বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

হিজড়া সম্প্রদায় : কিছু কথা

মুফতী মোঃ আবদুল্লাহ্ | প্রকাশের সময় : ৩ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

প্রসঙ্গ: বেশ কিছুদিন যাবত হিজড়াদের বিষয়ে নানান কথা, নানান প্রশ্ন শোনা যাচ্ছে। বিশেষ করে রাস্তাঘাটে, যানবাহনে তাদের চাঁদা দাবী এবং বিশেষ করে পাড়া-মহল্লার বাসায়-বাসায় জোরপূর্বক ঢুকে পড়ে বাচ্চা-শিশুদের কোলে তুলে নিয়ে নাচানাচি এবং দু’হাজার থেকে দশ-পনের হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দাবী করে বসা; না দিলে বা কালবিলম্ব করলে তাৎক্ষণিক অশ্লীল ভাষায় গালি-গালাজ, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি এমনকি কাপড়-চোপড় খুলে ফেলাসহ হেন কোনো অপকর্ম নেই যা তারা করে না।
সংশ্লিষ্ট হানা-দেওয়া বাড়ি-ঘরের মালিক বা গৃহিনিদের কাছে বাস্তবে তাদের দাবীকৃত অর্থ থাকুক চাই না থাকুক, তাদের কাছে ছাড় বলতে কিছু নেই। প্রতিবেশির কাছ থেকে বা পাশের ফ্লাট থেকে বা পাশর্^বর্তী বাড়ী থেকে ধার-কর্জ করে হলেও, তাদের দাবীকৃত অর্থ অবশ্যই দিতে হবে; নতুবা কোনোভাবেই নিস্তার নেই। এ যে, কত বড় বাস্তবতা এবং কত নির্মম নির্যাতন তা ভুক্তভোগি ব্যতীত আর কাউকে বলে বুঝানো যাবে না! অবশ্য রাস্তাঘাটে বা যানবাহনে তারা জোরাজুরি তুলনামূলক কম করে থাকে। যে-কারণে বাইরের সাধারণ জনগণ তাদের রুদ্রমূর্তি ও বাস্তব আচরণ বিষয়ে তেমন ওয়াকিফহাল নয়।
অনেকে প্রশ্ন করে থানা-পুলিশ এদের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয় না কেন? পাশর্^বর্তী কেউ জবাব দিয়ে দেয়, এদের কাছে থানা-পুলিশও অসহায়। তাই সংশ্লিষ্টরা মামলা- মুকাদ্দামা করলেও তা গৃহীত হয় না। যে-কারণে ভুক্তভোগিরাও নীরবে সহ্য করে যায়! নির্যাতিত হয়েও কারো কাছে সাহায্য কামনার হাত প্রসারিত করতে পারে না বা করে না।
অবশ্য ইদানিং অনেকেই আবার প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন, হুজুর! এরা তো দেখতে বেশ তাগড়া ও সুস্থ্য-সবল মনে হয়; তা হলে এরা কাজকর্ম করতে পারে না? আবার কেউ কেউ প্রশ্ন করে, আয়-উপার্জন, জাগা-জমি-সম্পদ , দায়-দায়িত্ব ও উত্তরাধিকার বিষয়ে ইসলামী শরীয়তে কি এদের ব্যাপারে কোনো কিছু নেই?
এ ছাড়া, কিছুদিন পূর্বে সরকারী একটি সমাজসেবা অফিস থেকে হিজড়াদের মৃত্যু-পরবর্তী সৎকার, কাফন-দাফন বিষয়েও জানতে চেয়ে একটি আবেদন এসেছিল। এ সব প্রশ্ন ও আবেদনের জবাব দিতে গিয়ে বিবেকের তাড়া খেয়ে, পর্যায়ক্রমে এদের ব্যাপারে শরীয়তে কোথায় কি নির্দেশনা রয়েছে, তা যথাসাধ্য সাজিয়ে-গুছিয়ে একত্র করার এ প্রয়াস।
মহান আল্লাহর সৃষ্টি হিজড়া নামক এ জনগোষ্ঠি, যারা আমাদের মতোই ‘শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি’ মানবজাতিরই একটি অংশ। তাই শরীয়তসম্মত সঠিক নির্দেশনার আলোকে এদেরকে প্রকৃত মুসলমান হতে সাহায্য করা এবং রাষ্ট্রীয় উন্নয়নে জনবল হিসাবে যেন কাজে লাগানো যায়, সেই লক্ষ্যে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের সকলকে এগিয়ে আসার তাওফীক দিন। আমীন!
হিজড়া জনগোষ্ঠীর কাফন-দাফন ও উত্তরাধিকার
কাফন-দাফন, গোসলদান ও জানাযা পড়া ইত্যাদি সকল বিধানেই হিজড়ারা, সমান অধিকার ও সেবাপ্রাপ্তি প্রশ্নে অহিজড়া মুসলমানদের অনুরূপ । একজন মুসলিম নর বা নারী হিসাবে মুসলিম সমাজের কাছে তেমন সমান আচরণ প্রাপ্তি তাদের হকÑঅধিকারের অন্তর্ভূক্ত ।
১। উত্তরাধিকার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে যেমন সংশ্লিষ্ট হিজড়াকে পুরুষ গন্য করা হবে, না কি নারী? সেক্ষেত্রে যেমন বলা হয়েছে যে, যদি তার সৃষ্টিগত বাহ্যিক অবস্থা ও আভ্যন্তরীণ অবস্থা- উদাহরণত, দাঁড়ি-মোচ গজানো, পুরুষের অনুরূপ আচরণ এবং পুরুষের অনুরূপ বা তার কাছাকাছি প্র¯্রাবের স্থান অথবা তার দ্বারা কোন নারীর গর্ভ সঞ্চারিত হওয়া; কিংবা নারীসুলভ আচরণ, স্তন-গুপ্তাঙ্গ নারীদের অনুরূপ বা কাছাকাছি হওয়া অথবা তার মাসিক ¯্রাব হওয়া, ইত্যাদি লক্ষণীয় হয় এবং পুরুষ বলে ধর্তব্য হয়; তা হলে একজন অহিজড়া মুসলিম পুরুষের সমপরিমাণ অংশ সেও পায়। আর নারী বলে ধর্তব্য হলে, একজন অহিজড়া মুসলিম নারীর সমপরিমাণ অংশ একজন হিজড়া নারীর প্রাপ্য; যদিও ক্ষেত্রবিশেষে অর্থাৎ কেবল ‘জটিল হিজড়া’র ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম হয়ে থাকে । ঠিক তেমনি গোসল ও কাফন-দাফনে নারী বা পুরুষ নির্ধারণ করে; এবং জেনে নিয়ে অর্থাৎ নারী হলে অন্যকোন নারীই তাকে গোসল দেবে এবং ৩ কাপড়ের স্থলে ৫ কাপড় দেয়া হবে। (আদদুররুল মুখতার+রাদ্দুল মুহতার ঃ খ-৩, পৃ- ৯৯, যাকারিয়া বুক ডিপো, দেওবন্দ, ভারত)
আর যদি পুরুষ গণ্য করা হয় তাহলে তাকে অন্য কোন পুরুষই গোসল দেবে এবং তিন কাপড়ে কাফন দিয়ে, জানাযা পড়ে, দাফন করতে হবে। কোনরূপ বৈষম্য করা হবে না। অবশ্য যে- হিজড়াকে নারী বা পুরুষরূপে নির্ধারণ করা যাচ্ছে না তথা ‘জটিল হিজড়া’, তাকে সতর্কতামূলক নারীর অনুরূপ পাঁচ কাপড়ে দাফন করা যেতে পারে; যদিও তিন কাপড়ে দাফন করাও জায়েয আছে।
২। মৃত হিজড়া যদি চার বছর বয়সী বা কমবেশী বয়সের এমন শিশু হয় যে, তার প্রতি স্বভাবজাত আকর্ষণ জন্মে না তাহলে তাকে নারী পুরুষ যে কেউ গোসল দিতে পারবে। (আহসানুল ফাতাওয়া : খ-৪, পৃ- ২২১ ; যাকারিয়া বুক ডিপো, দেওবন্দ, ভারত)
৩। মৃত হিজড়া যদি এমন হয় যে, তাকে নারী বা পুরুষ কোনো দিকেই প্রাধান্য দেয়া যাচ্ছে না তাহলে সেক্ষেত্রে সে সাবালকের কাছাকাছি হোক বা সাবালক হোক; তাকে তায়াম্মুম করিয়ে, কাফন পরিয়ে জানাযা দিয়ে কবরস্থ করা হবে। (আদদুররুল মুখতার+রাদ্দুল মুহতার ঃ খ-৩, পৃ-৯৪-৯৫, যাকারিয়া বুক ডিপো, দেওবন্দ, ভারত+ আল-বাহরুর রায়িক : খ-২, পৃ-৩০৫, ৩১১; যাকারিয়া বুক ডিপো, দেওবন্দ, ভারত)
৪। জানাযার দু’আর ক্ষেত্রেও উপরিউক্ত নিয়মে নারী-পুরুষ জেনে নিয়ে দু’আ পড়বে। আর মৃতটি যদি না-বালক হয় এবং ছেলে বা মেয়ে নির্ধারণ জটিল হয় তাহলে শিশুদের ক্ষেত্রে বর্ণিত দু’আর যে কোনটি পড়লেই যথেষ্ট হবে। (আহসানুল ফাতাওয়া : খ-৪, পৃ-২০২, ২২১ ; যাকারিয়া বুক ডিপো, দেওবন্দ, ভারত)
সংজ্ঞা ও শ্রেণি:
বাংলা ভাষায় পরিচিত ‘হিজড়া’-কে শরীয়ত তথা কুরআন, হাদীস ও ফিকহের ভাষায় বলা হয় ‘খুনছা’(হিজড়)। আভিধানিক অর্থে আরবী ‘খুনছা’ শব্দটির মাছদার বা মূলধাতু হচ্ছে ‘আত-তাখান্নুছ’, যার বাংলা অর্থ হচ্ছে, নরম হওয়া, দূর্বল হওয়া, ভেঙ্গে পড়া, ত্রæটিযুক্ত হওয়া। খুনছা-কে খুনছা বলার কারণ হচ্ছে, সে পুরুষের তুলনায় ভঙ্গুর হয়, দূর্বল হয়, ত্রæটিযুক্ত হয়। আবার নারীর তুলনায় তার অবস্থা কিছুটা উন্নত হয়। কারণ, তার পুরুষ ও নারী উভয়সুলভ লিঙ্গ সংযুক্ত থাকে। (আল-মুসতালাহাত ওয়াল-আলফাযুল ফিকহিয়্যা: খ-২,পৃ-৫৯, মিসর)
‘তাখান্নুছ’ মানে ‘মেয়েলী আচরণ করা, মেয়েলী স্বভাবসম্পন্ন হওয়া’; (আল-মু‘জামুল ওয়াফী: পৃ-২৬৪)
আল্লামা যয়নুদ্দীন ইবন নুজাইম মিসরী (র) বলেন,“ ‘নিহায়া’ গ্রন্থের ভাষ্য হচ্ছে, গ্রন্থকার (‘কান্য’ প্রণেতা) যখন একটি অঙ্গবিশিষ্ট নারী ও পুরষের বিধান আলোচনা শেষ করলেন তখন তিনি দু’অঙ্গ সম্বলিতদের বিধান আলোচনা শুরু করলেন”। (আল-বাহরুর রায়িক: খ-৮, পৃ-৩৩৪, যাকারিয়া বুক ডিপো, দেওবন্দ, ভারত)Ñএ থেকে বোঝা যাচ্ছে, সাধারণত হিজড়া’দের লজ্জাস্থানকেন্দ্রিক দু’টি অঙ্গই হয়ে থাকে।
পারিভাষিক অর্থে “ ‘হিজড়া’ হচ্ছে এমন মানুষ যার পুরুষের অনুরূপ পুরুষাঙ্গ এবং নারীর অনুরূপ গুপ্তাঙ্গ বিদ্যমান অথবা বাস্তবে এদের কারো অনুরূপই নয় বরং তার একটি ছিদ্র বিদ্যমান যা পুরুষ-নারী কারোর অনুরূপই নয়”।(আল-মুসতালাহাত ওয়াল-আলফাযুল ফিকহিয়্যা: খ-২,পৃ-৬০)
মুফতী আমীমুল ইহসান মুজদ্দেদী বারাকাতী (র) হিজড়ার সংজ্ঞা বিষয়ে লিখেনÑ
“খুনছা’ শব্দটি ‘খানাছা’ হতে নির্গত, মানে দূর্বলতা, কোমলতা। শরীয়তের পরিভাষায় এমন ব্যক্তিকে ‘হিজড়া’ বলা হয় যার পুরুষ ও নারী উভয়বিধ গুপ্তাঙ্গ রয়েছে; কিংবা তার কোনোটিই নেই। আর ‘জটিল হিজড়া’ বলতে, সে মানুষকে বুঝানো হয় যাকে পুরুষ ও নারী কোনো দিকেই প্রাধান্য দেওয়া যাচ্ছে না।” (কাওয়াইদুল ফিকহি: পৃ-২৮২, আশরাফী বুক ডিপো, দেওবন্দ, ভারত)
সাবালক পূর্ববর্তী অবস্থা
যেক্ষেত্রে তার পুরুষ ও নারী উভয়সুলভ গুপ্তাঙ্গ থাকে সেক্ষেত্রে বিবেচনা করা হবে সে কোনটি দ্বারা প্র¯্রাব করে? যদি পুরুষাঙ্গ দ্বারা পেশাব করে তা হলে তাকে ছেলে বলে গন্য করা হবে। আর যদি নারীসুলভ গুপ্তাঙ্গ দ্বারা পেশাব করে তা হলে তাকে মেয়ে বলে গন্য করা হবে। কেননা, তেমন পরিস্থিতিতে এটাই দলীলস্বরূপ ধর্তব্য হবে যে, যা দ্বারা পেশাব নির্গত হচ্ছে তা-ই মূল অঙ্গ, অন্যটি রোগ-সমস্যা।
আর যেক্ষেত্রে পুরুষ-নারী কোনো সুলভ অঙ্গই না থাকে; কেবল ছিদ্র দ্বারা পেশাব করে থাকে। পুরুষ বা নারী হিসাবে চিহ্ণিত করার মতো অপর কোনো চিহ্ণ প্রকাশ না পায় সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট হিজড়াকে ‘খুনছা-মুশকিল’ বা জটিল হিজড়া বলা হয়। এমন সমস্যা সাধারণত ছোট বয়সের ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে; যা বয়-সন্ধিকালে আর অবশিষ্ট থাকে না। (আল-মুসতালাহাত ওয়াল-আলফাযুল ফিকহিয়্যা: খ-২,পৃ-৫৯, মিসর)
সাবালক পরবর্তী অবস্থা
অবশ্য যখন সাবালক হয়ে যায় তখন অপরাপর নিদর্শন দ্বারা উক্ত জটিলতা দূরীভুত হয়ে যায়। সেসব নিদর্শন হচ্ছে, হয়তো তার দাড়ি-মোচ ইত্যাদি গজাবে; সুতরাং তখন তাকে পুরুষ বলা হবে; কিংবা তার স্তন বড় হবে তখন তাকে নারী বলা হবে।
‘সিরাজিয়্যা’ নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে,“যদি নারীদের অনুরূপ তার স্তন প্রকাশ পায় বা তার মাসিক হয় বা তার সঙ্গে সহবাস করা যায়, তা হলে সে নারী বলে গন্য হবে।”(প্রাগুক্ত:পৃ-৬০)
হযরত ইমাম আবূ হানীফা (র)-কে হিজড়াদের উত্তরাধিকার প্রশ্নে জিজ্ঞাসা করে হলে তিনি উত্তরে বললেন, “তাদের পেশাবের স্থান বিবেচনায় তা নির্ধারিত হবে”।( ‘দারেমী’ সূত্রে প্রাগুক্ত: খ-০২/৪৬১)
উক্তরূপ বর্ণনা হযরত আলী (রা) থেকেও বর্ণিত হয়েছে। ইসলাম-পূর্ব জাহেলিয়া যুগেও তাদের ক্ষেত্রে তেমন বিধানই প্রচলিত ছিল; তাই ইসলামও তা-ই বহাল রেখেছে। (প্রাগুক্ত:পৃ-৬০)
উল্লেখ্য, উপরিউক্ত আলোচনার প্রতি লক্ষ করলে বোঝা যায়, বাস্তবে হিজড়াদের তিনটি শ্রেণি বিদ্যমান: ১) পুরুষ হিজড়া, ২) নারী হিজড়া ও ৩) জটিল হিজড়া।
আরব-অনারব দেশে দেশে হানাফী মাযহাহের সর্বাধিক প্রচলিত ও গ্রহণযোগ্য আইনী গ্রন্থ ‘আদদুরুল মুখতার+শামী’-তে কি রয়েছে, তা এ পর্যায়ে লক্ষ করি:-
“আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর সৃষ্টি আদম-সন্তানদের নারী-পুরুষ দু’ভাগে সৃষ্টি করেছেন। (নিসা : ০১ ও শূরা : ৪৯) তাদের উভয়শ্রেণির বিধি-বিধানও তিনি বর্ণনা করেছেন। অথচ হিজড়াদের বিষয়ে তেমন প্রত্যক্ষ ও পৃথক কিছু বয়ান করেননি। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, একজন মানুষ একই সঙ্গে নারী-পুরুষ বিপরীতমুখী উভয় গুণে-বিশেষণে অভিহিত হতে পারে না। তার মাঝে নারী বা পুরুষ সুলভ তথা তেমনটির পরিচায়ক কোনো চিহ্ণ-সংকেত অবশ্যই থাকবে। যদিও তা কখনও কখনও চিহ্ণিত করতে সংশয় হতে পারে।” (প্রাগুক্ত: গায়াতুল-আওতার: খ-৪, পৃ-৪৯৫; এইচ.এম.সাঈদ কোং, করাচী/ শামী: খ-১০, পৃ-৪৪৬, যাকারিয়া বুক ডিপো, দেওবন্দ, ভারত)
আল্লামা শামী (র)-এর উক্ত বর্ণনা থেকে এটিও বোঝা যাচ্ছে, যে-ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট হিজড়া পুরুষরূপে চিহ্ণিত হবে সে-ক্ষেত্রে সে পুরুষ হিসাবে নামায-রোযা পালন করবে; উত্তরাধিকার প্রাপ্ত হবে। আর যে-ক্ষেত্রে নারী হিসাবে চিহ্ণিত হবে সে-ক্ষেত্রে তার ওপর একজন নারীর অনুরূপ নামায-রোযা, উত্তরাধিকারের বিধান প্রযোজ্য হবে।
“ হিজড়া হচ্ছে সে ব্যক্তি যার নারী ও পুরুষ উভয়সুলভ গুপ্তাঙ্গ বিদ্যমান; কিংবা তেমন কোনোটিই নেই। সে যদি পুরুষাঙ্গ দিয়ে পেশাব করে, তা হলে পুরুষ; আর যদি নারীসুলভ গুপ্তাঙ্গ দ্বারা পেশাব করে তা হলে সে নারী বলে গন্য। আর যদি এমন হয় যে, উভয় অঙ্গ দ্বারাই পেশাব করে; তা হলে সেক্ষেত্রে প্রথমে যেটি দিয়ে পেশাব বের হবে সেটিই মূল হিসাবে ধর্তব্য হবে; অন্যটি হবে অতিরিক্ত ও অনুগামী। আর যদি উভয়টি দিয়ে একই সময়ে পেশাব বের হয় তা হলে সেক্ষেত্রে তাকে বলা হবে ‘জটিল হিজড়া’। কারণ, তার ব্যাপারে নারী বা পুরুষ কোনো একদিক নির্দিষ্ট করা গেল না। আর এমনটি হয়ে থাকে সাবালক হওয়ার পূর্বে।
পরে যখন সাবালক হলো এবং তার দাড়ি গজালো অথবা সে কোনো নারীর সঙ্গে সহবাস করতে সক্ষম হলো অথবা তার পুরুষের অনুরূপ স্বপ্নদোষ হলো, তা হলে সে পুরুষ বলে গন্য হবে। আর যদি তার স্তন প্রকাশ পায় বা দুধ বের হয় বা মাসিক হয় বা গর্ভ সঞ্চারিত হয় বা তার সঙ্গে সহবাস করা সম্ভব হয়; তা হলে তাকে নারী বলে গন্য করা হবে।
আর যদি তার (সাবালক হওয়ার পরেও) উক্ত কোনো নিদর্শনই প্রকাশ না পায় কিংবা নিদর্শনগুলো পরস্পর বৈপরিত্যের প্রমাণ বহন করে এবং কোনো একদিকের নিদর্শনকে প্রাধান্য দেওয়া না যায়; তা হলে সেক্ষেত্রে তাকে ‘জটিল হিজড়া’ বলা হবে।” (গায়াতুল-আওতার: খ-৪, পৃ-৪৯৬; এইচ.এম.সাঈদ কোং, করাচী)
উক্ত উদ্ধৃতি থেকে নতুন করে আমরাÑ ১) নারী ও পুরুষ হিজড়া নির্ধারণের প্রক্রিয়া, ২) সাবালক হওয়ার পরও জটিল হিজড়া’র অস্তিত্ব এবং ৩) হিজড়ার বেলায় অহিজড়া মুসলিমদের অনুরূপ নামায-রোযা ও উত্তরাধিকারের বিধান প্রয়োগ করা Ñএই তিনটি বিষয় পেলাম।
হিজড়া-০৪
বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে (২০০০খ্রি. মোতাবেক ১৪২০হি.) বায়রুত ও দামেশক থেকে একযোগে প্রকাশিত, হানাফী মাযহাবকে নতুন আঙ্গিকে সাজানো-গোছানো গ্রন্থ ‘আল-ফিকহুল হানাফী ফী ছাওবিহিল-জাদীদ’ গ্রন্থটির দ্বিতীয় খন্ড, ২৭২ পৃষ্ঠায় বিজ্ঞ আলেম ও ফকীহ্ গ্রন্থকার আল্লামা আবদুল হামিদ মাহমূদ তুহমান ‘জটিল হিজড়া’ প্রসঙ্গে লিখেছেনÑ
“ যদি আদতেই তার কোনো নিদর্শন প্রকাশ না পায় অথবা নিদর্শনগুলোর মধ্যে বৈপরিত্য দেখা যায়, তা হলে সে হবে ‘খুনছা মুশকিল’ তথা জটিল হিজড়া। আর সাবালক হওয়ার পর তেমন হিজড়া বাস্তবে অনেক কমই পাওয়া যায়। বিশেষ করে আমাদের বর্তমান সময়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির কারণে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পাওয়া যাওয়ার কারণে এটি একেবারে সহজ যে, তাঁরা এক্স-রে, বিভিন্ন রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং তার অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত ও ব্যতিক্রমী অঙ্গটি অপারেশনের দ্বারা কেটে ফেলতে পারেন। (‘আল-ফিকহুল হানাফী ফী ছাওবিহিল-জাদীদ’, দ্বিতীয় খন্ড, ২৭২ পৃষ্ঠা, কাহেরা, মিসর)
উক্ত ‘জটিল হিজড়া’র ব্যাপারে, তার নারী/পুরুষ বিষয়টি স্থিরীকৃত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত, তার ক্ষেত্রে সকল বিধি-বিধানে সতর্কতার দিকটি প্রযোজ্য হবে। সম্পদ বন্টন প্রশ্নে ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর গবেষণাপ্রসূত মতানুযায়ী তাকে ছোট অংশটি দেওয়া হবে। তার প্রক্রিয়া হবে: তাকে পুরুষ গন্য করলে তার অংশ কত হয় এবং নারী বলে গন্য করলে তার অংশ কত হয়? তা বিবেচরা করতে হবে এবং তার পর তাকে সে হিসাবে ছোট অংশটি প্রদান করা হবে। আর উক্ত উভয়বিধ বিবেচনা কালীন কোনো ক্ষেত্রে সে যদি প্রতিবন্ধকতার দরুন বঞ্চিত হয়; তা হলে সে কোনো অংশ পাবে না। ‘সাহেবাইন’ (ইমাম আবূ ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদ) র. বলেন: তাকে পুরুষ ও নারী কল্পনা করলে উভয়টির সমষ্টি যা হবে তার অর্ধেক প্রদান করা হবে। কিন্তু ‘ফাতওয়া’ (চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত) হচ্ছে ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর অভিমত অনুযায়ী। আর তাই হচ্ছে,সকল সাহাবীরও অভিমত।”( ‘আল-ফিকহুল হানাফী ফী ছাওবিহিল-জাদীদ’ : দ্বিতীয় খন্ড, ২৭২ পৃষ্ঠা; কাহেরা, মিসর)
Ñউক্ত উদ্ধৃতি থেকেও লক্ষণীয়:
সমস্যা কেবল ‘জটিল হিজড়া’র ক্ষেত্রে; যে-হিজড়া নারী বা পুরুষরূপে চিহ্ণিত হয়ে গেছে তার ক্ষেত্রে জটিলতার কিছু নেই। যে-কারণে সে স্বাভাবিক নারী-পুরুষের অনুরূপই সম্পদের উত্তরাধিকারী হবে এবং তার মুত্যুজনিত কারণে তার ওয়ারিসরাও অন্যদের অনুরূপ বিধি মোতাবেক তার উত্তরাধিকারী হবে।
সমাজ-সংসার ও রাষ্ট্রীয় আনুকুল্য থাকলে এক সময় ‘জটিল হিজড়া’ও জটিল থাকবে না এবং তাদের ব্যাপারেও বৈসম্যহীন আইনী সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ হয়ে যাবে।
ইতোপূর্বে ‘বাহরুর রায়িক’ সূত্রে আলোচিত বিষয়টি অর্থাৎ ‘হিজড়া’দের প্রাপ্য অংশ ঘিরে ব্যাপক যে-আলোচনা বা অভিমতের প্রসঙ্গ বিভিন্ন কিতাবে বিদ্যমান তা কেবল জটিল হিজড়ার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য; অন্য দু’প্রকার হিজড়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। যে-কারণে এ বিজ্ঞ গ্রন্থকার অপরাপর সব বক্তব্য এড়িয়ে গেছেন।
এমনকি হানাফী মাযহাবের বিজ্ঞ ইমামদেরও আরও যেসব ‘তাফসীলী অভিমত’ রয়েছে তা-ও তিনি পরিহার করে কেবল সংক্ষেপে ইমাম আ‘যম (র) ও সাহেবাইন-এর অভিমত উল্লেখ করে, সর্বশেষ ও স্থিরীকৃত চুড়ান্ত সিদ্ধান্তটিও জানিয়ে দিলেন। সুতরাং শরীয়া আইন ও গবেষণার ‘উসূল’ (মূলনীতি/নীতিমালা) মোতাবেক এসব নিয়ে নতুন করে গবেষণার কিছুই নেই।
কুরআন-সুন্নাহ্, সাহাবাগণের আমল, চার মাযাবের গবেষক ইমামদের যুগে ও পরবর্তী যুগে ধর্মবিশেষজ্ঞগণÑ বিশেষত শরীয়া আইনবিশেষজ্ঞ আলেম গ্রন্থকারগণ আলোচ্য বিষয়টিসহ অপরাপর সব বিষয়েই এতো অধিক পরিমাণে অনুসন্ধান ও অনুপুঙ্খ আলোচনা করে গেছেন যে, বর্তমানে আর নতুন করে এসব ক্ষেত্রে অনুসন্ধানের কিছু নেই Ñএই অর্থে যে, আমরা আরও হাজার বছর গবেষণা করেও তাঁরা যা কিছু রেখে গেছেন, তার বাইরে নতুন কিছু দিতে পারবো না। নতুন কিছু দেওয়া তো পরের কথা; আমরা তো তাঁরা যা যা গুছিয়ে দিয়ে গেছেন এবং কোন্ বিষয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত কি, চিহ্ণিত করে দিয়ে গেছেন তাও খুঁজে বের করতে হিমশিম খেয়ে থাকি!
উপসংহার: উপরিউক্ত বিস্তারিত আলোচনা থেকে সহজেই অনুমেয় যে, ইসলামী শরীয়তে ‘আশরাফুল- মাখলুকাত’ মানবজাতির ছোট একটি অংশ হলেও, আলোচ্য হিজড়াদের ব্যাপারেও প্রয়োজনীয় ও যথেষ্ট দিক-নির্দেশনা বিদ্যমান। যে-কারণে খোদ হিজড়াদের নিজেদের বেলায় দায়িত্ব ও কর্তব্য সচেতন হওয়ার পাশাপাশি ধর্মীয় নের্তৃবৃন্দেরও ধর্মীয় কর্তব্য বর্তায়, হিজড়াদের সংশ্লিষ্ট পরিবার-স্বজনদের, জনগণকে , সমাজ ও রাষ্ট্রকে এদের বিষয়ে সচেতন ও উৎসাহিত করা। যেন সবাই এদের সঙ্গে অপর দশজনের অনুরূপ সদ্ব্যবহার ও মানবিক আচরণ করে; এদের বিয়ে-শাদী, ঘর- সংসার, আয়-উপার্জন, সামাজিকতা, ইবাদত-বন্দেগী, মৃত্যু-পরবর্তী সম্মানজনক কাফন-দাফন-জানাযায় সকলেই সহযোগিতা করতে পারে। বিশেষ করে এরা যেন ভবঘুরে হয়ে রাস্তায় রাস্তায় চাঁদাবাজি বা হাতপাতা কিংবা বাসা-বাড়িতে হানা দিয়ে সংশ্লিষ্টদের উত্যক্ত না করে; বরং অন্য দশজনের অনুরূপ প্রয়োজনীয় ও সম্ভাব্য কাজ-কর্ম ও পেশায় নিয়োজিত হয়ে সম্মানজনক জীবিকা এবং সামাজিক মর্যাদার অধিকারী হতে পারেÑ তেমন সার্বিক প্রচেষ্টা ও উদ্দোগে আমাদের সকলকে শরীক হতে হবে। তার পাশাপাশি রাষ্ট্র ও প্রশাসনকেও এদের সার্বিক কল্যাণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। মহান আল্লাহ্ আমাদের সকলকে জিড়াদের কল্যাণে এগিয়ে আসার তাওফীক দিন। আমীন!

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
জাহিদ ৩ মে, ২০১৮, ৪:৫৪ এএম says : 0
সুন্দর লেখাটির জন্য ধন্যবাদ
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন