বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

প্রতিকূলতা পারেনি ওদের দমাতে

প্রকাশের সময় : ৭ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মর্জিনা আফসার রোজী
ক্রমশ গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা সোনার হরিণ হয়ে যাচ্ছে। যতই গণতন্ত্র, গণতন্ত্র বলে যপতপ করা হোক না কেন সে কেবলই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। যে দেশে বাস্তবতা তুলে ধরে কথা বলা যায় না, আইন বিভাগে ঘুণ পোকার বাসা, বিচার বিভাগ সম্পর্কিত কোনো বাক্য উচ্চারণের উপায় নেই, তথাপি আঁধার রাতে কার তর্জনীর ইশারায় বদলে যায় ন্যায়পরায়ণের দ-। খুন, গুমের মহোৎসবের আমেজে কেটে যাচ্ছে নিরুপায় জনগণের জীবন। নির্বাচন পরিণত হয়েছে এক হাস্যকর তামাশার বিষয়ে আর ক্ষমতাধারীদের ইচ্ছা-আকাক্সক্ষা পূরণের সহজ ব্যবস্থায়। চলছে প্রতিহিংসা আর প্রতিশোধের রাজনীতি। নিষ্ঠুর আর কঠোরতার প্রয়োগে ভবিষ্যতের পথকে করা হচ্ছে নিরঙ্কুশ। গালভরা বুলি আর মিথ্যা উন্নয়নের ফানুসে বিভ্রান্ত জনগণ। নেই বেঁচে থাকার নিরাপত্তা, পথ চলার স্বাচ্ছন্দ্যতা। এত কিছুর পরও শুনতে পাই দেশে নাকি গণতন্ত্র বিরাজমান। রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘৃণা আর প্রতিশোধের রিহার্সাল করে অন্তর আত্মাকে কলুষিত করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া হত্যা, লুণ্ঠন, সহিংসতার সুবিচার হয় না। উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের নির্মম খুনের কোনো সুরাহা যে সমাজে অনুপস্থিত। সেখানে কী করে গণতন্ত্রের অবস্থান হতে পারে। কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর সংজ্ঞায়ই এমন পরিস্থিতির সংকলন নেই। উন্নয়নের গালভরা বুলি কেবলই সাধারণের চোখে ভেল্কি লাগানো বিষয়। সুধীজনেরা চিন্তিত, দেশে অসহিষ্ণু, অমার্জিত ও অশোভন দোষারোপের যে রীতি চালু হয়েছে তার তেজষ্ক্রিয়তা দীর্ঘকাল কল্যাণের মহিমাকে ম্লান করে দেবে। এর ধীরগতি বিষক্রিয়ায় একদিন সবাইকে নীলাবরণ ধারণ করতে হবে। সেদিন শুধুই হতাশায় ঘিরে থাকবে। উত্তরণের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে না। গণতন্ত্রের পাখিটি বন্দি খাঁচায় ডানা ঝাপটিয়ে রক্তাক্ত হচ্ছে অবিরাম।
এরই মধ্যে গত ১৯ মার্চ অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বিএনপির ষষ্ঠ কাউন্সিল অধিবেশন। ক্ষমতাসীনদের তীব্র আক্রমণের শিকার হয়েও দলীয় গণতান্ত্রিক ধারাকে অক্ষুণœ রাখতে সমর্থ হয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশনে সকাল ১১টায় চেয়ারপারসন স্বাতন্ত্র্যিক ভঙ্গিতে, শতভাগ সফল কাউন্সিল উদ্বোধন করেন। দলটির বহুল প্রত্যাশিত এ সাংগঠনিক গতিশীলতা নব উদ্যমের সূচনা করেছে। নানা প্রতিকূলতা, হামলা-মামলা ও দমন-পীড়নে জর্জরিত দলটির জন্য সমাবেশটি ছিল মিলন মেলার এক শুভক্ষণ। বিশেষ করে বাংলাদেশের সব জেলা থেকে আগত সক্রিয় নেতাকর্মীরা একে অন্যকে দেখে যেন সঞ্জিবনী সুধার স্বাদ পেয়েছেন। সবাই সবার কুশলাদি বিনিময়ের মাধ্যমে আন্তরিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল, বিশেষ করে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উজ্জীবিত সব নেতাকর্মীই কম-বেশি যন্ত্রণায় কাতর। তবুও যেন অন্তরে পুঞ্জীভূত শক্তির তেজোদ্দীপ্ততায় টগবগ করছে তাদের মুখচ্ছবি। এর ওপর সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ভিডিও চিত্রে প্রচারিত মর্মস্পর্শী বক্তব্যে আগতদের সংগ্রামী হৃদয়কে প্রশমিত করেছে। পিনপতন নীরবতায় আত্মস্থ করেছে তার বাণীকে। শত ভোগান্তি অতিক্রম করে ছুটে আসা নেতাকর্মীদেরকে অনুপ্রাণিত করেছে তার চমৎকার ভাষণ। পোড় খাওয়া নেতৃবৃন্দের হৃদয়কুলে সস্তির মলম লেপন করে দিয়েছেন। তার বক্তব্যে, চলনে-বলনে এবং স্বপ্ন দেখানোর ধরনে বহু পুরনো জনপ্রিয় এক নেতার প্রতিচ্ছবি ভাসমান হয়। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সেই স্বর্ণযুগের কথা। ক্ষণজন্মা এই নেতার মহিমা ও মহত্বকে আজো কেউ বিস্মৃত হননি। এত মমতা আর এত ভালোবাসা অনেকেরই সহ্য হয় না, অন্তর প্রজ্জ্বলিত হয় বিনাশি অগ্নিস্ফুলঙ্গে। তাই তো তার বিরুদ্ধে এত অপপ্রচার, জেলজুলুম, হুলিয়া।
বিএনপিকে যারা প্রতিষ্ঠা করেছে, লালন করেছে, সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়েছে কেউ-ই নিরাপদ নয়। সবার আগে এবং তীব্র বেগে জিয়া পরিবারের ওপর আঘাত এসেছে এবং সে যৌথ ষড়যন্ত্র আজ অবধি অব্যাহত আছে। তারেক রহমান তার বক্তব্যে লাখো ভক্ত-সমর্থককে জিয়া পরিবারের অন্তর্ভুক্ত বলে সম্মানিত করেছেন। চেয়ারপারসন তার বক্তৃতায় দীর্ঘ কাদা ছোড়াছুড়ির রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে শান্ত, সৌম্য এবং ভবিষ্যৎ উন্নয়নের কথা বলেছেন। তার ঘোষিত ভিশন-২০৩০ শান্তি ও সমৃদ্ধিতে পূর্ণ আশার আলো দেখিয়েছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর ‘একনায়কতান্ত্রিক’ ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা ও দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের কথা বলেছেন। নিঃসন্দেহে বিষয়টি প্রশংসার দাবিদার। কারণ এই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ ও স্থিতিশীল শাসনব্যবস্থা গড়তে আমাদের একটা ব্যাপকভিত্তিক সাংবিধানিক সংস্কারের প্রয়োজন। এ ছাড়া এক নেতার এক পদ কথাটি কাউন্সিলর এবং ত্যাগী নেতাদের বহুদিনের প্রত্যাশিত দাবি। এ দাবি বাস্তবায়নে চেয়ারপারসনের আশ্বাসের ভিত্তিতে তারা স্বস্তি ও ফুরফুরে মেজাজে রয়েছে। এতে অবশ্য অবশ্যম্ভাবীভাবে জাতীয় নির্বাহী কমিটির কলেবর বৃদ্ধি পাবে। তবে এটি কার্যে পরিণত করা সময়ের দাবি। সামর্থ্যরে অধিক পদ দখলের কারণে বিভাজন সম্ভব হয় না। জবাবদিহিতা ও দায়িত্বশীলতা প্রমাণ করার সুযোগ কমে যায়। বিএনপির সংশোধিত গঠনতন্ত্রে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট হয়েছে। চেয়ারপারসনের অনুপস্থিতিতে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানকে স্থায়ী কমিটির প্রধান করা হয়েছে। সঠিক সময়েই কাউন্সিল অধিবেশনটি সম্পন্ন হয়েছে। এতে আঘাতে আঘাতে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়া কর্মীবৃন্দ আবারো সোচ্চার হয়েছে।
বিএনপির প্রথম কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর। ঢাকার রমনা বটমূলের খোলা চত্বরে ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী প্রতিষ্ঠাকালীন মহাসচিবের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এরপর দ্বিতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ফেব্রুয়ারি মাসের কাউন্সিলে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন মরহুম বিচারপতি আব্দুস সাত্তার আর মহাসচিবের দায়িত্ব পান পূর্বে বহাল থাকা ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী। এর ৮ বছর পর ১৯৮৯ সালের ৮ ও ৯ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় দলটির তৃতীয় কাউন্সিল। সেই কাউন্সিলেই বেগম খালেদা জিয়া প্রথম চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন এবং মহাসচিবের দায়িত্ব পান তৎকালীন খ্যাতিমান নেতা ব্যারিস্টার আব্দুস সালাম তালুকদার। ১৯৯৩ সালের ১, ২ ও ৩ সেপ্টেম্বর বিএনপির চতুর্থ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। জাঁকজমকপূর্ণ সেই অনুষ্ঠানে নেতা-কর্মীরা উদ্বুদ্ধ এবং আলোড়িত হয়েছিলেন। সেই কাউন্সিলে বেগম খালেদা জিয়া পুনরায় চেয়ারপারসন এবং মহাসচিব হন আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া। ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর পঞ্চম কাউন্সিলে বেগম খালেদা পুনর্বার চেয়ারপারসন ও খন্দকার দেলোয়ার হোসেন মহাসচিবের পদ অলঙ্কৃত করেন। এর ৬ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর এবার ১৯ মার্চ ২০১৬ ষষ্ঠ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হলো। এবার অত্যন্ত বৈরী পরিস্থিতির মধ্যে সুশৃঙ্খল এই অধিবেশনটি সমাপ্ত হয়। চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন বেগম খালেদা জিয়া এবং সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তারেক রহমান এবং মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে সেদিন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হিসেবে বহাল রাখা হলেও, কয়েকদিন পর তাঁকে মহাসচিব হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
এবারের কাউন্সিলকে সফলকাম করার জন্য উপ-কমিটিগুলো শতভাগ আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার নিদর্শন দেখিয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ আজও জাতীয়তাবাদী শক্তির স্থপতিকে হৃদয়ের সর্বোচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত করে রেখেছেন। তার প্রমাণ পাহাড় সমান বিঘœতাকে বারবার দূরে ঠেলে এগিয়ে গেছেন তারা। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এত বছর গত হওয়ার পরও কেউ তার অর্জন, জনপ্রিয়তা আর দেশপ্রেমকে অতিক্রম করতে পারেনি। তিনি চিরজাগ্রত, অম্লান এবং সদা ভাস্বর। তারই প্রতিচ্ছবি যিনি সগৌরবে বহন করে চলেছেন, এ দেশের মানুষ তাকেও হৃদয়ের মণিকোঠায় ঠাঁই দিয়েছেন। সে দৃশ্য কাউন্সিল অধিবেশনের সর্বত্রই পরিলক্ষিত হয়েছে। দলীয় অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা একদিন সমগ্র সমাজে গণতন্ত্রের সুবাতাস প্রবাহিত করে দেবেÑএটাই কামনা।
য় লেখক : প্রাবন্ধিক ও সংগঠক
ৎড়ংুৎিরঃবৎ১৯৬৬@মসধরষ.পড়স

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন