শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

পাইপলাইনে যাবে জ্বালানি তেল

অপচয়-অনিয়ম চুরি-দুর্নীতি রোধ, যানজট এড়িয়ে ব্যয় কমবে

| প্রকাশের সময় : ১৩ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

মাতারবাড়ী ও পতেঙ্গা হয়ে চট্টগ্রাম-ঢাকা জাতীয় গ্রিড পাইপলাইন স্থাপনের পরিকল্পনা : জ্বালানি নিরাপত্তায় গ্যাস-বিদ্যুতের পাশাপাশি তেলের পাইপলাইন অপরিহার্য
শফিউল আলম : পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা হবে জ্বালানি তেল। গ্যাস ও বিদ্যুতের মতোই জাতীয় গ্রিডের সাথে সংযোগকারী পাইপলাইনে যাবে জ্বালানি তেল। এ ব্যাপারে বিভিন্ন প্রকল্প ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। দেশে শিল্প কল-কারখানা, কৃষি-খামার, পরিবহন, বিদ্যুৎ উৎপাদন, নগরায়ন, ব্যবসা-বাণিজ্য, গৃহস্থালী মিলিয়ে সবক্ষেত্রেই অপরিহার্য জ্বালানি তেল। ডিজেল, অকটেন, পেট্রোল, কেরোসিন, জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল প্রভৃতি সবধরনের জ্বালানি তেলের চাহিদা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই গুরুত্বের প্রেক্ষিতে সরকার জ্বালানি তেল সরবরাহ পদ্ধতি আরও দ্রæতায়িত, যুগোপযোগী ও আধুনিকায়ন করতে চায়। এ ব্যাপারে গৃহীত পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জ্বালানি তেল খাতে ব্যাপক চুরি-দুর্নীতি, অনিয়ম-অপচয় রোধ, সড়ক-মহাসড়ক পথে ট্যাংক লরি যোগে পরিবহনের ক্ষেত্রে যানজট সমস্যা পরিহার, নৌপথে পরিবহনে ঝুঁকি, তেল দূষণ বা নিঃসরণ ও হরেক ঝামেলা এড়ানো, নিরাপদ সরবরাহ এবং সর্বোপরি ভোক্তাদের কাছে ব্যাপক ব্যয় সাশ্রয়ী করা। এই লক্ষ্যে কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ী ও চট্টগ্রাম বহির্নোঙরের পতেঙ্গায় সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) টার্মিনাল থেকে এবং দেশের প্রধান জ্বালানি তেল স্থাপনা পতেঙ্গা ও রাষ্ট্রায়ত্ত একমাত্র পরিশোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি (ইআরএল) হয়ে চট্টগ্রাম-ঢাকা জাতীয় গ্রিড পাইপলাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে সরকার। দেশে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গ্যাস ও বিদ্যুৎ গ্রিড লাইনের পাশাপাশি জ্বালানি তেলের পাইপলাইন নির্মাণও অপরিহার্য হিসেবেই দেখছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞগণ।
বিশেষজ্ঞ সূত্র আরো জানায়, প্রত্যেক দেশের জন্যই ‘জ্বালানি নিরাপত্তা’ একটি অপরিহার্য বিষয়। সাধারণত ন্যুনতম ২ মাসের জ্বালানি তেল মজুদ রাখা নিশ্চিত হলেই একটি দেশকে জ্বালানি নিরাপত্তাসম্পন্ন হিসেবে গণ্য করা হয়। বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের বহুমুখী কর্মকাÐে ব্যবহার বৃদ্ধির সাথে সাথে জ্বালানি নিরাপত্তা গুরুত্বও অনেক বেশি। কেননা দেশে সীমিত পর্যায়ে প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলন হলেও তরল জ্বালানি তথা পেট্রোলিয়াম এখনও নেই। গ্যাস ফিল্ড সমূহের কনডেনসেট থেকে অল্প পরিমানে তরল জ্বালানি বাদ দিলে দেশের জ্বালানি তেলের চাহিদার পুরোটাই আমদানি করে মেটাতে হয়। দেশে বর্তমানে বার্ষিক ৬০ লাখ মেট্রিক টন জ্বালানি তেলের চাহিদা রয়েছে। যা বছর বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান চাহিদা মোকাবেলায় অতীতে দুয়েকটি দেশ থেকে অপরিশোধিত ও পরিশোধিত তেল আমদানি করা হতো। এখন জি টু জি চুক্তির ভিত্তিতে ১২/১৪টি দেশের তেল কোম্পানির সাথে চুক্তি করে বিপিসি অপরিশোধিত ও পরিশোধিত তেল আমদানি করছে।
দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে পিডিবি, রেন্টাল-কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টগুলোতে চাহিদা মাফিক জ্বালানি তেল সরবরাহের চাহিদাও বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারীর তেল পরিশোধন ক্ষমতা প্রায় ১৫ লাখ মেট্রিক টন, যা চাহিদার এক চতুর্থাংশ। ফলে তিন-চতুর্থাংশই পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করতে হয়। জ্বালানি তেলের আমদানি নির্ভরতা হ্রাস ও চাহিদা পূরণে ৩০ লাখ মেট্রিক টন ক্ষমতাসম্পন্ন ইস্টার্ন রিফাইনারি ইউনিট-২ স্থাপন প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সেখান থেকে তেল সরবরাহ হবে অদূর ভবিষ্যতে পাইপলাইনে। এসপিএম, চট্টগ্রাম-ঢাকা জ্বালানি তেল পাইপ লাইন, এবং ভারতের শিলিগুড়ি থেকে পার্বতীপুরে জ্বালানি তেল আমদানির জন্য পাইপ লাইন স্থাপনের লক্ষ্যে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
এদিকে জ্বালানি তেল সরবরাহে পাইপলাইন স্থাপনের বিষয়ে গত ৭ মে চট্টগ্রামে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) এক অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জ্বালানি খাতের সিস্টেম লস প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের জানান, আমাদের বছরে একশ থেকে দেড়শ’ মিলিয়ন ডলারের তেল অপচয়- পিলফারেজ হয়, আমি বলব না চুরি। গভীর সমুদ্র এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম জ্বালানি তেলের পাইপলাইন করছি। এ প্রকল্পগুলো সম্পন্ন হলে দেড়শ’ দুইশ’ মিলিয়ন ডলার আমরা সাশ্রয় করতে পারবো। জ্বালানি তেল হ্যান্ডলিংয়ের ক্ষেত্রে ‘ওশেন লস’ বা ‘রিভার লস’ সাশ্রয় হবে। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বলেন, দেশে জ্বালানি নিরাপত্তা আরো সুদৃঢ় করতে স্বল্প সময় ও খরচে, অপচয়বিহীন এবং নিরাপদে জ্বালানি তেল পাইপ লাইনের মাধ্যমে সরবরাহের সরকার বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে। তিনি জানান, জাহাজ থেকে সরাসরি পরিশোধিত ও অপরিশোধিত জ্বালানি তেল খালাস ও চট্টগ্রামে পরিবহনের জন্য মাতারবাড়ীতে ‘সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন’ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। তাছাড়া চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত পাইপ লাইনের মাধ্যমে জ্বালানি তেল পরিবহরের জন্য ‘পাইপলাইন ফর ট্রান্সপোর্টেশন অব হোয়াইট পেট্টোলিয়াম অয়েল ফ্রম চিটাগাং’ প্রকল্প এবং হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর সংলগ্ন কুর্মিটোলা এভিয়েশন ডিপোতে উড়োজাহাজের জ্বালানি তেল পরিবহন ও মজুদের লক্ষ্যে ‘জেট-এ-১ পাইপলাইন ফ্রম কাঞ্চন ব্রিজ, পিতলগঞ্জ টু কেএডি ডিপো, ঢাকা ইনক্লুডিং স্টোরেজ ট্যাংক’ শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
আমদানিকৃত জ্বালানি তেল জাহাজ থেকে খালাসের জন্য গভীর সমুদ্রে ‘সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং’ শীর্ষক একটি প্রকল্প বাস্তবায়নে ইতোমধ্যে চীনের সঙ্গে অর্থায়ন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে সরকার। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে তেল খালাস বাবদ সিস্টেম লস হ্রাসসহ বার্ষিক প্রায় এক হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ প্রকল্পে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রে ভাসমান তেল খালাসের টার্মিনালটি নির্মিত হবে। চট্টগ্রামের তেল ডিপোকে সংযুক্ত করতে ২২০ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন তৈরি করা হবে। সম্প্রতি এসপিএম উইথ ডাবল পাইপ লাইন প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য চীনা এক্সিম ব্যাংক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এসপিএম প্রকল্পে বৈদেশিক অর্থায়ন হবে ৫৫৪ দশমিক ৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এরমধ্যে নমনীয় ঋণের পরিমাণ ৮২ দশমিক ৫৬ মিলিয়ন ডলার এবং প্রেফারেনশিয়াল বায়ার্স ক্রেডিট (পিবিসি) ৪৬৭ দশমিক ৮৪ মিলিয়ন ডলার। বার্ষিক ২ শতাংশ সুদে ৫ বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ ২০ বছর মেয়াদি শর্তে এক্সিম ব্যাংক অব চায়না অর্থায়ন করবে।
পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) সূত্র জানায়, বর্তমানে লাইটারিং করে একটি এক লাখ টনের জাহাজ (ট্যাংকার) থেকে তেল খালাস করতে ১১ দিন সময় প্রয়োজন হয়। টার্মিনাল নির্মিত হলে তা মাত্র ২ দিনে নেমে আসবে। মাদার ট্যাংকার থেকে লোডিং বয়ারের মাধ্যমে জ্বালানি তেল খালাস করে পাইপের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয়া হবে তেল শোধনাগারে। এ মুরিংয়ে ২টি পাইপলাইন থাকবে। একটিতে পরিশোধিত তেল আসবে অপরটির মাধ্যমে অপরিশোধিত তেল খালাস হবে। এরফলে জাহাজের তেল খালাসের সময় ও খরচ কমবে। প্রকৌশলীরা জানান, সিঙ্গেল মুরিং হলে ৪৮ ঘণ্টায় এক লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন অপরিশোধিত এবং ২৮ ঘণ্টায় ৭০ হাজার মেট্রিক টন ডিজেল খালাস করা যাবে। এতে বার্ষিক খালাসের ক্ষমতা হবে ৯০ লাখ মেট্রিক টন।
মাতারবাড়ী সমুদ্রে এসপিএম প্রকল্পের আওতায় সামুদ্রিক ট্যাঙ্কার-জাহাজ থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে সরাসরি জ্বালানি তেল পরিশোধন কারখানা ইস্টার্ন রিফাইনারি এবং পতেঙ্গায় দেশের প্রধান জ্বালানি তেলের স্থাপনা পর্যন্ত জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হবে। এর জন্য সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং টার্মিনাল (এসপিএম) নির্মিত হচ্ছে। ডাবল পাইপলাইনসহ এ মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নে ৪ হাজার ৯৩৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা ব্যয় হবে।
এদিকে দেশের একমাত্র ও রাষ্ট্রীয় জ্বালানি তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিটের নির্মাণ কাজ দুই মাসের মধ্যে শুরু করতে নির্দেশ দিয়ে গেছেন জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি গত ৭ মে ইস্টার্ন রিফাইনারির অনুষ্ঠানে জানান, নতুন ইউনিটের পরিশোধন ক্ষমতা বর্তমান ১৫ লাখ মে. টন থেকে ৩০ লাখ মে. টন বেড়ে ৪৫ লাখ মে. টনে উন্নীত হবে। সরকার গভীর সমুদ্রে পাইপ লাইন তৈরি করছে। সেই পাইপ লাইনে যে তেল আসবে তা নতুন রিফাইনারিতে ফিড ইন (যুক্ত) হবে।
ইআরএলের অধীনে পাইপলাইনের মাধ্যমে সাগরে বড় জাহাজ থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল খালাসের জন্য সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্পের কাজ চলছে। এসব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অদূর ভবিষ্যতে জ্বালানি তেল পাইপ লাইনের মাধ্যমে ঢাকাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সরবরাহ হবে। সংযুক্ত করা হবে জাতীয় গ্রিডের সাথে। এরফলে জ্বালানি তেল সরবরাহ হবে সহজতর।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Fahim Haque ১৩ মে, ২০১৮, ১০:১৫ এএম says : 0
জ্বালানী তেল সরবরাহ নিশ্চিত করতে হলে আধুনিক ব্যবস্থা হলো পাইপলাইন স্থাপন। সরকারের গৃহীত প্রকল্প গুলি অবিলম্বে বাস্তবায়ন করতে হবে।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন