শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

রূপগঞ্জের জামদানি শিল্প লোকসানের মুখে

পহেলা বৈশাখে ভারতীয় শাড়ি

মো : খলিল সিকদার, রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) থেকে | প্রকাশের সময় : ৯ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

কিছুদিন পরই পহেলা বৈশাখ। পহেলা বৈশাখ মানেই বাহারী রঙের পোষাক। পহেলা বৈশাখে ছেলে বুড়ো থেকে শুরু করে সবাই বাঙালি পোষাকে নিজেকে সাজিয়ে নেয়। পহেলা বৈশাখের দিন পিছিয়ে থাকে না নারীরাও; রং-বেরঙের শাড়ি পড়ে বেরিয়ে পরে বাড়ি থেকে। এ যেন অন্যরকম অনুভূতি। আর পহেলা বৈশাখ কে সামনে রেখে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার নোয়াপাড়া জামদানি পল্লীতে যেখানে ক্রেতার উপচে পড়া ভীড় থাকার কথা সেখানে সকালে গড়িয়ে দুপুর হয়ে যাওয়ার পরও কোন ক্রেতার দেখা নেই। পার্শ¦বতী দেশ ভারত থেকে নতুন নতুন ডিজাইনের শাড়ি আমদানি হওয়ার কারণে তাদের জামদানি শাড়ি কম বিক্রি হচ্ছে বলে ধারণা করছে এখানকার জামদানি ব্যবসায়ীরা। দুঃখ ভারাক্রান্ত কণ্ঠে শিউলী জামদানি শাড়ি হাউজের মালিক রমজান আলী জানান, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বসে আছি এখন পর্যন্ত কোনো শাড়ি বিক্রি করতে পারি নি। গতকাল রোববার দুপুরে তারাব পৌরসভার নোয়াপাড়া জামদানি পল্লীর জামদানি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য বেরিয়ে আসে। ভাই ভাই জামদানি হাউজের মালিক রমজান হোসেন জানান, পহেলা বৈশাখ কে সামনে রেখে তাঁতিরা বাহারি রঙের জামদানি তৈরী করে রেখেছেন। এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ফুলতেরছি, ছিটার তেরছি, ছিটার জাল, সুই জাল, হাটু ভাঙ্গা, তেরছি, ডালম তেরছি, পাটির জাল, পান তেরছি, গোলাপ ফুল, জুই ফুল, পোনা ফুল, শাপলা ফুল, গুটি ফুল, মদন পাইর, খান্ডা, ঢেউ, প্ল্যাইন, বেলপাতাসহসহ প্রায় শতাধিক নামের জামদানি রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ছিটার জাল, সুই জাল ও পাট্রির জাল জামদানির মূল্য সবচেয়ে বেশি। তবে এবারের পহেলা বৈশাখে জামদানি শাড়ি বিক্রির পরিমান খুবই কম। এর মূল কারণ হচ্ছে, জামাদানি শাড়ির তুলনায় ভারতীয় শাড়ির মূল্য অনেক কম। জামদানি শাড়ি কিনতে হলে ক্রেতাদের গুনতে হয় ১০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত। আর এ সকল শাড়ি বুনতে সময় লাগে প্রায় এক সপ্তাহ থেকে শুরু করে ১ মাস পর্যন্ত। সিল্ক জামদানি হাউজের মালিক হৃদয় মিয়া, নোয়াপাড়া জামদানি শাড়ি হাউজের মালিক কবির হোসেনসহ আরো অনেকেই জানান, পহেলা বৈশাখ সামনে রেখে বিভিন্ন নকশা দিয়ে পর্যাপ্ত শাড়ি তৈরী করে রাখলেও ক্রেতার সংখ্যা তুলনামূলক অনেক কম। এছাড়া গত কয়েকদিন ধরে জামদানি শাড়ি বিক্রির সংখ্যা আরো কমেছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। নোয়াপাড়া জামদানি পল্লীর বেশীর ভাগ মানুষই জামদানি তৈরী করে তাদের সংসার চালায়। এবারের পহেলা বৈশাখে পর্যাপ্ত শাড়ি বিক্রি করতে না পারলে তাদের সংসার চালানো কষ্টসাধ্য হয়ে পরবে।
জামদানি শাড়ির সঙ্গে বাঙালির ঐতিহ্য জড়িত। প্রাচীনকালের মিহি মসলিনের কাপড়ের উত্তরাধিকারী হিসেবে জামদানি শাড়ি বাঙ্গালি নারীদের জন্য অতিপরিচিত একটি নাম। মসলিনের উপর নকশা করে জামদানি শাড়ি তৈরী করা হয়। ১৭’শ শতাব্দীতে জামদানি দিয়ে রাজাদের শেরওয়ানী নকশা করা হতে বানানো হতো। বর্তমানে দেশের মার্কেটগুলোতে বাহারি রঙের দেশী, বিদেশী হরেক রকমের কাপড়ের সমাহার লক্ষ্য করা যায়। এ সকল কাপড় জামদানি শাড়ির তুলনায় দাম কম হওয়ায় ক্রেতাদের প্রথম পছন্দ। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে জামদানি শিল্পটি। মা জামদানি হাউজের মালিক মুমিন জানান, তিনি প্রত্যেক মাসে ৮০ হাজার টাকার জামদানি শাড়ি বিক্রি করে থাকেন। জামদানি শাড়ির পাশাপাশি তিনি ওড়না, পাঞ্জাবীসহ হরেক রকমের কাপড় বানিয়ে থাকে। প্রতিবারের মতো এবারও তিনি কারখানাতে বিভিন্ন ধরনের শাড়ি তৈরী করে রেখেছে। কিন্ত পর্যাপ্ত ক্রেতা না থাকার কারণে ব্যবসায়ীদেরকে লোকসান গুনতে হচ্ছে। শাড়ি বিক্রি করতে না পারলে তাঁতিদের মজুরি দিতে পারবে না। এ ব্যবসায়ী আরো জানান, পরিশ্রমের তুলনায় পারিশ্রমিক কম হওয়ার কারণে অনেকেই এ পেশা থেকে সরে যাচ্ছেন। শাড়ি তৈরীর উপকরণ কিনে খুব বেশী লাভ থাকে না। জামদানি শাড়ি উৎপাদন করে তাঁতিদের লাভ না হলেও মুনাফা যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসে পাইকাররা নোয়াপাড়া এলাকা থেকে জামদানি শাড়ি কিনে নিয়ে যায়। সারা সপ্তাহ পরিশ্রম করে শাড়ি বিক্রি করে তাদের লাভ হয় প্রতি শাড়িতে ১-২ হাজার টাকা। অপরদিকে পাইকাররা এসকল শাড়ি কিনে নিয়ে গিয়ে লাভ করে ৫-৭ হাজার টাকা পর্যন্ত। জামদানি ব্যবসায়ী শিউলি ও আমেনা জানান, পহেলা বৈশাখ সামনে রেখে জামদানির বিক্রির পরিমান তুলনামূলক অনেক কম। একটি জামদানি করতে এক সপ্তাহের বেশী সময় লেগে যায়। প্রত্যেক সপ্তাহে কারিগরদের বেতন দেওয়া হয় ২ হাজার টাকা। তাদেরকে পরিশ্রমের তুলনায় পারিশ্রমিক অনেক কম দেওয়া হয়। এ কারণে অনেকেই জামাদানি তৈরীর কাজ ছেড়ে দিয়ে বিভিন্ন ধরনের শিল্প কারখানায় কাজ করছে। এ ভাবে চলতে থাকলে এক সময় জামদানি শিল্প বিলুপ্ত হয়ে পরবে। আল-আমিন নামে এক ক্রেতা বলেন, মায়ের জন্য জামদানি শাড়ি কিনতে এসেছি। জামদানি বাঙালির ঐতিহ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমাদের সবার উচিত বিদেশী কাপড় প্রত্যাখ্যান করে দেশীয় কাপড় ব্যবহার করা। গ্রেজেটপ্রাপ্ত সমাজ সেবক ও মারুফ-শারমিন স্মৃতি সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আলহাজ লায়ন মোজাম্মেল হক ভুঁইয়া বলেন, আমাদের জামদানির ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে হলে বিদেশী শাড়ি বর্জন করতে হবে। আর এ জামদানি নিজেরা ব্যবহার করে অন্যদের ব্যবহারেও উৎসাহিত করতে হবে। হাসি ফুটে উঠবে তাঁতী ও ব্যবসায়ীদের মুখে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন