দেশের গণপরিবহন ব্যবস্থা চরম বিশৃঙ্খলা, অব্যবস্থাপনা ও নৈরাজ্যের শিকার। রাজধানী শহর ঢাকার পরিস্থিতি আরো প্রকট, অস্বস্তিকর। ঢাকা নগরীর গণপরিবহন খাতে দীর্ঘদিনের ক্রমবর্ধমান নৈরাজ্য, যানজট ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে গত একযুগে সরকারের নানাবিধ উদ্যোগ দৃশ্যত: কোন কাজে আসেনি। অবশেষে দুই ভাগে বিভক্ত ঢাকা উত্তরের (ডিএনসিসি) মেয়র আনিসুল হক গণপরিবহনে প্রত্যাশিত পরিবর্তন আনতে নতুন ৩ হাজার বাস নামানোর পরিকল্পনা প্রকাশ করেছেন। এসব বাস ৫টি বড় কোম্পানীর মাধ্যমে ঢাকার বিভিন্ন রুটে চলাচল করবে বলে জানা গেছে। গত শনিবার ঢাকার একটি হোটেলে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় উত্তরের সিটি মেয়র জাতীয় পত্রিকার সম্পাদকদের কাছে গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে তার পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন। ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থায় বিদ্যমান বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য, যানজট ও যাত্রীসেবার মানহীনতার নেপথ্য কারণগুলোও আংশিক তুলে ধরেছেন সিটি মেয়র। ব্যক্তি মালিকানায় পরিচালিত শত শত বাস কোম্পানীর নিম্নমানের, ত্রুটিপূর্ণ, ফিটনেসবিহীন ও নোংরা হাজার হাজার বাস চলছে নিরাপত্তা, প্রয়োজনীয় শৃঙ্খলা ও যাত্রিসেবার গাইডলাইন ছাড়াই। গণপরিবহনে বিশৃঙ্খলার জন্য ব্যক্তিমালিকানাধীন এসব বাসকেই দায়ী করছেন নগর বিশেষজ্ঞরা। নগর পরিবহন ব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে কিছুসংখ্যক বড় প্রতিষ্ঠানের হাতে ঢাকার গণপরিবহনখাতকে ছেড়ে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ডিএনসিসি মেয়রের পরিকল্পনার সাথে দক্ষিণের মেয়রকেও অনুরূপ সমন্বিত উদ্যোগের কথা ভাবতে হবে। তবে রাস্তা ও ফুটপাত অবৈধ দখলমুক্ত করে যানজটমুক্ত ঢাকা গড়ে তুলতে উত্তরের সিটি মেয়র ইতিমধ্যে যে সব সাহসী উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন তা’ নাগরিক সমাজের প্রশংসা অর্জন করেছে। তেজগাঁও, গাবতলী, মোহাম্মদপুর ও গুলশানে উচ্ছেদ অভিযানের সুফল ইতিমধ্যেই পেতে শুরু করেছে নগরবাসী।
দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে দাবী করা হচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ ও ‘ভিশন ২০২১’ রূপকল্পের আওতায় আগামী দশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে জাতিকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে। এমতাবস্থায় ঢাকা বিশ্বের অন্যতম নোংরা, অনিরাপদ ও বসবাসের অযোগ্য শহরের আন্তর্জাতিক তালিকায় ধারাবাহিকভাবে স্থান পাচ্ছে। শুধুমাত্র রাজধানীতেই যানজটে প্রতিদিন লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দশ-পনের মিনিটের রাস্তা অতিক্রম করতে দেড়-দুই ঘণ্টা লেগে যাচ্ছে। এতে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা- ও নাগরিকদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে, অন্যদিকে বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করাও সম্ভব হচ্ছে না। ব্যক্তি মালিকানায় চলমান ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলো প্রায়শ: রাস্তায় অচল হয়ে যানজটের সৃষ্টি করছে। এসব লক্কড়-ঝক্কড় গাড়ির কালো ধোঁয়া, বিকট হাইড্রোলিক হর্ণ, ভেতরের নোংরা অপরিচ্ছন্ন অপরিকল্পিত আসনে গাদাগাদি করে যাত্রী বোঝাই করার বাস্তবতা নিত্যদিনের। ঢাকা থেকে বাইরের জেলাগুলোতে চলমান বাস সার্ভিসে কিছুসংখ্যক অত্যাধুনিক, বিলাসবহুল বাস-কোচ চলাচল করলেও ঢাকা সিটিতে চলমান হাজার হাজার গাড়ির শতকরা নব্বইভাগই কাক্সিক্ষতমান ও চলাচলে উপযোগী নয়। গাড়ির ফিটনেস, আভ্যন্তরীণ পরিচ্ছন্নতা থেকে শুরু করে চালক ও কন্ডাক্টরদের আচরণ, যোগ্যতা-দক্ষতা অথবা ভাড়া আদায়ের শৃঙ্খলা, কোন ক্ষেত্রেই এখানে কোন মানদ- রক্ষিত হয় না।
গণপরিবহন ব্যবস্থা কোন দেশ বা আধুনিক নগরীর সভ্যতা ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনার প্রতীক। গণপরিবহন ব্যবস্থাকে বিশৃঙ্খল, নাগিরকদের চলাচল ও জীবন যাত্রাকে অনিরাপদ ও অস্বাস্থ্যকর রেখে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও উন্নয়নে প্রত্যাশা পূরণ করা সম্ভব নয়। ঢাকার নাগরিক জীবনের অন্যতম বিড়ম্বনা হিসেবে চিহ্নিত যানজট ও গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে ডিএনসিসি মেয়রের উদোগগুলো প্রশংসনীয়। এসব উদ্যোগ সফল হলে ঢাকার গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ও মানোন্নয়ন সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়। তবে শুধুমাত্র মেয়রের পক্ষে দীর্ঘদিনে গড়ে ওঠা বিশৃঙ্খলা ও জঞ্জাল থেকে নগরীকে মুক্ত করা সম্ভব নয়। নগরীর যানজট, গণপরিবহনে শৃঙ্খলা, নাগরিক নিরাপত্তা, রাস্তায় পানিবদ্ধতা, ফুটপাত অপদখল, সরকারী জমি, খাল, নদী দখল ও দূষণমুক্ত করতে সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। সম্পাদকবৃন্দের সাথে মতবিনিময় সভায় মেয়র আনিসুল হক জনসচেতনতা সৃষ্টিতে গণমাধ্যমের সহযোগিতা চেয়েছেন, আবার সম্পাদকদের কেউ কেউ ঢাকার নাগরিক সমস্যা নিরসনে নগর সরকারের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছেন। নির্বাচনের আগে ঢাকার মেয়রদ্বয় ‘ক্লিন ঢাকা, গ্রীন ঢাকা’ গড়ে তোলার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা’র বাস্তবায়নে তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড ও গাবতলী বাসস্ট্যান্ডকে অবৈধ দখলমুক্ত করা এবং অবৈধ বিলবোর্ড অপসারণের মধ্য দিয়ে ডিএনসিসি মেয়র তার সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। এ জন্য তিনি অবশ্যই প্রশংসার দাবীদার। তার এই কাজে সকলকে সহযোগিতা করতে হবে। গণপরিবহন ব্যবস্থাসহ অবিচ্ছিন্ন ইউটিলিটি সার্ভিসগুলোর উন্নয়নে এবং শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ঢাকা দক্ষিণের মেয়রকেও একই প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় উদোগ নিতে হবে। তাদের এই কর্মপ্রয়াসে সরকার, নাগরিক সমাজ এবং গণমাধ্যমও সহায়ক ভূমিকা রাখবে। সকলের সমন্বিত উদ্যোগেই ঢাকা নগরীকে পরিবেশবান্ধব, গতিশীল ও বাসযোগ্য করে তোলা সম্ভব।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন