শাবান মাস বিদায়ের সাথে সাথে আকাশে উজ্জল এক বাকা চাঁদ উদিত হওয়ার মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বে ফিরে আসে রহমাতের ঝর্নাধারা রমজানুল মুবারক।
সময়ের আবর্তে আরবি সনের এগারোটি মাস অতিক্রম করে আমাদের কাছে হাজির হয়েছে রহমাতের ঝর্ণাধারা রমজানুল মুবারক। বহু প্রতীক্ষিত বস্তু যখন সুন্দর উপস্থাপনায় কারো কাছে উপস্থিত হয়, তখন আর আনন্দের কোনো সীমা থাকে না। তেমনি, চাতক পাখির ন্যায় এগারোটি মাস প্রতীক্ষার পর মুসলমানদের কছে যখন মাহে রমজানুল মুবারক উপস্থিত হয়, তখন প্রভাহিত হতে থাকে রহমাতের ঝর্ণাধারা। খুলে দেয়া হয় ক্ষমার দুয়ার। খুলে দেয়া হয় জান্নাত। আকাশের দরজা। বন্ধ করে দেয়া হয় জাহান্নামের দরজা। কবর আযাব। শয়তানকে করা হয় শিকল বন্ধি। পবিত্র করে তোলা হয় মানুষকে। পাপ থেকে করা হয় মুক্ত। ধনীরা আদায় করতে থাকে গরীবের হক। আদায় করতে থাকে জাকাত। আদায় করে ফেৎরা। পাপীরা তাওবার মাধ্যমে ফিরে আসে সত্যের দুয়ারে। ধণী-গরিব, শত্রু-মিত্র দাঁড়িয়ে যায় একই কাতারে। শুরু হয় শন্তি, সৌহার্দের অপরুপ লীলা ও রহমাতের ঝর্ণাধারা।
কৃচ্ছসাধনা, ত্যাগ, সংযম এবং পরহিতৈষনার মহান বার্তা নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয় হিজরী সালের নবম মাস মাহে রমজান। এ মাসকে মহান আল্লাহ তা’আলা জাল্লা শানহু সিয়াম পালনের মাস হিসেবে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এ মাসের প্রতিটি ক্ষণ-অনুক্ষণ আল্লাহ তা’আলার খাস রহমাতে পরিপূর্ণ। এ মাস এক অসাধারণ মাস। নিঃসন্দেহে এ মাস স্বতন্দ্র ও মাহাত্ব্যের দাবি রাখে।
সমগ্র মুসলিম জাহানে রহমাত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস মাহে রমজানের কঠোর সিয়াম সাধনা শুরু হয়। দীর্ঘ এক মাস ব্যাপি রমজানের কঠোর পরিশ্রম ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে আল্লাহ’র তাকওয়া অর্জন ও এর সামগ্রিক সুফল সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে পারলে বিশ্বব্যপি মানবতার শান্তি ও সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত হবে। রমজানের রোজা স্বাধনার মাধ্যমে মানুষের অন্তরের রিপুকে আল্লাহ’র তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিশ্চিত করা হয়। অন্তরের পশু প্রবৃত্তি তথা নফসে আম্মারাকে বশীভূত করে মানুষ নফসে লাওয়ামা ও নফসে মুতমাইন্না (সর্বোচ্চ প্রশান্ত আত্মা) এর পর্যায়ে উপনিত হয়। প্রকৃত রোজাদার তাই এ মাসে আত্মশুদ্ধি ও আত্মসংশোধনের পর্যায় উপনিত হয়। আত্মশুদ্ধি ও আত্মসংশোধনের মাধ্যমে আল্লাহ’র নৈকট্য লাভ করে। আর সত্যিকার সিয়াম সাধনার মাধ্যমে সমাজ থেকে সকল অন্যায়, অনাচার, ব্যবিচার ও সন্ত্রাস দুরীভূত হয়। গোটা ব্যক্তি জীবনে নিরাপদ ও নির্বিঘ্নে জীবন যাপনের নিশ্চয়তা লাভ করা যায়। এ মাসে রমজান পালনের মাধ্যমে মুমিনরা তাদের ঈমানি চেতনা জাগ্রত করে এবং আত্মশুদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহ’র নিবেদিত বান্দা হওয়ার মহান সুযোগ লাভ করে।
রোজা পালনের কিছু সুন্নাত বা মুস্তাহাব আদব রয়েছে। যেগুলো পালন করা অতি জরুরি। রয়েছে অনেক অনেক সাওয়াব। যদিও তা ছেরে দিলে রোজা ভেঙ্গে যাবে না বা গুনাহও হবে না। তবে পূণ্যে ঘাটতি হবে। তা আদায় করলে সাওয়াবের পরিপূর্ণতা আসে। নিম্মে এগুলো আলোচনা করা হলো।
১. সাহরি খাওয়া। ফরমানে মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম হচ্ছে,
(ক) তোমরা সাহরি খাও, কারণ সাহরিতে বরকত রয়েছে। (বুখারি: হাদিস নং ১৮০১, মুসলিম: হাদিস নং ২৪১৫)
(খ) আমাদের (মুসলিমদের) ও ইয়াহুদি- নাসারাদের রোজার মধ্যে পার্থক্য হলো সাহরী খাওয়া। (মুসলিম: হাদিস নং ২৪১৬, আবু দাউদ: হাদিস নং ২৩৩৬)
(গ) মু’মিনের সাহরিতে উত্তম খাবার হলো খেজুর। (আবু দাউদ)
(ঘ) (রোজাদারদের জন্য) সাহরি হলো একটি বরকতময় খাবার। তাই কখনো সাহরি খাওয়া বাদ দিওনা। কেননা, সাহরির খাবার গ্রহণ কারীকে আল্লাহ তা’আলা ও তার ফিরিশতারা স্বরণ করে থাকেন। (আহম্মদ)
২. সাহরি দেরী করে খাওয়া উত্তম। রাতের শেষাংশে গ্রহণকৃত খাবারকে সাহরি বলা হয়। এ প্রসঙ্গে ফরমানে মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম হচ্ছে,
(ক) হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত রাদি-আল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর সাথে সাহরি খেয়ে ফজরের নামাজের উদ্দেশ্যে দাঁড়ালাম। আমি (আনাস) বললাম, সাহরি ও নামাজ এ দু’য়ের মধ্যে সময়ের কতটুকু ব্যবধান ছিলো? তিনি বললেন, পঞ্চাশ আয়াত পাঠ করার পরিমান সময়। (বুখারি: হাদিস নং ১৭৯৯, মুসলিম: হাদিস নং ২৪১৮)
৩. সাহরির সময়কে ইবাদতে কাজে লাগানো। প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে মহান আল্লাহ তা’আলা আরশ থেকে প্রথম আসমানে নেমে আসেন। আর বান্দাদের আহব্বান করে বলেন, “এখন যে ব্যক্তি আমার কাছে দুয়া করবে, আমি তা কবুল করবো। যা কিছু আমার কাছে চাইবে আমি তাকে তা দেব। যে আমার কাছে এখন মাপ চাইবে, আমি তাকে মাফ করে দেব। (বুখারি, মুসলিম) অতএব তখন কুরআন অধ্যয়ন, তিলাওয়াত, তাহাজ্জুদের নামাজ, তাওবাহ-ইস্তেগফার, মিলাদ ও কিয়াম এবং দুয়া কবুলের জন্য এটা উত্তম সময়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, “যারা শেষ রাতে জেগে উঠে তাওবাহ-ইস্তেসফার করে।” (সুরা : যারিয়াত, আয়াত নং ১৮)
৪. সুর্য্য অস্ত যাওয়া মাত্র ইফতার করা। অর্থাৎ তাড়াতাড়ি ইফতার করা। অতিরঞ্জিত সাবধানতার নামে ইফতার বিলম্ব না করা। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম বলেছেন,
(ক) মানুষ যতদিন পর্যন্ত তাড়াতাড়ি ইফতার করবে, ততদিন তারা কল্যাণের মধ্যে থাকবে। (বুখারি হাদিস নং ১৮৩৩, মুসলিম হাদিস নং ১০৯৮)
(খ) যতদিন মানুষ তারাতারি ইফতার করবে ততদিন দীন ইসলাম বিজয়ী থাকবে। কেননা, ইয়াহুদি ও নাসারাদের অভ্যাস হলো ইফতার দেরিতে করা। (আবু দাউদ, ৩য় খন্ড, হাদিস নং ২৩৪৫)
৫. ইফতারের সময় দুয়া করা। এ মুহূর্তটি জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয়ার সময়। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম বলেছেন,
(ক) ইফতারের সময় আল্লাহ তা’আলা অনেক লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। আর এ মুক্তি দানের পালা রমজানের প্রতি রাতেই চলতে থাকে। সে সময় সিয়াম পালনকারী প্রত্যেক বান্দার দু’আ কবুল হয়। (আহম্মদ)
(খ) প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম যখন ইফতার করতেন তখন বলতেন, হে আল্লাহ! তোমার জন্য রোজা রেখেছি, আর তোমারই রিযিক দ্বারা ইফতার করছি। (আবু দাউদ, ৩য় খন্ড, হাদিস নং ২৩৫০)
(গ) প্রিয়নবীসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম ইফতারের সময় এ দু’আটি পাঠ করতেন, পিপাসা নিবারিত হল, শিরা উপশিরা সিক্ত হলো এবং আল্লাহ’র ইচ্ছায় পুরস্কারও নির্ধারিত হলো। (আবু দাউদ)
৬. বেশি বেশি কুরআন পাঠ করা, সালাত আদায়, যিকর ও দুয়া করা। রমজান যেহেতু কুরআন নাযিরের মাস তাই এ মাসে কুরআন তিলাওয়াত অন্য সময়ের চাইতে অনেক বেশি করা উচিত। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম বলেছেন, রোজা ও কুরআন (কিয়ামতের দিন) বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, হে প্রতিপালক! আমি তাকে খাদ্য ও কাম প্রবৃত্তি থেকে দিনের বেলা বাধা প্রদান করেছি। সুতরাং তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল কর। কুরআন বলবে, হে পরয়ারদিগার! আমি তাকে রাতের বেলায় ঘুম থেকে বাধা প্রদান করেছি। সুতরাং তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল কর। তখন উভয়ের সুপারিশ কবুল করা হবে। (বায়হাকী, শুআবুল ঈমান ও আহম্মদ)
৭. ইবাদতের তাওফীক কামনা ও আল্লাহ’র দয়া অনুধাবন করা। আমারা যে ইবাদত করি তা অবশ্যই আল্লাহর দয়া। তিনি যে কাজে আমাদেরকে তাওফিক দিয়েছেন সেজন্য আমরা তার শুকরিয়া আদায় করি। ভয় ও আশা নিয়ে ইবাদত করতে হবে। গর্ব-অহঙ্কার ও হিংসা বান্দার ইবাদতকে নষ্ট করে দেয় এবং কুফরি ও শিরক করলে তার কোনো নেকই আল্লাহ’র কাছে পৌঁছে না বরং ইবাদত সমুহ ধ্বংস ও বাতিল হয়ে যায়।
৮. ইয়াতিম, বিদবা ও গরীব মিসকীনদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া ও বেশি বেশি দান সদকা করা। হাদিসে এসেছে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দানশীল আর রমজানে তার এ দানশীলতা আরো বেড়ে যেত। (মুসলিম)
৯. উত্তম চরিত্র গঠনের অনুশীলনা করা। রমজান ধৈর্যধারনের মাস। আর সিয়াম হলো এ এ কার্য প্রশিক্ষণের ইনিষ্টিটিউট। কাজেই এ সময় আমাদেরকে সুন্দর চরিত্র গঠনের অনুশীলন করতে হবে। হযরত আবু হুরায়রা রাদি-আল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম বলেছেন, সিয়াম ঢাল স্বরুপ, সুতরাং তোমাদের কেউ সিয়াম অবস্থায় হলে সে যেন অশ্লীলতা ও মূর্খতা পরিহার করে। যদি কেউ তাকে গালি দেয়, সে যেন বলে আমি রোজাদার। (বুখারি, হাদিস নং ১৭৯৫; মুসলিম হাদিস নং ১১৫১)
১০. অপচয় ও অযথা খরচ থেকে বিরত থাকা। খাওয়া দাওয়া, পোষাক-পরিচ্ছেদ ও আরাম আয়েশে অনেকেই অপচয় ও অপব্যয় করে থাকে। যা এক গর্হিত কাজ। এর থেকে বিরত থাকা সকলের একান্ত কর্তব্য।
১১. রুটিন করে সময়টাকে কাজে লাগানো। অহেতুক কথাবার্তা, আড্ডা বাজি, গল্প- গুজব, বেহুদা তর্কবির্তক পরিহার করা। রুটিন করে পরিকল্পনা ভিত্তিক কাজ করা। এতে জীবন অধিকতর ফলপ্রসূ হবে।
১২. দুনিয়াবী ব্যস্ততা কমিয়ে দেয়া। রমজানের এ বরকতময় মাসে অর্থ উপার্জন ও ব্যবসা বাণিজ্যের ব্যবস্তা কমিয়ে দিয়ে আখেরাতের মুনাফা অর্জনের জন্য অধিকতর বেশি সময় দেয়া আবশ্যক। দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী আর আখিরাত চিরস্থায়ী। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “যার আখিরাতের জীবন সর্বোত্তম এবং চিরস্থায়ী।” (সূরা আলা: ১৭)
১৩. আল্লাহ’র নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা। রমাজানের পবিত্র দিন ও রাতগুলোতে ইবাদত করার তাওফীক দেয়ায় মাবুদের প্রশংসা করা।
১৪. মিথ্যা থেকে বিরত থাকা। হযরত আবু হুরায়রা রাদি-আল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম বলেছেন, যে মিথ্যা কথা ও তদারূপ কাজ এবং মূর্খতা পরিত্যাগ করলো না, তার পানাহার বর্জনে আল্লাহ’র কোন প্রয়োজন নেই। (বুখারি, হাদিস নং ৫৭১০; আবু দাউদ, হাদিস নং ৩২৬২; তিরমিযী হাদিস নং ৭০৭)
মহান আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে কুরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক চলার তৈফিক দান করুন। আমিন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন