দুই বাসের চাপাচাপিতে তিতুমীর কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাজিব হোসেনের ডান হাত হারানোর মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর আবারও দুই বাসের চাপাচাপির মধ্যে পড়ে গুরুতর আহত হয়েছেন আয়েশা খাতুন নামে এক গৃহবধূ। তার মেরুদন্ডসহ কোমরের হাড় ভেঙ্গে গেছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আয়েশা চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করতে যাচ্ছেন। সোজা হয়ে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। গত বৃহস্পতিবার ঢাকার নিউ মার্কেট সংলগ্ন চন্দ্রিমা মার্কেটের সামনে আয়েশা খাতুন এই মর্মন্তুদ ঘটনার শিকার হন। সকাল সাড়ে সাতটার দিকে রিকশায় করে ৬ বছরের মেয়ে অহনাকে ধানমন্ডির একটি স্কুলে নিয়ে যাওয়ার সময় বিকাশ পরিবহনের দুইটি বাস প্রতিযোগিতা করে এক অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার জন্য চাপাচাপিতে লিপ্ত হয়। বাস দুইটির মাঝে আয়েশা খাতুন ও অহনাকে বহন করা রিকশাটি পড়ে যায়। এতে আয়েশা খাতুন চিৎকার করে বাঁচানোর কথা বললেও বেপরোয়া চালকরা তা শোনেনি। তারা চাপাচাপি করেই সামনে এগিয়ে যায়। আয়েশা খাতুন মেয়ে অহনাকে বাঁচাতে নিজেই চাপাচাপির মধ্যে নিজেকে সঁপে দেন। হাসপাতারের বেডে শুয়ে নিজের পঙ্গুত্বের কথা জানলেও সান্ত¦না খুঁজে নিয়েছেন, মেয়েটিকে তো রক্ষা করা গেল। গত শুক্রবারও হৃদয় বিদীর্ণ করা আরেকটি ঘটনা ঘটে ময়মনিসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে। ছেলের চোখের সামনে বাসের চাকার নিচে পিষ্ট হয়েছেন মা। বাসের চাকার নিচে আটকে পড়া মাকে বাঁচাতে বাস ঠেলছে ছেলে-এমন চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। রাজধানীসহ সারাদেশেই বেপরোয়া চালকদের তান্ডবে প্রতিদিন কত প্রাণ যে ঝরছে, তার সঠিক হিসাব পাওয়া মুশকিল। কেবল যেসব খবর পত্র-পত্রিকায় আসে, তাই রেকর্ড হয়ে থাকে। বেপরোয়া এই চালকদের নিয়ন্ত্রণে যেন কেউই নেই।
এ বছর প্রথম তিন মাসে রাজধানীসহ সড়ক-মহাসড়কে যে হারে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ আহত-নিহত হয়েছে, তার চিত্রটি উদ্বেগজনক। প্রতিদিন গড়ে প্রায় পাঁচ জন বা তারও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে অসংখ্য। বলা বাহুল্য, এসব দুর্ঘটনার মূল কারণই হচ্ছে চালকদের বেপরোয়া আচরণ। সড়ক-মহাসড়কগুলো যেন তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। রাজধানীতে সাম্প্রতিক যে দুটি দুর্ঘটনা ঘটেছে, তা চালকদের বেপরোয়া আচরণের কারণেই ঘটেছে। চালকরা একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে সড়কের কোনো নিয়ম-কানুনই মানে না। কে কার আগে যাত্রী তুলবে এবং গন্তব্যে পৌঁছবে, এমন এক অশুভ প্রতিযোগিতা বছরের পর বছর ধরেই চলছে। এতে যাত্রীরা যেমন অসহায় হয়ে পড়েছে, তেমনি রাস্তায় চলাচলকারি মানুষজনও নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে। মর্মান্তিক দুইটি ঘটনায় বিষয়টি সবার সামনে উঠে এসেছে। এ নিয়ে কিছুদিন হয়তো লেখালেখি ও আলোচনা হবে, তারপর তা চাপা পড়ে যাবে। চালকরা বেপরোয়াই রয়ে যাবে এবং মানুষও দুর্ঘটনার শিকার হবে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, চালকরা রাস্তার কোনো নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করলেও দায়িত্বপ্রাপ্ত ট্র্যাফিক পুলিশকে এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। সড়কের আইনের প্রতি চালকরা যেমন বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রদর্শন করে চলেছে, তেমনি আইন প্রয়োগে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশও শৈথিল্য দেখাচ্ছে। এতে সড়কে গাড়ি চলাচলে নিয়ম-কানুনের কোনো বালাই দেখা যায় না। চালকদের বেপরোয়া মনোভাব তো রয়েছেই, সড়ক ব্যবহার এবং পারাপারে মানুষের মধ্যেও কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলা নেই। যে যেভাবে পরে রাস্তা পার হয়। অত্যন্ত ব্যস্ত সড়ক ও মোড়ের মাঝ দিয়ে পথচারীরা অবলীলায় চলাচল করে। পাশে ফুট ওভার ব্রিজ বা আন্ডার পাস থাকলেও তা ব্যবহার করে না। কয়েক বছর আগে ওভার ব্রিজ ও নির্দিষ্ট জায়গা দিয়ে পথচারিদের পার হতে বাধ্য করার জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালতও বসানো হয়। অনেককে জরিমানা করা হয়। তাতে পথচারীদের অসচেতনতায় কোনো প্রভাব পড়েনি। কোনো কোনো ফুট ওভার ব্রিজে ফুলের টব ও প্রাকৃতিক পরিবেশ সৃষ্টি এমনকি চলন্ত সিঁড়ি লাগিয়েও পথচারীদের আকৃষ্ট করা যায়নি। পথচারীদের অসচেতনতার কারণে শুধু সড়ক পথেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটছে না, রাজধানীর ওপর দিয়ে যাওয়া রেল লাইনেও দুর্ঘটনা ঘটছে। অনেক অসচেতন পথচারী কানে ইয়ার ফোন লাগিয়ে বা মোবাইলে কথা বলতে বলতে রেল লাইনের উপর দিয়ে চলতে গিয়ে ট্রেনের নিচে পড়ে নিহত হয়েছে। গত শুক্রবার নরসিংদীতে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে একক মটর সাইকেলে চারজন নিয়ে চলার সময় বিপরীত দিক থেকে আসা বাসের ধাক্কায় চারজনই নিহত হয়েছে। হেলমেট না পরা, এক মটর সাইকেলে চারজন আরোহনের মতো অনিয়মে এবং বাস চালকের বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণেই চারটি প্রাণ ঝরে গেছে। এসব মর্মান্তিক দুর্ঘটনার নজির সামনে থাকা সত্তে¡ও সড়কে চালক এবং পথচারীদের মধ্যে কোনো ধরনের সচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে না। চালকরা বেপরোয়া গতিতেই চলছে এবং যাত্রী ও পথচারীদের মধ্যেও উদাসীনতা কাজ করছে।
সড়ক-মহাসড়কে নিয়ম-কানুন না মানা, গাড়ি চালকদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা এবং জনসচেতনতার অভাবে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। নগরবিদ এবং সড়ক বিশেষজ্ঞরা দুর্ঘটনার হার কমিয়ে আনার জন্য বিভিন্ন পরামর্শ দিলেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং পরিবহন সংশ্লিষ্টরা তা কানে তুলছে না। সরকারের তরফ থেকে অনেক উন্নতির কথা বলা হলেও সড়ক-মহাসড়কের আইন-কানুনের কোনো উন্নতিই দৃশ্যমান নয়। বরং বেপরোয়া গাড়ি চালকদের কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে তাদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের মতো কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থার আইন করতে চাইলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বাধার মুখোমুখি হতে হয়েছে। পরবর্তীতে অপর্যাপ্ত শাস্তির বিধান করে আইন তৈরি করা হয়। এর মাধ্যমে বেপরোয়া চালকদের যেন অনেকটা দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। ফলে চালকদের মনে এমন একটা মনোভাব বিরাজ করছে, তাদের বেপরোয়া চালনার কারণে দুর্ঘটনায় মানুষ আহত-নিহত হলেও কিছুই হবে না। অথচ উন্নত বিশ্বে গাড়ি পার্কিংয়ে সামান্য ত্রুটি কিংবা সড়কের লেন পরিবর্তন ও সিগন্যাল অমান্য করলে জেল, জরিমানা এমনকি সারা জীবনের জন্য ড্রাইভিং লাইসেন্স পর্যন্ত বাতিল করা হয়। আমাদের দেশে দুর্ঘটনা ঘটানোর মতো আচরণ এবং দুর্ঘটনা ঘটিয়ে মানুষের প্রাণ কেড়ে নিলেও চালকের কিছু হয় না। এভাবে যদি চলতে থাকে, তবে রাজধানীসহ দেশের সড়ক-মহাসড়কের মৃত্যুর মিছিল কোনো দিনই থামবে না। এভাবে মৃত্যুর মিছিল নিয়ে কী উন্নতি করা যায়? পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে যে ক্ষতি হয় তা জিডিপির প্রায় দুই শতাংশ। এত বড় ক্ষতি নিয়ে উন্নয়নের চাকা সচল রাখা কঠিন। সরকারকে এ দিকে যথাযথ মনোযোগ দেয়া উচিত। সড়ক-মহাসড়কে শৃঙ্খলা ও নিয়ম-কানুন প্রয়োগে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। গাড়ি চালক এবং জনসাধারণকেও সচেতন হয়ে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন