রসূলুল্লাহ (স.) এর জীবনের সর্বশেষ যুদ্ধ ছিল ‘তবুক যুদ্ধ‘। এটি হিজরী নবম সালের রজব মাসের এক রক্তপাতহীন ঐতিহাসিক ঘটনা। মূলত: ‘তবুক’-এ কোন যুদ্ধ সংঘটিত হয়নি, শত্রæ বাহিনী যাত্রা পথ থেকেই প্রস্থান করেছিল। এ যুদ্ধের বিবরণ প্রদানের পূর্বে এতদসংক্রান্ত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করা জরুরি মনে করি: ১. এটি রজব মাসের ঘটনা। ২. মুসলিম বাহিনীর নাম ‘জাইশূল উসরাত’ (আকালের সময়ের বাহিনী)। ৩. এ যুদ্ধের আরেক নাম ‘গাজওয়াতুল ফাযেহা’ (অর্থাৎ শত্রæ পক্ষের অপমানজনক যুদ্ধ)। ৪. মোনাফেকদের অপতৎপরতা। ৫. ধ্বংস প্রাপ্ত ‘সামূদ’ জাতির বসতি অতিক্রমকালে আজাবে এলাহির ভীতি প্রদর্শন। ৬. পথে হুজুর (স.) এর উট গুম হয়ে যাওয়া। ৭. মোনাফেকদের ‘মসজিদে যেরার’ নির্মাণের ব্যর্থ চেষ্টা। ৮. কসরের নামাজ। ৯. সাহাবী আব্দুল্লাহ জুলবিজা দাইন (রা.) এর ইন্তেকাল। ১০. রোমান বাহিনীর সংখ্যা ছিল ৪০ (চল্লিশ) হাজার। ১১. রসূলুল্লাহ (স.) এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনীর সংখ্যা ৩০ (ত্রিশ) হাজার। ১২. ‘তবুক’-এ কোন যুদ্ধ হয়নি। ১৩. ভীত হিরাক্লিয়াস বাহিনীর ফিরে যাওয়া। ১৪. একটি গুজবের ভিত্তিতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিরাক্লিয়াসের যুদ্ধ প্রস্তুতি। ১৫. যুদ্ধের জন্য সিদ্দীকে আকবর (রা.)-এর সর্বস্ব দান। ১৬. হজরত উসমান (রা.) এর সর্ব উচ্চ দান। ১৭. হজরত উমর (রা.) এর সমগ্র সম্পদের অর্ধেক দান। ১৮. রসূলুল্লাহ (স.) কর্তৃক প্রকাশ্যে ঘোষণার মাধ্যমে যুদ্ধ প্রস্তুতি। ১৯. যুদ্ধে বিরতদের অপরাধ ক্ষমা। ২০. হজরত আবুজর গিফারী (রা.) সম্পর্কে রসূলুল্লাহ (স.)-এর গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য। ২১. হজরত আলী (রা.)-কে রসূলুল্লাহ (স.) এর সান্তনা প্রদান, প্রভৃতি।
কোরআন-এ সূরা তওবাসহ অন্য এক স্থানে, আল্লাহ বলেছেন যে, আল্লাহর নিকট গণনার মাস হচ্ছে ১২ (বারটি)। এবং সেগুলোর মধ্যে চারটি মাস আদবের (সম্মানের)। এ চারটি মাস হচ্ছে জিলকদ, জিলহজ¦, মহররম এবং রজব। এসব মাসে রক্তপাত, ঝগড়া-বিবাদ এবং মারামারি, খুনাখুনি নিষিদ্ধ ছিল। হজ¦, উমরা এবং বাণিজ্যিক কাজ পরিচালনার স্বার্থে স্বাধীন ও শান্তিপূর্ণভাবে আরবরা সফর করতে পারতো। কোন ব্যক্তি এসব দিবসে তার পিতার হত্যাকারীরও প্রতিশোধ গ্রহণ করতনা। কারো কারো মতে, আসল ইব্রাহিমী মিল্লাতে এ চার মাসকে সম্মানিত গণ্য করা হয়েছিল। ইসলাম পূর্ব যুগে যখন আরবে বর্বরতা, কূপমন্ডুতা, ঝগড়া-বিবাদ ও খুনাখুনি বেড়ে যায় এবং পরস্পর দলাদলি ও প্রতিশোধ স্পৃহা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে, তখন তারা আসমানি-জমিনী কোন প্রকারের বিধানের তোয়াক্কা করত না। তখন পর্যন্ত ‘নাসি’ প্রথার ব্যাপক প্রচলন ছিল। অর্থাৎ যখন কোন শক্তিশালী গোত্রের ইচ্ছা হতো মহররম মাসে যুদ্ধে লিপ্ত হবার, তখন একজন নেতা ঘোষণা করত যে, এবছর আমরা মহররম মাসকে সফর মাসে বদল করেছি, মহররমকে বাতিল করেছি, সফরকে হালাল করেছি। যথারীতি এবার মহররম হারাম থাকবে এবং সফর হালাল থাকবে। অনুরূপভাবে বছরে চার মাসের গণনার হিসাব ঠিক রাখা হতো। কিন্তু সেগুলোর নির্ধারণ তারা নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী করত। বর্ণিত হয়ে থাকে, আরবে ‘নাসি’ প্রথার প্রথম প্রবর্তক ছিল ‘কালমাস কেনানী’। তার পরে, তারই বংশধরগণের মধ্যে এ প্রথা চালু ছিল। তাদের দেখাদেখি ইহুদী, খ্রিস্টানরাও এ প্রথার অনুসারী হয়ে যায়। তারাও হালালকে হারাম করার এবং হারামকে হালাল করার অধিকার তাদের লোভী, স্বার্থপর পাদ্রী, জাযক ও সন্যাসীদের হাতে দিয়ে দেয়। বর্ণিত আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে উলামায়ে কেরাম ও ভাষ্যকারগণ বলেন, কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করা সর্ব সময় জায়েজ। যেমন, ‘তবুক যুদ্ধ’ রজব মাসের ঘটনা (তফসীরে উসমানী)।
মুসলমানদেরকে ধ্বংস করার জন্য খ্রিস্টান শক্তি প্রথম থেকেই তৎপর ছিল। রসূলুল্লাহ (স.) এর আমলে তাদের সর্বশেষ ষড়যন্ত্র ছিল তবুক যুদ্ধ। মুতা যুদ্ধের পর রোমান খ্রিস্টানরা আরবদের উপর আক্রমণের সংকল্প গ্রহণ করেছিল। সে সময় সিরিয়া ছিল রোমানদের অধীনে। সিরিয়ার অধিবাসী গাস্সানী গোত্র খ্রিস্টান ধর্মালম্বী ছিল। এ জন্য রোমন শাসক মুসলমানদের উপর আক্রমণের জন্য এই গাস্সানী গোত্রকে নিয়োজিত করে। মদিনায় এ খবর পৌঁছার পর রসূলুল্লাহ (স.) সাহাবায়ে কেরামকে জানালেন। এ সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন যে, তবুক যুদ্ধের সময় খ্রিস্টানদের পক্ষ থেকে রোমান শাসক হিরাক্লিয়াসকে মিথ্যা খবর জানানো হয় যে, মদিনায় যিনি নিজেকে নবী বলে দাবি করতেন তিনি ইন্তেকাল করেছেন এবং তথায় ভীষণ দুর্ভিক্ষ ও মারাত্মক অভাব দেখা দিয়েছে। তাদের সম্পদও বিনষ্ট হয়ে গেছে। কাজেই এখন দেশটি সহজেই অধিকার করা যাবে। হিরাক্লিয়াস একজন রোমান সেনাপতিকে ৪০ (চল্লিশ) হাজার সৈন্যের এক বিরাট বাহিনীসহ প্রেরণ করেন এবং তাঁকে মদিনার শাসনকর্তা রূপে মনোনীত করেন। এ খবর রসূলুল্লাহ (স.)-এর নিকট পৌঁছার পর তিনি যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহণ করেন এবং ৩০ (ত্রিশ) হাজার মোজাহিদসহ মদিনা থেকে প্রায় ৪০০ (চারশত) মাইল দূরে ‘তবুক’ নামক স্থানে পৌঁছেন এবং ২০ (বিশ) দিন সেখানে অবস্থান কালে আশপাশের কয়েকটি গোত্রের সাথে কতিপয় সন্ধি চুক্তি করে প্রত্যাবর্তন করেন, কোন যুদ্ধ হয়নি। রোমানদের মোকাবিলা করার সাহস হয়নি, তারা অধিক অগ্রসর না হয়ে ফিরে যায়। ‘তবুক’ মদিনা ও সিরিয়ার মধ্যে অবস্থিত একটি স্থানের নাম। যার দূরত্ব ১৪ মনজিল। কেউ কেউ বলেন, এটি একটি দুর্গের নাম। কারো কারো মতে, এটি একটি ঝর্ণার নাম। ‘তবুক’ একটি ভূখন্ডের নাম বলেও অপর একটি মত রয়েছে। মূলতঃ কোন যুদ্ধ সংঘটিত না হলেও রসূলুল্লাহ (স.) ব্যাপক প্রস্তুতি সহকারে ভীষণ গরম ও দুর্ভিক্ষের সময়, খ্রিস্টানদের মোকাবিলার জন্য এই দীর্ঘ সফরে যাত্রা করেছিলেন।
এই যুদ্ধে মোনাফেকচক্র দারুণভাবে অপমানিত হয়েছিল। হিজরী নবম সালের রজব মাসে রসূলুল্লাহ (স.) ‘তবুক’ যুদ্ধে যাত্রা করেন বলে অনেক ঐতিহাসিকগণ একমত। তবে কেউ কেউ বলেন যে, হিজরী ১০/৬৩১ সালের নভেম্বর কিংবা ডিসেম্বর মাসে ‘তবুক যুদ্ধ’ সংক্রান্ত ঘটনাবলি সংঘটিত হয়েছিল। এই যুদ্ধের জন্য রোমান শাসক কত আগ্রহী ও উৎসাহী ছিল তা এই ঘটনা থেকেই প্রমাণিত হয় যে, রোমান শাসক হিরাক্লিয়াস, তার সৈন্যদের অগ্রিম এক বছরের খরচের অর্থ সামগ্রী বিতরণ করে দিয়েছিলেন।
তবুক যুদ্ধের বিবরণ বিভিন্ন সীরাত গ্রন্থে বিভিন্ন রকম বর্ণিত হলেও একটি বিষয়ে সবাই একই কারণ বর্ণনা করেছেন যে, এ যুদ্ধের প্রস্তুতির পেছনে প্রধান কারণ সক্রিয় ছিল ‘গুজব’। ‘বালকা’ নামক স্থানের মুসলিম বিদ্বেষী খ্রিস্টানরা রোমান শাসক হিরাক্লিয়াসকে এই মিথ্যা খবর দিয়েছিল যে, মদীনায় রসূলুল্লাহ (স.)-এর ইন্তেকাল হয়ে গেছে। এখনই তা সহজে অধিকার করা যাবে। আগ্রাসী হিরাক্লিয়াস এ মিথ্যা গুজবের সত্যতা যাচাই না করে মদিনা অধিকারের দুঃস্বপ্নে বিভোর হয়ে পড়েন। তিনি এক রোমান সর্দারের নেতৃত্বে ৪০ (চল্লিাশ) হাজার সৈন্য প্রেরণ করেন। অপর দিকে রসূলুল্লাহ (স.) এর নিকট খবর আসে যে, সিরিয়ার রোমের বিপুল সংখ্যক সৈন্যের সমাবেশ ঘটানো হয়েছে। তাদের সাথে যোগ দিয়েছে লখম, জুযাম, আমেলা এবং গাস্সানী গোত্রের বিপুল লোক। এটি গুজব ছিল না, ছিল সত্য ঘটনা। রসূলুল্লাহ (স.) এ বাস্তব ঘটনার খবর পেয়ে তবুক যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন এবং ৩০ (ত্রিশ) হাজার মোখলেস মোমেনকে নিয়ে এ বিপুল সৈন্য বাহিনীর মোকাবিলার জন্য যাত্রা করেন, যার উল্লেখ পূর্বেই করা হয়েছে।
রসূলুল্লাহ (স.) হজরত আলী (রা.) কে পরিবার-পরিজনের দেখ-ভালের জন্য মদিনায় রেখে যান। মোনাফেক চক্র তাতে তিরস্কার করতে লাগলো যে, রসূলুল্লাহ (স.) হজরত আলী (রা.)-এর প্রতি দুর্বলতা প্রদর্শন করে তাকে মদিনায় রেখে গিয়েছেন। আলী (রা.) তাদের এ আপত্তিকর মন্তব্য শুনে রাগে, ক্ষোভে অস্থির হয়ে তৎক্ষনাৎ অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে যাত্রা করেন এবং ‘জুরুফ’ নামক স্থানে রসূলুল্লাহ (স.)-এর সাথে মিলিত হন। বিস্তারিত শুনার পর রসূলুল্লাহ (স.) তাকে বললেন যে, ‘ওরা মিথ্যাবাদী, তুমি ফিরে যাও, আপন স্বজনদের দেখভালে আমার প্রতিনিধিত্ব কর, হে আলী! তুমি কি রাজি নও যে, তুমি আমার জন্য এমন হবে যেমন মুসার জন্য হারুন হয়েছিলেন, তবে আমার পরে আর কোন নবীর আগমন হবে না। অতঃপর আলী (রা.) মদিনায় প্রত্যাবর্তন করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন