বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

রূপগঞ্জে তাঁতকলে স্বপ্ন বুনে যাচ্ছেন কলেজ শিক্ষার্থীসহ ৩০ পরিবার

| প্রকাশের সময় : ৩০ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

মো. খলিল সিকদার, রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) থেকে : নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার মাছিমপুর এলাকায় তাঁতকলে কাপড় তৈরী করে স্বপ্ন বুনেছেন কলেজ শিক্ষার্থী শাহনাজ শিল্পী। অভাবের সংসারে জন্ম নেয়া শাহনাজ শিল্পী তিন বোন, এক ভাইসহ বাবা-মাকে সহযোগিতা করতেই তিনি বেঁছে নিয়েছেন তাঁত বুননের পেশা। তাঁতকলে কাপড় তৈরী করেই স্বপ্ন বুনে যাচ্ছেন শাহনাজ শিল্পী। লেখাপড়ার পাশাপাশি রাত-দিন তাঁত বুননের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন শাহনাজ শিল্পী। দেশীয় তাঁতের তৈরি করা শাড়ী, জামদানি ও চাঁদরের কদর এখনও সারা দেশে ছড়িয়ে রয়েছে। তাই দেশীয় তাঁতের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে তারা তাঁত শিল্পটিকে এখনও ধরে রেখেছেন। তবে হাতে বুনা তাঁত কলগুলো কালের বিবর্তনে অনেকটা হারিয়ে গেছে বললেই চলে। মাছিমপুর এলাকার হারুন অর রশিদের মেয়ে শাহনাজ শিল্পী। তিনি স্থানীয় মুড়াপাড়া বিশ^বিদ্যালয় কলেজের এইচএসসি ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী।
এছাড়া তাঁতকালে কাপড় বুনে জীবিকা নির্বাহ করছেন কলেজ শিক্ষার্থীসহ ৩০টি পরিবার। অনেকে বাপ-দাদার এ পেশা পরিবার গুলো এখনও ধরে রেখেছে। তবে, আধুনিক মেশিনে তৈরি কাপড়ের কাছে দিন দিন মার খেতে হচ্ছে দেশীয় তাঁতের বুননে কাপড়। তারপরও দেশীয় তাঁতের চাহিদা ধরে রাখতে পুরনো এ পেশা ধরে রেখেছেন অনেকেই।
সরেজমিনে মাছিমপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, এখানকার ৩০টি পরিবারের প্রধান পেশা তাঁতবুনন। তাই তাদের ওঠানের আঙ্গিনায় শোভা পাচ্ছে দু’একটি করে হাতে বুনা তাঁতের কল। এসব তাঁত কলগুলো চালনা করছেন পরিবারের সদস্যরা। এই চিত্র দেখা গেছে ওই গ্রামের আরো ৩০টি পরিবারের মধ্যে। তাদের প্রতিজনেই বাড়িতেই রয়েছে ২টি থেকে শুরু করে ১০টি তাঁতকল। তারা পরিবারের সদস্য ছাড়াও তাঁতীদের বেতন দিয়ে রাখছেন। কেউ কেউ বাণিজ্যিক ভাবে বসতঘরের এককোনে বসিয়েছেন এ তাঁতকল। এভাবে প্রায় শতাধিক তাঁতকল দেখা গেছে এই গ্রামটিতে। তাই এ গ্রামটি তাঁতকল গ্রামই পরিচিত।
অপর কলেজ শিক্ষার্থী মাকসুদা আক্তার। তিনিও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে এ পেশায় জড়িয়ে পড়েছেন। বাবা খোকন, মা খাদিজা বেগম, ভাই মাহাবুব, বোন আফরোজা ও সাদিয়াকে সাথে নিয়ে তাঁতে কাপড় বুনে লেখাপড়ার পাশাপাশি সংসার চালিয়ে আসছেন তারা। এ ধরনের আরো পরিবার রয়েছে।
কলেজ শিক্ষার্থী শাহনাজ শিল্পী জানান, বাবা হারুন অর রশিদ ও মা রুমা বেগম অতিকষ্টে কৃষি কাজ ও তাঁত বুনন করে তাকেসহ বড় বোন হ্যাপি, ছোট বোন নাজমীন ও একমাত্র ভাই সোহাগকে লেখা-পড়া করিয়ে আসছেন। তাই নিজেদের লেখা-পড়ার খরচ যোগাতে এবং বাবা-মাকে সহযোগীতা করতেই তিনি তাঁত বুনন কাজ করে আসছেন। এদের মধ্যে বড় বোন হ্যাপিকে বিয়ে দেয়া হয়েছে। বর্তমানে বাকি দুই বোন লেখা-পড়ার পাশাপাশি বাবা-মায়ের সঙ্গে তাঁত বুননে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। ছোট থেকেই তারা বাবার কাছে এ কাজ শিখেছেন। তাই সংসারের হাল ধরতে এ তাঁতবুনন করেই তারা সচ্ছলতা পেয়েছেন। ভবিষ্যতে লেখাপড়া শেষ করে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার হতে চান তিনি।
অপর কলেজ শিক্ষার্থী মাকসুদা আক্তার জানান, সরকারী ভাবে বিনা সুদে পূজির ব্যবস্থা থাকলে তাদের এ তাঁতকলগুলো আরো বাড়াতে পারতেন। তাদের হাতে বুনা তাঁতকল থেকে দিনে ২ থেকে ৪টি কাপড় তৈরী হয়। প্রতিটি কাপড় তৈরীতে খরচ হয় ২শ’ ৫০ টাকা থেকে শুরু করে ৪শ’ টাকা। আর তা স্থানীয় পাইকারী বাজারখ্যাত, ভুলতার গাউছিয়া, নরসিংদীর বাবুর হাট, তারাব জামদানী পল্লি, ও ডেমরা বাজারে পাইকারীভাবে ৬শ’ থেকে ১ হাজার টাকায় বিক্রি করতে পারেন। এভাবে এ তাঁতবুনন থেকে তাদের মাসিক আয় হচ্ছে প্রায় ১০ থেকে ১৫ হাজার হাজার টাকা।
স্থানীয় তাঁত ব্যবসায়ী মজিবুর, আমজাদ, হবিবুর ও খোকন মিয়াসহ আরো অনেকেই জানান, দেশীয় তৈরি তাঁতের বাজার মন্দা হওয়ায় ইতোমধ্যে শতকরা ৯০ ভাগ তাঁত বন্ধের পথে। কেউ কেউ এ ব্যবসা গুটিয়ে অন্য ব্যবসায় ঝুঁকছেন। ফলে উপজেলার তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় ৫ হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। নানা বাঁধা সত্বেও তারা শাড়ী, জামদানি ও চাদর তৈরি করে কোন রকম এ শিল্প টিকিয়ে রাখছেন।
তাঁত ব্যবসায়ী আব্দুল মতিন মিয়া বলেন, তাঁত শিল্প উন্নয়নের জন্য বিগত সরকার ১৯৮৩ সাল থেকে ব্যাংক ঋণ সুবিধা দিয়েছিলেন। এরপর এ শিল্পে অনেক ব্যবসায়ী লোকসানের মুখে পড়েন এবং ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করতে পেরে তারা এ পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় জড়িয়ে পড়েন। এসব দেশীয় তাঁত ব্যবসায়ীরা এখনও ঋনের বুঝা নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
লেখক, কলামিস্ট ও গবেষক লায়ন মীর আব্দুল আলীম বলেন, বাব-দাদার আমলের দেশীয় তাঁত শিল্প যারা এখনও ধরে রেখেছেন, সরকার যদি তাদের সহজ শর্তে ঋনসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা সহযোগিতা দেন তাহলে কিন্তু দেশীয় শিল্প আবারও উঠে দাড়াবে। শাহনাজ শিল্পীর মতো আরো শিক্ষার্থীরা বাবা-মাকে সহযোগীতা করে দেশীয় তাঁত শিল্প টিকিয়ে রেখেছে। তারাই আগামী প্রজন্মের জন্য মডেল হয়ে থাকবেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন