শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

চাঁদাবাজির জন্য দলবদল

আ’লীগের নামে শতাধিক অঙ্গসংগঠন : নেতাদের ম্যানেজ করেই চলছে সবকিছু

প্রকাশের সময় : ৭ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৪৯ পিএম, ৬ এপ্রিল, ২০১৬

নূরুল ইসলাম : নাম তার বাচ্চু খন্দকার। ১৯৮৫-৮৬ সালে ছিলেন ঠেলাগাড়ির চালক। যাত্রাবাড়ীর পরিবহন ব্যবসায়ী আব্দুল খালেকের সহযোগিতায় টেম্পোর হেলপার হওয়ার সুযোগ মেলে। এক সময় দুর্ধর্ষ ক্যাডার কালা লিয়াকতের হাত ধরে যোগ দেন ফ্রিডম পার্টিতে। তখন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মিটিং-মিছিল করেছেন। এরপর যোগ দেন বিএনপিতে। ডেমরার তৎকালীন এমপি সালাহউদ্দিনের ভাই নওয়াবের গ্রুপের সক্রিয় নেতা ছিলেন। কিছুদিন পরে আবার নেতা পরিবর্তন করে যোগ দেন মীর্জা আব্বাস গ্রুপে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ভোল পাল্টে ফেলেন। এখন তিনি শ্রমিক লীগের নেতা। দীর্ঘদিন জাতীয় শ্রমিক লীগ যাত্রাবাড়ী থানার সাধারণ সম্পাদকের পদ দখল করে আছেন। যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা থেকে ডেমরা, চিটাগাং রোড, পোস্তগোলা রুটে চারশ’ টেম্পো, হিউম্যান হলারের নিয়ন্ত্রক তিনি। টেম্পো ও হিউম্যান হলার থেকে প্রতিদিন চাঁদা ওঠে কমপক্ষে ১ লাখ টাকা। সেই টাকায় বাচ্চুর আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হলেও প্রকৃত নেতাকর্মীরা কিছুই পান না। এ কারণে ভেতরে ভেতরে এখানকার শ্রমিক লীগ কয়েক ভাগে বিভক্ত।
বিএনপি আমলে পল্লবী থানা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন মনু মোল্লা। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিনা ঘোষণায় আওয়ামী লীগার বনে গেছেন। নিজেকে এখন পল্লবী থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক দাবি করেন। স্থানীয় এমপির মামাতো ভাই মনু মোল্লার ইশারায় পল্লবী এলাকায় অনেক কিছুই হয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, পল্লবী এলাকায় বেশ কয়েকটি রুটে শতাধিক বাস ও মিনিবাস চলাচল করে। এসব গাড়ি থেকে প্রতিদিন ২ লাখ ৬৮ হাজা টাকা চাঁদা ওঠে। এই চাঁদার টাকা লাইনম্যানদের হাত হয়ে সোজা চলে যায় আওয়ামী লীগের ক্ষমতাধর নেতা মনু মোল্লার হাতে। এই টাকা ভাগবাটোয়ারা করে তিনি সবকিছু ম্যানেজ করেন।
মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বরে ক্ষুদ্র যানবাহন শ্রমিক লীগ নামের একটি সংগঠন নিয়ন্ত্রণ করে সিএনজি অটোরিকশা সেক্টর। শতাধিক অটোরিকশা থেকে প্রতিদিন চাঁদা ওঠে কমপক্ষে ৩০ হাজার টাকা। এ ছাড়া মিরপুর ১০ নম্বর থেকে বিভিন্ন রুটে অটোরিকশা চালু করার জন্য এই সংগঠনকে দিতে হয় এককালীন ২০ হাজার টাকা। এই সংগঠনের সভাপতি টিংকু, সাধারণ সম্পাদক জামিল, হান্না, মোশাররফ, আবু, মাঈনুদ্দিনসহ বেশিরভাগ নেতা এরশাদ সরকারের আমলে জাতীয় শ্রমিক পার্টির নেতা ছিলেন। ’৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর দলবদল করে জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলে চলে আসেন। এরপর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে শ্রমিক লীগে, মাঝখানে বিএনপির আমলে শ্রমিক দল হয়ে আবার শ্রমিক লীগে যোগ দিয়েছেন। ৭ বছর ধরে শ্রমিক লীগের হয়ে তারা মিরপুর গোলচত্বর এলাকার অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণ করছেন। অভিযোগ রয়েছে, এই সংগঠনের নেতারা ব্যাটারিচালিত ইজি বাইকের অনুমোদনের কথা বলে ৫ হাজার টাকা করে বিনিময়ে কার্ড বিক্রি করেছেন। কমপক্ষে ৪ হাজার দুশ’ কার্ড বিক্রি করে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে ২ কোটি ১০ লাখ টাকা। সরকার শহরের ভিতরে ইজি বাইক চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণার পর মালিকপক্ষ পথে বসলেও সংগঠনের পক্ষ থেকে কাউকে টাকা ফেরত দেয়া হয়নি। শুধু যাত্রাবাড়ী, মিরপুর নয়, সারা রাজধানী জুড়েই এভাবেই চাঁদাবাজির জন্য দলবদল করে অনেকেই ক্ষমতাসীন দলের নিষ্ঠাবান, জনদরদি নেতা বনে গেছেন। সাইডলাইনের অনেক নেতা আবার মূল দলে সুবিধা করতে না পেরে নতুন সংগঠন তৈরি করে সেই সংগঠনের নেতা সেজেছেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে এ ধরনের সংগঠনের সংখ্যা একশ’র বেশি। দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী সভায় এ নিয়ে বহুবার আলোচনা সমালোচনা হয়েছে। অঙ্গ সংগঠনের নামে এসব ভুঁইফোঁড় সংগঠনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নেয়া হলেও শেষ পর্যন্ত তা কার্যকর হয়নি। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, দলীয় সর্বোচ্চ ফোরামে ইতোপূর্বে এ নিয়ে বহুবার আলোচনা হয়েছে। নামসর্বস্ব সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বলা হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সরকারী দলের নাম ভাঙিয়ে চলছে দখল, চাঁদাবাজিসহ ক্ষমতার একচ্ছত্র রাজত্ব। ক্ষমতাসীন দলের নেতা বা এমপিকে ম্যানেজ করে চলছে এই চাঁদাবাজি। চাঁদার ব্যাপকতা বাড়াতেই মূলত আওয়ামী লীগের কোনো অঙ্গসংগঠনের ব্যানারের আশ্রয় নিয়েছে সুবিধাভোগীরা। চাঁদাবাজির জন্য একাধিকবার দলবদল করেছেন অনেকেই। এজন্য তারা ক্ষমতাসীনদলের নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ার জন্য যা করার তাই করে থাকেন। আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতা-কর্মীরা মনে করেন, এতে করে ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী লীগেরই বদনাম হচ্ছে। যাত্রাবাড়ীর বাচ্চু খন্দকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তিনি স্থানীয় এমপির নাম ভাঙিয়ে চলেন। এ প্রসঙ্গে স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি ইনকিলাবকে বলেন, এমপি সাহেব অত্যন্ত সরল মানুষ। বাচ্চু কৌশলে এমপির নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি করছে। পাঁচতলা বিলাসবহুল বাড়ি ও গাড়ির মালিক হয়েছে। একই দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা কিছুই পাচ্ছে না। এতে করে দলের ভাবমূর্তি দিন দিন ক্ষুণœ হচ্ছে।
রাজধানীর জুরাইনেও এমনিভাবে দলবদল করে ক্ষমতার প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এলাকাবাসী জানায়, স্থানীয় এমপি সৈয়দ আবু হোসেন বাবলার ভাগ্নে মাসুক নিয়ন্ত্রণ করে পুরো জুরাইন শ্যামপুর এলাকা। এলাকায় ‘মামা’ বলে পরিচিত মাসুক একসময় বিএনপি করতেন। বিএনপি আমলে গোপীবাগ এলাকার যুবদলের নেতা ছিলেন। এখন মামার গুণে শ্যামপুর এলাকার জাতীয় পার্টির নেতা হয়েছেন। এলাকায় তার একক আধিপত্য নিয়ে বহু কথা চালু আছে। গতবারে এই আসনের এমপি ছিলেন অ্যাডভোকেট সানজিদা খানম। স্থানীয় আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই এখন আর সানজিদার দলে নেই। তারা সুবিধা আদায়ের জন্য এখন বর্তমান এমপির সাথে ভিড়েছেন। এর মধ্যে একজন মহিলা ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নাম বেশ আলোচিত। নাম প্রকাশ না করার শর্তে শ্যামপুর ইউনিয়নের একজন কাউন্সিলর বলেন, শ্যামপুরের বালুর মাঠসহ শিল্পাঞ্চলের কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজির জন্য কেউ কেউ দলবদল করেছেন। এই দুটি বিষয় নিয়েই তো সাবেক ও বর্তমান এমপির মধ্যে দ্বন্দ্ব চরমে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সব সরকারের আমলেই এভাবে দখলদারিত্বের পালাবদল ঘটে। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে এটা অতীতের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের নামে অঙ্গসংগঠন তৈরি করে সেই দলের নেতা সেজে চাঁদাবাজি করা যেন রোগে পরিণত হয়েছে। রাজধানীসহ সারাদেশেই এই প্রথা চালু হয়েছে। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ নেতাই ক্ষুব্ধ। জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর সাবেক এপিএস ড. আওলাদ হোসেন বলেন, দলের একজন কর্মী হিসাবে আমি মনে করি আওয়োমী লীগের ইমেজ, জনপ্রিয়তা ও সুখ্যাতি রক্ষার জন্য এইসব ভুঁইফোঁড় সংগঠনগুলো বন্ধ করে দেয়া উচিত। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের অনুমোদিত অঙ্গসংগঠন মাত্র ৮টি। এর বাইরে যেসব সংগঠন আছে সবই অবৈধ। আমার মনে হয় স্বাভাবিকভাবে বন্ধ করা না হলে আইন করে এসব সংগঠন বন্ধ করা উচিত।
আওয়ামী লীগের নামে অঙ্গসংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে, আওয়ামী তরুণ লীগ, আওয়ামী যুব আইনজীবী পরিষদ, আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা লীগ, আওয়ামী মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম লীগ, আওয়ামী প্রজন্ম লীগ, আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ, আওয়ামী হকার্স লীগ, আওয়ামী যুব হকার্স লীগ, আওয়ামী ছিন্নমূল হকার্স লীগ, আওয়ামী সমবায় লীগ, আওয়ামী শিশু যুব সাংস্কৃতিক জোট, আওয়ামী পরিবহন শ্রমিক লীগ, আওয়ামী পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা লীগ, আওয়ামী তৃণমূল লীগ, ছিন্নমূল মৎস্যজীবী লীগ, রিকশা শ্রমিক লীগ, রিকশা মালিক শ্রমিক ঐক্যলীগ, রিকশা ভ্যান শ্রমিক লীগ, আমরা নৌকা প্রজন্ম, দেশীয় চিকিৎসক লীগ, ইসলামী ফাউন্ডেশন কর্মচারী লীগ, নৌকা সমর্থক গোষ্ঠী, নৌকার নতুন প্রজন্ম, নৌকার মাঝি শ্রমিক লীগ, ঘাট শ্রমিক লীগ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী লীগ, ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী লীগ, মৎস্যজীবী লীগ, আওয়ামী প্রচার লীগ, জাতীয় গণতান্ত্রিক লীগ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ পরিষদ, বিশ্ববাঙালি সম্মেলন, সাধনা সংসদ, জাতীয় মুক্তিবাহিনী ’৭৫, জনতার প্রত্যাশা, ’৭৫-এর ঘাতক নির্মূল কমিটি, ২১ আগস্ট ঘাতক নির্মূল কমিটি, পরিবর্তন ফাউন্ডেশন, সোনার বাংলা গঠন পরিষদ, সম্মিলিত যুব পেশাজীবী পরিষদ, অরোরা ফাউন্ডেশন।
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সংগঠনের মধ্যে রয়েছে, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ, মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম, মুক্তিযুদ্ধ ও গণমুক্তি আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবার কল্যাণ পরিষদ, মুক্তিযোদ্ধা লীগ, মুক্তিযোদ্ধা তরুণ লীগ, মুক্তিযোদ্ধা জনতা লীগ, জাতীয় মুক্তিবাহিনী, স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি প্রতিরোধ কমিটি, প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধে সহযোগী সংগঠন, মুক্তিযোদ্ধা সমাজ কল্যাণ যুব সংঘ, জয়বাংলা সাংস্কৃতিক পরিষদ, মুক্তিযোদ্ধা পূনর্বাসন সংসদ, মুক্তিযোদ্ধা পূনর্বাসন সংস্থা, আমরা মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম, স্বাধীনতা হোমিওপ্যথিক চিকিৎসক পরিষদ, বাংলাদেশ স্বাধীনতা পরিষদ ইত্যাদি। ডিজিটাল নিয়েও বেশ কয়েকটি সংগঠন হয়েছে। এগুলো হলো, ডিজিটাল বাংলাদেশ, ডিজিটাল আওয়ামী লীগ, ডিজিটাল প্রজন্ম লীগ, ডিজিটাল আওয়ামী ওলামা লীগ, ডিজিটাল ছাত্রলীগ ইত্যাদি। এসব সংগঠনের মধ্যে কোনো কোনোটি আবার কয়েকভাগে বিভক্ত। যেমন বাংলাদেশ আওয়ামী হকার্স লীগ পাঁচভাগে বিভক্ত। জানা গেছে, ফুটপাতের চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওটা এই সংগঠনের নেতারা নিজেদেরকে আওয়ামী লীগের সমর্থক বলে দাবি করলেও ভিতরে গলদ রয়েছে বলে সাধারণ হকাররা জানান। একই অবস্থা তৃণমূল হকার্স সমিতির নেতাদের ক্ষেত্রে। কামাল সিদ্দিকী ও ইমরান নামের এই সংগঠনের শীর্ষ দুই নেতা এক সময় বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন বলে হকাররা জানান।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
Bablu Mia ৭ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:৫৭ পিএম says : 0
Now Bangladesh is a political less country.So every person (Except few persons) to tray earn money anyway . this matter is sample matter.
Total Reply(0)
ফিরোজ ৭ এপ্রিল, ২০১৬, ৪:০৭ পিএম says : 0
এসব লোকেরাই দলের দুর্ণাম করে।
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন