শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

লুম্পেনতন্ত্রের বিস্তার

মাহমুদুল হাসান রাজা | প্রকাশের সময় : ১৯ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

প্রথমে আমরা ‘লুম্পেন বুর্জোয়া’ শব্দ দুটির আক্ষরিক অর্থের প্রতি লক্ষ করব। লুম্পেন বুর্জোয়া দুই ভাষার শব্দ। লুম্পেন শব্দটি জামার্ন। বুর্জোয়া শব্দটি ফারসি। লুম্পেন বুর্জোয়া পুঁজিবাদের অভ্যুদয়েরকালে ব্যবহৃত হয় তৎকালীন মধ্যবিত্ত এবং পরে ধনিক শ্রেণি বোঝাতে। এ শব্দটি ১৯২৬ সালে অস্ট্রিয়ার একজন লেখক প্রথম ব্যবহার করেন। ইংরেজি ভাষায় এ শব্দ দুটি প্রথম ব্যবহার করেন মার্কিন অর্থনীতিবিদ পল ব্যারেন ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত, ‘পলিটিক্যাল ইকোনমি অব গ্রোথ’ গ্রন্থে। পরে এই শব্দবন্ধ বিশেষ পরিচিতি পায় জার্মান-মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী আন্দ্রে গুন্ডার ফ্রাংকের (১৯৭২) ‘লুম্পেন বুর্জোয়াজি অ্যান্ড লুম্পেন ডেভেলপমেন্ট: ডিপেন্ডেন্সি, ক্লাস অ্যান্ড পলিটিকস ইন ল্যাটিন আমেরিকা’ গ্রন্থের মাধ্যমে। লুম্পেন বুর্জোয়ার বাস্তব সংজ্ঞা দিয়েছেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেছেন, ‘যারা নিজেদের বিত্ত অর্জনের জন্য উৎপাদনশীল পথের চেয়ে দ্রæত মুনাফা অর্জনে অন্যান্য সহজ ও চোরাই পথ গ্রহণে বেশি আগ্রহী থাকে।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘লুম্পেন শ্রেণির সকল অংশের একটি বৈশিষ্ট্য অভিন্ন, এই দেশের সম্পদ আত্মসাৎ করে অন্য দেশে ভবিষ্যৎ তৈরি।’ যুক্তরাষ্টের ইলিয়ন স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, ‘লুম্পেন বুর্জোয়া শ্রেণির বিকাশ এবং শক্তি সঞ্চয়ের ফলে রাজনীতিতে তার অবশ্যম্ভাবী প্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় এটাই হচ্ছে অন্যতম কারণ।’ আনু মুহাম্মদ আরো বলেছেন, ‘গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, স্বাধীন গণমাধ্যম, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা। রাষ্ট্রীয় প্রকল্প ও অর্থ বরাদ্দে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, স্বাধীন নিবার্চন ব্যবস্থা, স্বাধীন বিদ্যাচর্চা- সংস্কৃতিচর্চা এদের কাক্সিক্ষত নয়।’
বাংলাদেশের সব জায়গায় এই লুম্পেনতন্ত্রের সয়লাভ চলছে শাসকগোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ পরোক্ষ মদদে। রাজনৈতিক অর্থনীতির এই বাস্তবতার লুম্পেনদের দামামার কারণে দেশে একটি অগণতান্ত্রিক ভোটারবিহীন সরকার জনগণের উপরে চেপে বসেছে। লুম্পেনতন্ত্রের ফলেই সৃষ্টি হয়েছে নির্বাচনের আগেই জয় পাওয়ার অন্যায় আকাক্সক্ষা। গণতন্ত্রের বারোটা বাজিয়ে এই তন্ত্রীদের উত্থান আমাদের জাতি-রাষ্ট্রের জন্য অশনি সংকেত। এই তন্ত্রীরা গণতন্ত্রের ন্যূনতম মূল্যেবোধ পর্যন্ত ও স্বীকার করতে চায় না। বিরোধী দল দমনে এমন কোন কাজ নেই যা তারা করে না।
লুম্পেনতন্ত্রীরা স্বাধীন বিচারব্যবস্থার ঘোর বিরোধী। নিজেদের স্বার্থে রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতির মতো সম্মানিত আলংকারিক পদকেও হেনস্থা করতে দ্বিধাবোধ করে না। প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি দুর্নীতি করেছেন। আবার সেই প্রধান বিচারপতি যখন নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন, তখন সেই দুর্নীতির অভিযোগ আর পাত্তা পায় না। লুম্পেনরা পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রের বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করার মানসিকতায় বিভোর। এ বিষয়ে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেছেন, ‘খালেদা জিয়ার জামিন স্থগিত হওয়ায় মনে হচ্ছে সরকার বিচার বিভাগ কবজায় নেওয়ার চেষ্টা করেছে।’
লুম্পেনতন্ত্রীরা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের উপর কর্তৃত্ব করতে চায়। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান যেমন দুর্নীতি দমন কমিশন ও নির্বাচন কমিশন। তারা বিরোধীদের দমনে দুদকের ব্যবহার করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। অথচ তাদের পাহাড় সমান দুর্নীতি দুদক নখদন্তহীন বাঘের মত প্রত্যেক্ষ করে। তেমনি একটি দৃষ্টান্ত: সম্প্রতি দুদক বিএনপির আট শীর্ষ নেতার নামে তদন্ত করছে ১২৫ কোটি টাকা লেনদেনের জন্য। অবশ্য বিএনপির নেতারা বলেছেন, ‘যেসব ব্যাংকের নাম এসেছে সেই সব ব্যাংকে আমাদের অ্যাকাউন্টই নেই।’ চমৎকার! লজ্জা হয় না দুদকের! লুম্পেনদের প্রভাবে দুদক আইনের বাইরে গিয়েও কার্যক্রম পরিচালনা করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। এরকম আর একটি দৃষ্টান্ত হলো বেগম খালেদা জিয়ার সাজার মেয়াদ বৃদ্ধির আবেদন। দুদকের আইনে সাজার মেয়াদ বৃদ্ধির আবেদন দুদকের এখতিয়ারে নেই। সেই দুদক যখন শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি, হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক, বিসমিল্লাহ গ্রæপ, ডেসটিনি, বাংলাদেশে ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মতো ঘটনা দেখে চুপ করে বসে থাকে তখন লুম্পেনরা সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। যখন সরকারের অনেকে নিয়োগ বাণিজ্য করে রাষ্ট্রের প্রশাসন ব্যবস্থা দুর্বল করার মানসিকতায় বিভোর তখন দুদককে আঙ্গুল চুষতে দেখা যায়। কারণ তারা সরকারি দলের লোক। তাদের উপড়ে দুদকের কর্তৃত্ব করার সাহস নেই। দুদকের কাজ শুধু সরকারি দলের লোকদের দায়মুক্তি দেয়া এবং বিরোধীরা যাতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারে সে জন্য আপ্রাণ চেষ্ট করা। লুম্পেনরা নিজেদের স্বার্থে রাষ্ট্রীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দুর্যোগের ঘনঘটা বাজিয়ে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। সাম্প্রতিক সময়ে ফারমার্স ব্যাংকের কেলেঙ্কারির ঘটনা, ঋণ বিতরণে অনিয়ম, জালিয়াতি ও লুটপাট অতীতের যে কোন ব্যাংক কেলেঙ্কারি অনিয়মকে ছাড়িয়ে গেছে। এর হোতা কারা সবারই জানা। দুদক মনে হয় জানে না! জানা থাকলে তো ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। রাষ্ট্রীয় ব্যাংক জনতা ব্যাংক ছয় বছরে এক গ্রাহককে দিয়েছে ৫ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা ঋণ ও ঋণ সুবিধা। নিয়মনীতি না মেনে এভাবে ঋণ দেওয়ায় ব্যাংক বিপাকে পড়েছে। এক গ্রাহক ৭৫০ কোটি টাকার বেশি ঋণ পেতে পারে না। দেওয়া হয়েছে মোট মূলধনের প্রায় দ্বিগুণ। ফারমার্স ব্যাংক আর জনতা ব্যাংকের হিসাব যুক্ত করলে আত্মসাতের পরিমাপ ৪০ হাজার কোটি হবে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের কথায় আমাদের জানা হয়ে গেছে, গত ১০ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে সরকার ১০ হাজারে ২৭২ কোটি টাকার পুনর্মূলধনীকরণ সুবিধা দিয়েছে। এই তথ্য ফেব্রæয়ারিতে সংসদে দেওয়া। বণিক বার্তার এক রিপোর্ট মোতাবেক, রাষ্ট্রীয় ও ব্যাংকগুলোকে সরকার ২০০৯-১০ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত আট বছরে ১৪ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা দিয়েছে। একদিকে সরকার ব্যাংককে আর্থিক সুবিধা দিচ্ছে অন্যদিকে শাসকগোষ্ঠীর অনুসারীরা ব্যাংক থেকে অর্থ লুটপাট করে নিয়ে নিজেদেরকে লুম্পেন সমাজের প্রতিভূ হিসেবে পরিচিত করছে।
লুম্পেনরা বৈষম্যহীনভাবে রাষ্ট্রের সব নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করতে অপারগতা প্রকাশ করে। যে বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত, গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য মহান মুুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, সেই বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত, গণতান্ত্রিক সমাজ লুম্পেনদের কারণে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক আবুল মোমেন বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সুবিধা আদায়- তা নাতির ভর্তি, ছেলের চাকরি বা দলের ভোট যাই হোক না কেন, তাতে এই চেতনার ক্ষয় ঘটে। সুবিধাদির বহর ও আড়ম্বর বাড়তে থাকলে এ যুদ্ধের যে আসল মহিমা বীরত্ব, ত্যাগ ও বিজয়ের মধ্যে রয়েছে তা গুরুত্ব হারিয়ে ফেলবে। এখনই কি আমরা টের পাচ্ছি না মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা এবং সেই চেতনা নিয়ে যা হয় তার অনেক খানিই বাগাড়ম্বর, ফাঁপা বুলি, প্রকৃত চেতনা ও ভাবার্দশের মহিমা অনেকটাই ফিকে হয়ে যায়নি।’
লুম্পেনদের অগণতান্ত্রিক আচরণের কারণেই প্রিয় বাংলাদেশ আজ স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পর্যায়ে পৌঁছেছে। রাজনীতি অবশ্যই রাজনীতিকদের হাতেই থাকতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা বলেছেন, ‘হিটলারের দেশ থেকে গণতন্ত্র শিখতে হবে!’ মনে রাখা দরকার ২০১৫-২০১৬ অর্থ বছরে বাংলাদেশে দ্বিতীয় বিনিয়োগকারী দেশ জার্মানি। হিটলারের দেশ থেকে নয়, মহাত্মা গান্ধীর দেশ থেকেও তো শিখছেন না। সত্যিকার অর্থে লুম্পেনরা নিজেকে সবচেয়ে বেশি বড় মনে করে। তারা মনে করে তারা যেটা বুঝে সেটাই সঠিক। অন্য সবাইকে তাদের কথা মতো চলতে হবে। রাষ্ট্রীয় গঠন কাঠামোর উপর লুম্পেনদের আধিপত্য বিস্তার রোধ করার জন্য অবশ্যই অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রয়োজন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবশ্যই স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই হতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
locerin sklad ৭ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১১:১৯ পিএম says : 0
Astonishingly individual pleasant website. Huge info readily available on couple of gos to. locerin sklad profolan review probreast plus donde comprarlo nutrigo lab mass precio australian pull up http://baraita.net/drugs-for-the-treatment-of-alopecia-areata/
Total Reply(0)
locerin sklad ৭ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১১:১৯ পিএম says : 0
Astonishingly individual pleasant website. Huge info readily available on couple of gos to. locerin sklad profolan review probreast plus donde comprarlo nutrigo lab mass precio australian pull up http://machinalansu.pl/locerin/
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন