বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

পুলিশের বেপরোয়া আচরণ

প্রকাশের সময় : ১৭ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা গোলাম রাব্বীর ওপর পুলিশি নির্যাতনের রেশ কাটতে না কাটতেই ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তা বিকাশ চন্দ্র দাস বেদম পুলিশ প্রহারের শিকার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ ঘটনা ঘটেছে যাত্রাবাড়ী এলাকায়। নিজের পরিচয় দেয়ার পরও টহল পুলিশের সদস্যরা ছিনতাইকারী আখ্যা দিয়ে তাকে যথেচ্ছ পিটিয়ে রাস্তায় ফেলে যায়। ব্যাংক কর্মকর্তা গোলাম রাব্বীও এখন হাসপাতালে। মোহাম্মদপুর থানার এসআই মাসুদ সিকদার ও তার কয়েকজন সহযোগী ৫ লাখ টাকা দাবি করে তাকে নির্যাতন করে, এমনকি ক্রসফায়ারের ভয় দেখায়। এই অভিযোগে ওই এসআইকে প্রত্যাহার করা হলেও ব্যাংক কর্মকর্তা এখনো নিজেকে নিরাপত্তা বোধ করছেন না। খবর প্রকাশিত হয়েছে, কে বা কারা হাসপাতালে গিয়ে তাকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে এসেছে। গতকাল প্রকাশিত অন্য এক খবরে জানা গেছে, রাজধানীর সূত্রাপুরে এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করেছে পুলিশ। আরেক খবরে জানা গেছে, কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে এক ব্যবসায়ীকে আটক করে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ৪৫ হাজার টাকা আদায় করেছে পুলিশ। ক’দিন আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার যে মাদরাসা ছাত্র মারা গেছে, দাবি করা হয়েছে, পুলিশ ও সন্ত্রাসীদের হামলাতেই যে মারা গেছে। পুলিশের একশ্রেণীর সদস্য ও কর্মকর্তা কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এসব ঘটনা ও অভিযোগ তার সাক্ষ্য দেয়। গণমাধ্যমে প্রায়ই এ ধরনের ঘটনা ও অভিযোগের খবর প্রকাশিত হতে দেখা যায়। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনেও আইন প্রয়োগের নামে পুলিশের সদস্য ও কর্মকর্তারা কীভাবে সাধারণ মানুষের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন করছে, জুলুম ও হয়রানি করছে তার বিবরণ পাওয়া যায়। দুর্ভাগ্যজনক হলো, অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযুক্তদের ‘প্রত্যাহার’ বা ‘বদলি’ ছাড়া আর কোনো শাস্তি দেয়া হয় না। ফলে পুলিশি নির্যাতন কমার বদলে দিনকে দিন বাড়ছে, যা কোনো বিবেচনায়ই উদ্বেগজনক।
আইন-শৃংখলা সুরক্ষা ও নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই পুলিশের প্রধান কাজ। মানুষ প্রয়োজনে ও বিপদাপদে পুলিশের শরণাপন্ন হয়। নিরাপত্তা, প্রতিকার ও সহায়তা চায়। এক্ষেত্রে পুলিশের আচরণ ও ব্যবহার হওয়া উচিত বন্ধুসুলভ ও সহযোগিতামূলক। কিন্তু বিভিন্ন অভিযোগ ও ঘটনাপ্রবাহ থেকে দেখা যায়, পুলিশের কাছ থেকে সদাচার ও সহযোগিতা কদাচিত পাওয়া যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুলিশের আচার-ব্যবহার অবন্ধুসুলভ, ভোগান্তিকর ও হয়রানিমূলক। সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো, পুলিশের একাংশের আচরণ শুধু অবন্ধুসুলভ নয়, সন্ত্রাসীসুলভ। চাঁদাবাজি, গ্রেফতার বাণিজ্য, ভয়ভীতি প্রদর্শন করে অর্থআদায় ইত্যাদি দিনকে দিন বাড়ছে। যার কাছে নিরাপত্তার জন্য, আশ্রয়ের জন্য মানুষ ছুটে যায়, সেই পুলিশের আচরণ যদি সন্ত্রাসী-অপরাধীর মতো হয়, তাহলে তারা কোথায় যাবে! অপরাধে পুলিশের জড়িয়ে পড়ার ঘটনা ক্রমাগত বাড়ছে। মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়, তদন্তে ঘুষ গ্রহণ, গ্রেফতার বা ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় ইত্যাদির পাশাপাশি ছিনতাই, রাহাজানি, ডাকাতি, মাদক ব্যবসাসহ এমন কোনো অপরাধ নেই যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে নেই। পুলিশ সদর দফতরের সূত্রমতে, বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে গত এক বছরে ৯ হাজার ৯৫৮ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। শাস্তির এই তথ্য থেকেই বুঝা যায়, অভিযোগ কেবলই অভিযোগ না, অনেক ক্ষেত্রেই অভিযোগের সত্যতা রয়েছে। পুলিশের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বাড়ার কারণে প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুলিশের ভাবমর্যাদাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, একই সঙ্গে পুলিশের প্রতি, আইনের শাসনের প্রতি গণমানুষের আস্থা ও বিশ্বাস হ্রাস পাচ্ছে। আইন হাতে তুলে নেয়ার প্রবণতা বাড়ছে। এ অবস্থাকে ভয়ংকর বললেও কম বলা হয়।
একথা বলাই বাহুল্য, পুলিশ ছাড়া কোনো দেশ চলতে পারে না। দেশের আইন-শৃংখলা রক্ষা ও নাগরিক নিরাপত্তা প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ সরকারের ক্ষমতার প্রতিনিধি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করে। জনবান্ধব পুলিশের পক্ষেই কেবল এসব দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করা সম্ভব। বন্ধু যখন ভয়ের কারণ হয়, তখন আর কোনো কিছুই ঠিক থাকে না। মানুষ সেবা থেকে বঞ্চিত হয়, পুলিশ ও সরকারের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ হয়। এমতাবস্থায়, পুলিশকে জনবান্ধব, হিতৈষী, দুর্নীতি ও অপরাধমুক্ত করার কোনো বিকল্প থাকতে পারে না। পুলিশের বর্তমান অবস্থা কেন এরকম হয়েছে, তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা ও কারণ শনাক্ত করা জরুরি। বিশ্লেষকদের মতে, নিয়োগ পদ্ধতি ও দলীয়করণপ্রবণতা এ অবস্থার জন্য প্রধানত দায়ী। নিয়োগ পদ্ধতি বিশেষত কনস্টেবল নিয়োগ পদ্ধতি অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ। এই পদ্ধতিতে ঘুষ-দুর্নীতির যেমন সুযোগ রয়েছে, তেমনি ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব বিস্তারেরও সুযোগ রয়েছে। এই ত্রুটিপূর্ণ নিয়োগ পদ্ধতির কারণে সৎ, যোগ্য, শিক্ষিতদের অনেকেই পুলিশে আসতে পারছে না। যারা আসছে তাদের একাংশ আসছে ঘুষ দিয়ে, আরেক অংশ আসছে রাজনৈতিক প্রভাবে। এখানে সততা, যোগ্যতা ও শিক্ষার তেমন কোনো বালাই থাকছে না। জানা গেছে, পুলিশ সদর দফতর এই ত্রুটিপূর্ণ নিয়োগ পদ্ধতি পাল্টানের চিন্তা-ভাবনা করছে। নতুন নিয়োগ পদ্ধতি প্রবর্তন করতে চাচ্ছে, ঘুষ, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিহত করাই যার লক্ষ্য। আমরা এ চিন্তা-ভাবনা ও উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। অবশ্যই নিয়োগ, প্রমোশন, পদায়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা ও নিয়মানুবর্তিতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাহলে সৎ, যোগ্য ও শিক্ষিতরা যেমন পুলিশে আসতে পারবে, তেমনি উপযুক্তরাই যথাযথ অবস্থানে গিয়ে দায়িত্ব পালন করতে পারবে। একই সঙ্গে অপরাধী পুলিশের বিরুদ্ধে আইনানুগ শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এতে অপরাধে জড়িয়ে পড়া পুলিশের সংখ্যা কমবে, অপরাধ প্রবণতা হ্রাস পাবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন