নিয়েছে প্রশাসন। ফলে বাধ্য হয়ে ট্যানারির স্থানান্তর শুরু করেছে মালিকরা। গতকাল যন্ত্রপাতি ট্রাকে করে সাভারের হেমায়েতপুরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। অন্যদিকে কাঁচা চামড়া যাতে ঢুকতে না পারে সে জন্য ট্যানারি এলাকায় পুলিশের টহল বাড়ানো হয়েছে। প্রবেশ পথগুলোতে বসানো হয়েছে চেকপোস্ট।
এদিকে কোনভাবেই হাজারীবাগে কাঁচা চামড়া ঢুকতে দেয়া হবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু। এছাড়া ব্যাংক ঋণের বিষয়ে ট্যানারি মালিকদের দাবির বিষয়ে শিল্প মন্ত্রণালয় কিছু ভাবছে না বলেও জানান তিনি। গতকাল (শনিবার) দুপুরে বসুন্ধরা আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টারে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন তিনি।
কয়েকটি ট্যানারির মালিক, কর্মকর্তা ও পুলিশ সদস্যরা বলছেন, ৩১ মার্চের পর ট্যানারিগুলোতে নতুন করে আর কোনো কাঁচা চামড়া ঢোকেনি। কয়েকজন পুলিশ সদস্য বলেন, আগে থেকেই বিষয়টি নির্ধারিত ছিল। এ কারণে মালিকেরা সেভাবেই কাজ করেছেন। তবে পুলিশ তৎপর আছে। কোনোভাবেই কাঁচা চামড়া নিয়ে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হবে না।
হাজারীবাগ থানার পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) আবুল কালাম আজাদ বললেন, তাঁরা সব প্রবেশপথে চেকপোস্ট বসিয়েছেন। পাশাপাশি টহলও চলছে। কাঁচা চামড়া নিয়ে কেউ ঢোকার চেষ্টা করেছেন এমন খবর তিনি পাননি। ট্যানারির কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়া করার ড্রামগুলো (ট্যানিং ড্রাম) সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে।
হাজারীবাগ এলাকায় গিয়ে কয়েকটি ট্যানারির যন্ত্রপাতি ট্রাকে করে সাভারের হেমায়েতপুরের দিকে নিতে দেখা গেছে। ঢাকা হাইড অ্যান্ড স্কিন লিমিটেডের হিসাবরক্ষক আবুল কালাম আজাদ বললেন, তাঁদের ট্যানারির কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়া করার ড্রামগুলো (ট্যানিং ড্রাম) সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। আজ চারটি ড্রাম সাভারে নেওয়া হয়েছে। আগে ১০টি নেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া সাভারে আরও ৩০টির মতো ড্রাম তৈরি করা হয়েছে।
কয়েকটি ট্যানারিতে আগের পুরোনো চামড়া দিয়ে পণ্য উৎপাদন চলছে। এগুলো শেষ হলে কারখানাগুলোর কাছে আর কোনো চামড়া থাকবে না। তবে সাভারে কারখানাগুলোতে পুরোদমে কাজ শুরু করতে কমপক্ষে দুই থেকে তিন মাস সময়ের প্রয়োজন হবে বলে কয়েকজন মালিক জানিয়েছেন।
তবে কাঁচা চামড়া ঢুকতে না দেওয়ায় সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে চামড়া পরিবহন শ্রমিকেরা। ট্যানারি মালিকেরা বলেছেন, এরা বেশির ভাগই বেকার হয়ে পড়বেন। তবে শ্রমিক রশিদ মিয়া বলেছেন, হাজারীবাগে তাঁর পরিবার বহু বছর ধরে বসবাস করছেন। তাই এই জায়গা ছেড়ে সাভারের হেমায়েতপুরে ট্যানারিতে কাজ করতে যাবেন না।
শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেছেন, আমরা আমাদের সিদ্ধান্তে অটল আছি। ব্যবসায়ীরা কি করবেন, সেটা তাদের ব্যাপার। তারা ব্যাংক ঋণ পাবেন কি-না তাও আমি জানি না। হাজারীবাগে কোনো কাঁচা চামড়া ঢুকবে না। রাজধানীর বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টারে বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার এসোসিয়েশনের (বিএফএ) বার্ষিক সাধারণ সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন তিনি।
মন্ত্রী বলেন, আমি আগেই নির্দেশ দিয়েছি, ৩১ মার্চের পর হাজারীবাগে কোনো কাঁচা চামড়া প্রবেশ করবে না। যে কাঁচা চামড়া সাধারণত বায়ু দূষণ করে পরিবেশ নষ্ট করে, নদীর পানি নষ্ট করে, সেই কাঁচা চামড়া ‘ইমিডিয়েটলি রিমুভ’ (অপসারণ) করতে হবে। এ ব্যাপারে ব্যবসায়ীদের বেশি করে উদ্যোগ নিতে হবে।
এর আগে বিএফএ’র বার্ষিক সাধারণ সভায় মন্ত্রী বলেন, নিরবচ্ছিন্ন কৃষি উৎপাদনের স্বার্থে আমরা দেশব্যাপী সারের সুষ্ঠু সরবরাহ, বিপণন, বিতরণ ও আমদানি নিশ্চিত করেছি। গত ভরা মৌসুমে দেশের কোথাও কোনো সারের সংকট হয়নি।
তিনি বলেন, ডিলারদের দাবির প্রেক্ষিতে আমরা ইউনিয়ন পর্যায়ে শূন্য কোটা ছাড়া অংশ বিশেষের জন্য নতুন ডিলার নিয়োগ বন্ধ রেখেছি। আগামীতে বিসিআইসি’র ডিলারদের মাধ্যমেই সব ধরনের সার বিতরণের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হবে বলেও আশ্বাস দেন মন্ত্রী।
স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, চামড়া কারখানাগুলোতে মূলত রাত ১২টার পর থেকে মালামাল খালাসের কাজ শুরু হয়। তবে দিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ঠেলাগাড়ি দিয়ে চামড়া আসতো। এগুলো কারখানাগুলোর সামনে রাখা হতো। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাতে চামড়ার ট্রাকের বিশাল লাইন থাকলেও শুক্রবার সকালে তা দেখা যায়নি।
তবে যেসব কারখানা বৃহস্পতিবার ভোর রাতের মধ্যে কাঁচা চামড়া প্রবেশ করাতে পারেনি তারা সেগুলো কারখানার সামনে রেখেছিল। কিন্তু পুলিশি তৎপরতার কারণে শুক্রবার সকালে চমড়া কারখানার ভেতরে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তবে অন্য দিনের মতো কারখানার সামনে কাঁচা চামড়া যত্রতত্র রাখতে দেখা যায়নি। ফলে চামড়া কারখানাগুলোর সামনের পরিবেশ ছিল বেশ পরিচ্ছন্ন। তাছাড়া ছুটির দিন হওয়ায় কারখানাগুলো ছিল বন্ধ।
এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার যে আলটিমেটাম দিয়েছিল তা বাস্তবায়ন হচ্ছে। এপ্রিল মাসের প্রথম দিন কারখানায় কোনো কাঁচা চামড়া প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। অনেকটা পুলিশি হয়রানির ভয়েই হাজারীবাগে কাঁচা চামড়া প্রবেশ করছে না বলে জানিয়েছেন তারা। তবে কাঁচা চামড়া হাজারীবাগে না প্রবেশ করলেও পোস্তায় তা সাময়িক সময়ের জন্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
এদিকে, হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তরের জন্য সরকারের আল্টিমেটাম, হাইকোর্টের নির্দেশ, আন্তর্জাতিক চাপে এ শিল্প সাভারে স্থানান্তর করার প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের ধরে রাখার চেষ্টা। সব মিলিয়ে অস্তিত্ব সংকটে আছেন ট্যানারি মালিকরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ট্যানারি মালিক বলেন, চট্টগ্রামে যেসব কাঁচা চামড়া ক্রয় করা হয়েছে সেগুলো বৃহস্পতিবার রাতে হাজারীবাগের কারখানায় এসেছে। শুক্রবার সকালের মধ্যে সেগুলো কারাখানায় ঢুকানো হয়েছে। তবে শুক্রবার সকালে কোনো কারখানার সামনে সেই চামড়া রাখা হলেও পুলিশের তৎপরতায় সেগুলো কারখানার ভেতরে নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, প্রতিদিন কাঁচা চামড়া কেনা হচ্ছে। সেগুলো হাজারীবাগের কারখানায় প্রবেশের সুযোগ না দিলেও সাময়িকভাবে পোস্তায় রাখা হচ্ছে।
বাংলাদেশে ট্যানার্স এসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান (মিজান) বলেন, হাজারীবাগ থেকে সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে যাওয়ার প্রক্রিয়া শেষের দিকে। সেখানে কার্যক্রম শুরু করা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। তবে যেসব ব্যবসায়ীর কাঁচা চামড়া কেনা রয়েছে তাদের চামড়া হাজারীবাগে প্রবেশ করতে দেয়া উচিৎ বলে মনে করেন তিনি।
হাজারীবাগ ইব্রাহিম ট্যানারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপকালে তারা বলেন, আমাদের কিছু মালামাল বৃহস্পতিবার রাতে চট্টগ্রাম থেকে এসেছে। সব মালামাল রাতে কারখানায় প্রবেশ করাতে পারিনি। ফলে কারখানার সামনে কিছু চামড়া রাখা ছিল। শুক্রবার সকালে পুলিশ এসে সেগুলো কারখানার ভেতরে রাখতে বলে। পরে সেগুলো কারখানায় ভেতরে নিয়ে রেখেছি। তবে নতুন করে কেনা চামড়া হাজারীবাগ কারখানায় আনা হবে না বলেও জানান তারা।
হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সাভারের চামড়া শিল্পনগরীতে স্থানান্তরে অনেক সময় পেলেও, এখন যখন সরকার কঠোর হয়েছে তখন ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করছেন, সরকারের পক্ষ থেকে যেভাবে চাপ দেয়া হচ্ছে, তাতে এ শিল্পের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
উল্লেখ্য, উচ্চ আদালতের নির্দেশে পরিবেশ দূষণের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সরকার ২০০৯ সালে হাজারীবাগের চামড়া শিল্প স্থানান্তরের উদ্যোগ নেয়। এক হাজার ৭৮ কোটি টাকা ব্যয়ে সাভারে চামড়া শিল্প নগরী স্থাপন করেছে সরকার। ক্ষতিপূরণ হিসেবে ২৫০ কোটি টাকা অর্থিক সহযোগিতাও সরকারের পক্ষ থেকে করা হয়েছে।
এদিকে চামড়া শিল্পকে পরিবেশবান্ধব করতে প্রয়োজনীয় কমপ্লায়েন্স নিশ্চিতে ইউরোপীয় ক্রেতাদের দিক থেকেও ওই এলাকায় ট্যানারি কারখানাগুলো স্থানান্তরের চাপ রয়েছে। এমনকি পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত শিল্পের শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে রফতানি নিষেধাজ্ঞারও আশঙ্কা রয়েছে। তাই ট্যানারী স্থানান্তর জরুরি বলে মনে করছে সরকার। এ কারণেই দফায় দফায় হাজারীবাগ থেকে ট্যানারীর কাযক্রম বন্ধ করার জন্য আল্টিমেটাম দিচ্ছে সরকার। শেষ চেষ্টা হিসেবে গত ২৯শে ফেব্রুয়ারি শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু ট্যানারি স্থানান্তরে ৩১শে মার্চ পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিলেন মালিকদের। এপ্রিলের প্রথম দিন থেকে ঢাকার হাজারীবাগে কাঁচা চামড়া প্রবেশ করতে দেয়া হবে না বলেও জানিয়েছিলেন তিনি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন