মুহিউসসুন্নাহ আল্লামা মাহমূদুল হাসান
॥ এক ॥
(২৫ মার্চ ২০১৬ প্রদত্ত বয়ান)
সূরা মায়েদার ৩নং আয়াত একটি প্রসিদ্ধ আয়াত। আর বুখারী শরীফ থেকে উদ্ধৃত হাদিস দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের একটি আদেশ করছেন। বলেছেন, তোমার ভাইকে সাহায্য কর। যখন সে জালেম তখন আর যখন সে মজলুম তখনও। সাহাবীগণ বললেন, জালেমকে কীভাবে সাহায্য করব ইয়া রাসূলুল্লাহ? জবাবে রাসূল (সা.) বললেন, তাকে জুলুম করা থেকে ফিরাবে। এটাই তাকে সাহায্য করা। এটি নিছক আদেশই নয়, একটি নসিহত ও পরামর্শও বটে। রাসূলের প্রতিটি কথাই তো আমাদের জন্য একেকটি নসিহত ও জীবন পরিচালনার পাথেয়। তাঁর চেয়ে বড় পরামর্শদাতা কে আছে?
তাঁর চরিত্রমাধুরী আকাশচুম্বী। আসমানের নিচে জমিনের উপরে তাঁর চেয়ে উত্তম চরিত্রবৈশিষ্ট্য দ্বিতীয় কারোর নেই। তিনি স্বাতন্ত্র্য। তাঁর তুলনা তিনিই। তিনি মানবজাতির একনিষ্ঠ কল্যাণকামী, শুভাকাক্সক্ষী ও সঠিক পথের দিশারী। এমন মানব পৃথিবীর ইতিহাসে না আছে, না আর আসবে। তিনি শ্রেষ্ঠ নবী। আরবিতে যাকে বলে উম্মুল আম্বিয়াÑ নবীগণের সরদার।
তাঁর পরামর্শ শুধু মুসলমানদের যাপিত জীবনের শুভবার্তা নয়। তিনি সকলের নবী। মানব-দানব, জ্বীন-পরী, চাঁদ-সুরুজ ও আকাশে উড়তে থাকা মুক্তবিহঙ্গেরও নবী তিনি। তিনি কুল কায়েনাতের শ্রেষ্ঠ নবী। তাঁর শুভবার্তা সকলের জন্য আদর্শ। একবার তিনি মহান আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করেছিলেন, হে আল্লাহ বৃষ্টি দাও। পানির অভাবে সাপ-বিচ্ছু, প্রাণিকুল, তরুলতা সংকটে যাচ্ছে। জমিন ফেটে চৌচির হচ্ছে। আকাশ থেকে রহমতের বারি ঝরাও হে মহান। তোমার রহমতে সিক্ত হোক সমস্ত সৃষ্টি। এ ছিল কুল মাখলুকের জন্য নবীয়ে রহমতের আকুল প্রার্থনা। তিনি সকলের নবী। রাহমাতুল্লিল আলামীনÑ সমগ্র পৃথিবীর দয়া তিনি। তাঁর জীবনচরিতে না আছে জুলুম, না রয়েছে স্বার্থপরতা। না আছে রাগ, না প্রতিশোধপ্রবণতা। শুধু কল্যাণের বার্তা নিয়ে এসেছিলেন তিনি। এই কল্যাণবার্তা যারা গ্রাহ্য করেনি, সেই কাফেরদের জন্যও তাঁর হৃদয় ছিল উর্বর। যেখানে তাঁর মুখ ফিরিয়ে নেয়ার কথা, সেখানেও তিনি ধৈর্যের প্রাচীর হয়েছিলেন। যারা তাঁর দাঁত ভেঙে দিয়েছিল, তাঁর জন্যও তিনি সেজদায় পড়ে কাঁদেন। এতই দরদী সে নবী।
এগুলো করার পেছনে তাঁর বিশাল আশা ছিল। তিনি জানেন, তার রেখে যাওয়া কোনো ইতিহাস মানুষের অজানা থাকবে না। তবুও তিনি নির্দেশ করেছেন, সামান্য কিছু জানা থাকলে সেটাও পৌঁছে দাও। জীবনের ফিরিস্তি কতটা নিখুঁত হলে এমন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া যায়Ñ তা বিবেচ্য রইল।
তাঁর কর্মময় বর্ণাঢ্য জীবন সকলের জন্য আদর্শ। বিশেষ করে মুসলমান জাতির জন্য। সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হলে দরদী হওয়ার বালাই নেই। এজন্য মানুষ মানুষের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হতে হয়। ক্ষমাশীল, হিতাকাক্সক্ষী ও অনন্য চরিত্রের অধিকারী হতে হয়। একথা বুঝানোর জন্যই রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাফেরদের জন্যও দোয়া করেছেন।
কিন্তু আমরা মুসলমান হয়ে মুসলমানদের জন্য বদদোয়া করি। মাঝেমধ্যে একে অপরের জীবন বিপন্ন করে তুলতে তাবীজের ব্যবহার করি। এ কেমন তাবীজের অপব্যবহার! যেখানে কলহ-বিবাদ দূরীকরণে তাবীজ ব্যবহার করবে, সেখানে করছে এর বিপরীত। মনে রাখা দরকার, ঝগড়া-বিবাদ ও অন্যকে বিপদগ্রস্ত করতে তাবীজ করা ইসলাম সম্পূর্ণভাবে হারাম ঘোষণা করেছে।
যদি একে অপরের সাথে ঝগড়া হয় বা স্বামী-স্ত্রীর মনোমালিন্য হয়, তাহলে তাদেরকে মিলিয়ে দেয়া ভালো কাজ। এক্ষেত্রে তাবীজ ব্যবহার খারাপ নয়। কারণÑ মীমাংসা করা ভালো। কিন্তু তাবীজ দিয়ে অন্যের ক্ষতিসাধন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চাইলে পারতেন, যারা তাঁর দাঁত ভেঙে দিয়েছিল তাদের মূলোৎপাটন করতে। কিন্তু তিনি তা করেননি। এর দ্বারা তিনি উম্মতকে বুঝানোর প্রয়াস চালিয়েছেন, হে মুসলমান, দেখে নাও কিভাবে সমাজে থাকতে হয়? কি করে ভ্রাতৃত্ববন্ধন জুড়ে রাখতে হয়Ñ এ পরামর্শটুকু নাও। তিনি পরামর্শ দিচ্ছেন, তোমার ভাইকে সাহায্য করবে। হোক সে জালেম বা মাজলুম।’
এ পরামর্শ মেনে নিলে মানুষকে আর উচ্ছৃঙ্খল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় না। কারণ এ হাদিসে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলছেন, হে দুনিয়ার অধিবাসী, তোমরা একে অপরকে ভাই মনে করবে, আপনভাই মনে করবে। আর ভাইয়ের সাহায্যের নিমিত্তে তোমাদের অন্তর উর্বর রাখবে। এ হাদিসটি রাসূল শুধু মুসলমানদের সম্বোধন করে বলেননি। দুনিয়ার সকল মানুষের প্রতি তাঁর এই নির্দেশ কেয়ামত পর্যন্ত বহাল থাকবে।
মানুষের স্বভাবের দাবি হলো, তারা আপন ভাইকে কষ্টে নিপতিত হতে দেয় না। বাঁচাতে চায় কষ্ট থেকে। একটি উদাহরণ দেয়া যাক, কারোর পাগল ভাই আগুনে পড়ে যাচ্ছে, তখন কোনো স্বাভাবিক মস্তিষ্কের ভাই তাকে দেখে বসে থাকতে পারবে? পারবে না। তার স্বভাবের চাহিদায় সে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করবে। অথবা কোনো পুলিশ কারোর ভাইকে গ্রেফতার করতে আসে, তখন আরেক ভাই কি তাকে পুলিশে ধরিয়ে দিবে, নাকি কাটানোর চেষ্টা করবে? স্বভাবের দাবি হলো, কাটিয়ে দেয়া। ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের সৌহার্দ্যতা এমনই।
পক্ষান্তরে কোনো ভাই যদি তার ভাইকে আগুনে পড়তে দেখে বাঁচানোর চেষ্টা না করে কিংবা বসে থেকে ভাইয়ের আগুনে কাবাব হওয়ার দৃশ্য দেখে তখন লোকেরা তাকে বাহবা দিবে, নাকি ধিক্কার দিবে? নিশ্চয়ই কেউ বাহবা দিবে না। সবাই তাকে ধিক্কার দিবে, পাষ- হৃদয় বলে ভর্ৎসনা করবে। আবার অনেকে মানসিক বিকারগ্রস্তও বলবেÑ এটাই মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য।
উক্ত হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমনটিই বলতে চাইছেনÑ তোমরা একে অপরের আপন ভাই বনে যাও। চাই মুসলিম হোক কিংবা অমুসলিম! অমুসলিমরাও আমার উম্মত। তাদের সাথে বৈরী আচরণের কারণে কোনো ধরনের উচ্ছৃঙ্খলতা হলে এর প্রভাব মুসলমানদের মধ্যে বিস্তৃত হতে পারে। অমুসলিম প্রতিবেশীর বাড়িতে আগুন লাগলে আপনার বাড়িতেও আগুন লাগার আশংকা আছেÑ এটাই বাস্তবতা। তাই সম্প্রীতির জন্য মুসলিম-অমুসলিম সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকা চাই।
আমাদের দেশে সব ধর্মের লোক আছে। তারা যেন বুঝে, মুসলমানদের স্বভাববৈশিষ্ট্য কতটা মধুর। তারা নিরাপদ থাকবে যেমনটি শিশু তাদের মায়ের কোলে নিরাপদ থাকে। কোনো নির্যাতন-নিপীড়ন থাকবে না। যা থাকবে এর নাম সম্প্রীতি-দরদ। মুসলমানের এই আচরণ দেখে তারা আকৃষ্ট হবে। এটি ইসলামের দাওয়াত ও তাবলিগের অনন্য পন্থা। মৌখিক দাওয়াতের চেয়ে সবসময় চারিত্রিক দাওয়াত বেশি কার্যকরী। সম্প্রীতি, ক্ষমা-উদারতা এবং ভক্তি-শ্রদ্ধার মাধ্যমে মানুষের মন যত সহজে জয় করা যায়, যুক্তি ও চাপ সৃষ্টি করে তার ধারেকাছেও যাওয়া সম্ভব হয় না।
চাপের কারণে বা বন্ধুকের নলের সম্মুখে হয়ত কেউ বাহ্যিকভাবে নতশীর হতে পারে কিন্তু অন্তরে অন্তরে তিনি বিষিয়ে উঠবে, আন্তরিকভাবে পরবিরোধিতা আরও প্রকট হবে। যতদিন ‘পাওয়ার’ আছে, হয়ত আপনার মাথা নত হবে না। কিন্তু একদিন পাওয়ারের খেলা চুকে যাবে। তারপর আপনাকেও ভূগর্ভে যেতে হবে। এ কারণে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে আয়ত্তে আনার অবিকল্প পন্থা হলো দয়া-মায়া, দরদ-মহব্বত ও সুকৌশলী হওয়া। এক্ষেত্রে সবার মাঝেই নিবেদিতপ্রাণ মানসিকতা ও পরস্পর ঐক্য থাকারও বিকল্প নেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন