বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

মাঠ সাংবাদিকতা : তার রূপান্তরের ধারা

মিজানুর রহমান তোতা | প্রকাশের সময় : ৪ জুন, ২০১৮, ১২:০০ এএম

একটানা প্রায় ৪০বছর পার করলাম মফস্বল সাংবাদিকতায়। আমি মাঠে ঘাটে ঘুরে রিপোর্ট লিখতে লিখতে মাঠ সাংবাদিকতার উপর একটা বই লিখে ফেলি। সেটাও বেশ আগের কথা। সেদিন আর এদিনের বিরাট পার্থব্য দেখি মাঠ সাংবাদিকতায়। শহর, গ্রাম-মফস্বলের খবর আগের চেয়ে সংবাদপত্রে স্থান পাচ্ছে বেশি। বিস্ময়কর নৈপুণ্যের সঙ্গে মফস্বলের অনেক সাংবাদিক অসাধ্য সাধন করেছেন। মেধাগত উৎকর্ষ ও তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতায় মাঠ সাংবাদিকদের একটা সুনাম আছে। লেখার স্টাইলের ভিন্নতা ও বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে অনেকেই পারদর্শিতার পরিচয় দিয়ে উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন। আগের মতো মফস্বলের সাংবাদিক বলে নাক সিঁটকানো ভাবটা নেই। মাঠ সাংবাদিকতায় জনগণকে দৃষ্টির আড়ালে থাকা ছবি দেখানো যায়। অকৃপণ প্রকৃতির দৃশ্য অবলোকনের সুযোগ আছে। মাঠের ওপর নির্ভরশীল দেশের প্রতিটি মানুষ। সেজন্য মাঠের দিকে সবার দৃষ্টি। তা কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি ও রাজনীতি যেটিই হোক না কেন। আগে একসময় গ্রামীণ সাংবাদিকতা ছিল কঠিন। আধুনিক প্রযুক্তির বদৌলতে এখন খুব সহজ হয়েছে। হাতের মুঠোয় চলে এসেছে সবকিছু। মাঠের সাংবাদিকরা জীবন জানালায় শুধুই যে নিকষ কালো অন্ধকার দেখেছেন। তা নয়। আলোর সন্ধানও পেয়েছেন।
আমার ব্যক্তিগত কথায় আসি। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির সাথে যুক্ত। অনেকটা নেশার বশবর্তী হয়ে সাংবাদিকতা পেশায় জড়িত হওয়া। এরই মধ্যে পেশায় কেটে গেল প্রায় চার দশক। দৈনিক গণকন্ঠের ঝিনাইদহ জেলা প্রতিনিধি, দৈনিক সমাচারের স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক স্ফুলিঙ্গের বার্তা সম্পাদক, দৈনিক ঠিকানার নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক আজাদের বিশেষ সংবাদদাতা, সর্বশেষ দৈনিক ইনকিলাবে ১৯৯০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত যুক্ত আছি। ক্ষণিকের জন্যও অন্য কোন পেশায় আত্মনিয়োগ করিনি। আমি জীবনটা দেখি একটা দিনের সমান। সমাজ ও ইতিহাস জানার আগ্রহ সবার। আমার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। পেশার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সমাজের সব অত্যাচার, নির্যাতন, অনাচার, অনিয়ম, অব্যবস্থা, দুর্দশা, সমস্যা, অসঙ্গতি, ব্যর্থতা, দুর্নীতি, বিশৃঙ্খলা, সুলভ উপায়ে স্বার্থসিদ্ধির নানা বিষয়ের বিরুদ্ধে কলম ধরতেই পেশাটি বেছে নিই। পেশাটি সত্যিকারার্থে স্বাধীন। কিন্তু নানা কারণে সব কথা প্রাণ খুলে লেখা যায় না, বলা যায় না। কোথায় যেন আটকে যায়। বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। লিখলেই ঘটে বিপত্তি। আমার সাংবাদিকতা জীবনে যেমন রঙিন স্বপ্ন ভরপুর, তেমনি অনেক দুঃখ-কষ্ট পেয়েছি, হয়েছি বেদনায় নীল। অনেক সময় নির্যাতনের মাত্রা চরমে পৌঁছে শিউরে ওঠার মতো দুঃস্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্ন হয়ে গেছে তছনছ। ছোট বড় ভূমিকম্পও নেমে এসেছে মাঝেমধ্যে। আবার সিডর ও আইলায় বিধ্বস্ত সুন্দরবনের গাছপালার মতো জেগে উঠেছি। যুক্তিহীনতার ছড়াছড়ির মাঝে যুক্তির সন্ধান করতে পিছু হটিনি। পরিষ্কার বিশ্বাস জন্মেছে সামাজিক দায়বোধ থেকে করা সৎ সাংবাদিকতায় অবশ্য সাময়িক আঘাত আসলেও পরাস্ত করতে পারে না।
মাঠ সাংবাদিকতায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। আগে ডাকযোগে সংবাদ পাঠাতে ও ছাপাতে সময় পার হয়ে যেত, যখন আর খবরের গুরুত্বটা থাকতো না। টরে টক্কার টেলিগ্রাম ও পোস্ট অফিসের বুক পোস্টে জেলা ও উপজেলা থেকে সংবাদ পাঠানো ছিল কতটা দুরুহ তা যারা কালের সাক্ষী তারাই ভালো বলতে পারবেন। আধুনিকতায় সংবাদপত্রে দেশের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে খবর পৌঁছে যাচ্ছে মুহূর্তে ইন্টারনেটে। সেজন্যই তো এখন আর সংবাদপত্রের ডেস্কের আর মাঠের সাংবাদিকতার মধ্যে খুব বেশি ফারাক নেই। তবে সত্যিকার মাঠ সাংবাদিকতা এখনো কঠিন। বহু প্রতিকূলতার মধ্যে জীবন নামের বিশাল স্রোতসিনী নদী পাড়ি দিতে হয়। কাটাতে হয় জোয়ার ভাটার মধ্যে। প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। সমাজের অনাচার, বিশৃঙ্খলা, সন্ত্রাস, খুন, গুম, রাহাজানি, ছিনতাই, অপহরণ ও চোরাচালানসহ নানাবিধ লোমহর্ষক অপরাধের খবরা-খবর প্রকাশ করতে হয় বুকে সাহস বেঁধে। এতো গেল ঘটনাপ্রবাহ। খবরের পেছনের খবর প্রকাশ করতে গেলেই তো হয় যত বিপত্তি। কারো না কারো বিরাগভাজন হতেই হয়। তখনই দেখা যায় আঘাতের পর আঘাত আসে। তারপরেও চ্যালেঞ্জ নিয়ে নিধিরাম সর্দারের মতো কলম যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হচ্ছে মাঠ সাংবাদিকদের। সাংবাদিকের কলম শাণিত তরবারীর মতোই ভূমিকা পালন করে। যুগে যুগে মাঠ সাংবাদিকতায় অনেকেরই উজ্জ্বলতার ইতিহাস আছে। এটি অস্বীকার করার উপায় নেই।
দেশের প্রায় সবখানেই কমবেশি পেশাদার সাংবাদিকরা বিভিন্ন সময় হামলা, মামলা, জেল, জুলুম, হুলিয়ার শিকার হয়েছেন। সত্য লিখলেই ক্ষুব্ধ গোষ্ঠী তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে স্বার্থান্বেষী মহল। ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দেয় সাংবাদিকদের পেছনে। মামলাবাজ লোক যোগাড় করে কোনরকমে একটা মামলা ঠুকে দিয়ে হাতকড়া পড়িয়ে জেলের ভাত খাওয়ানো হয়। রিমান্ডে নিয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করার ঘটনাও কম নয়। মাঠে অর্থাৎ মফস্বলে কেন রাজধানী ঢাকাতেও সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে বহুবার। প্রতিনিয়ত সাংবাদিকরা কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হচ্ছেন। জীবনের উত্তাল ঢেউয়ের মধ্যে আসলে প্রায় প্রতিদিন মনে হয় এই ক’দিন আগের কথা, আমরা মফস্বল সাংবাদিকতায় যা দেখেছি তার পুরোটাই বদলে গেছে। আগের পরিবর্তনই নয়, এখনো পরিবর্তন ঘটে চলেছে। সেই টেলিগ্রাম ও টেলিফোনে নিউজ পাঠানো থেকে ফ্যাক্স, এরপর ডেক্স টপ কম্পিউটার আরো একধাপ পরিবর্তন হয়ে ল্যাপটপ ঘাড়ে ঝুলেছে মাঠ সাংবাদিকদের। যেখানে সেখানে বসে, একেবারে অজপাড়া গায়ে বসেও মুহূর্তে খবর পাঠানো যাচ্ছে পত্রিকায়।
দীর্ঘদিন মাঠ সাংবাদিকতায় একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে, কেন যেন মাঠ সাংবাদিকতার গুরুত্ব কমে আসছে। আগের চেয়ে অনেক প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া হয়েছে। আগে যেভাবে একটা রিপোর্ট বের হলে তোলপাড় হতো, নেয়া হতো তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা। মাঠের অনেক খবরই পাল্টে দিতে পারতো জাতীয় রাজনীতি ও অর্থনীতিকে। সাংবাদিকদের ইউনিটি এতটা মজবুত ছিল যে কোন মহলের রক্তচক্ষুকে ন্যুনতম ভয় পেতেন না সাংবাদিকরা। এখন সেই পরিবেশ পাল্টে গেছে। একেক মিডিয়া একেক রকম প্রকাশ করছে একই খবর। সাংবাদিকরাও বিভাজন হয়ে পড়েছে। এর সুবিধাভোগ করছে সমাজবিরোধী, দুর্নীতিবাজরা। এক সময় অবিভক্ত যশোর সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ছিলাম। যেতাম ঢাকায় বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) মিটিংএ। এলাকায় কিংবা ঢাকায় সাংবাদিক পরিচয় পেলে যে মর্যাদা দিতো মানুষ, এখন ততটা দেয় না। এর কারণও আমরা। নিজেরাই নিজেদের মর্যাদা গুরুত্ব যেন নষ্ট করে ফেলেছি। মুষ্টিমেয় সাংবাদিক নামের সাংঘাতিক ও অপসাংবাদিকদের কারণে পেশার মর্যাদা ভূলুন্ঠিত হচ্ছে। আগে ঢাকায় হোক আর মাঠে হোক সাংবাদিকরা ভিন্ন পেশায় খুব একটা ছিলেন না। আপাদমস্তক সাংবাদিকই বেশি ছিল। এখন আর তা নেই। মাঠ সাংবাদিকতায় ভিন্ন পারসেপশন তৈরি হচ্ছে। সাংবাদিক নামেই যেন নাক সিঁটকানো একটা ভাব। এর থেকে বের হয়ে আসার পথ খুঁজে বের করতে হবে প্রেসক্লাব ও সাংবাদিক নেতৃবৃন্দকে। তা না হলে ভবিষ্যতে সাংবাদিকতা আর সাংবাদিকদের হাতে থাকবে না। এটি নীতিবাক্য নয়, মাঠের চারিদিকে সাংবাদিকতার নামে যা ঘটছে তাতে এমন আশঙ্কা জন্ম হওয়াটাই স্বাভাবিক।
লেখক : দৈনিক ইনকিলাবের বিশেষ সংবাদদাতা

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন