অর্থনৈতিক রিপোর্টার : ব্যাংক খাত বর্তমানে নানা সমস্যায় জর্জরিত। অধিকাংশ ব্যাংকের কাছে ঋণ দেয়ার মতো পর্যাপ্ত টাকা নেই। সংকট মোকাবিলায় নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও সুফল আসেনি। ব্যাংক খাত থেকে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় করে। ব্যাংক নিয়ে তাই সতর্ক সরকার। এ জন্য নির্বাচনী বছরে ব্যাংক খাতকে যে কোনো ভাবেই চাঙা করতে চায় সরকার। সেজন্য আগামী অর্থবছরের বাজেটে বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী চমক হিসেবে ব্যাংক খাতের করপোরেট কর হ্রাস করার ঘোষণা দিতে পারেন।
এ খাতে দেড় থেকে দুই শতাংশ করপোরেট কর হ্রাস হতে পারে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। এর মাধ্যমে ব্যাংক খাতে চলমান সংকট কাটিয়ে পুনরুজ্জীবিত করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এদিকে অন্যান্য খাতে করপোরেট কর হ্রাস করা হলে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারে বিধায় আগামী অর্থবছর অন্যান্য খাতে করপোরেট কর হ্রাস করা হচ্ছে না বলেও সূত্র জানিয়েছে।
অবশ্য এর আগে অর্থমন্ত্রী আগামী অর্থবছরের বাজেটে করপোরেট কর কমানোর আভাস দিয়েছিলেন। অর্থমন্ত্রী করপোরেট করের দুটি স্তর ও করপোরেট করে বড় পরিবর্তনের ঘোষণা দিলেও আগামী বাজেটে তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী এনবিআররের মতামত চাইলে এনবিআরের পক্ষ থেকে বলা হয়, আগামী অর্থবছর তা করতে গেলে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণে প্রভাব পড়তে পারে। সেজন্য আগামী অর্থবছর এই করে কোনো পরিবর্তন না করতে বলা হয়েছে। করপোরেট করহার তুলনামূলকভাবে বেশি বলে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য তা কমাতে ব্যবসায়ীরা বলে আসছিলেন।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার প্রধান হাতিয়ার ভ্যাট। দ্বিতীয় খাত হিসেবে প্রত্যক্ষ কর বা আয়করকে বিবেচনা করা হয়। আয়কর লক্ষ্যমাত্রার সিংহভাগ আসে উৎসে কর। উৎসে করের পরেই মোটা অঙ্কের কর আসে করপোরেট কর থেকে। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক করপোরেট কর আদায়ের পরিমাণ অনেক কম। প্রযুক্তি দুর্বলতায় সরকার বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সঠিকভাবে করপোরেট কর আদায় করতে পারে না। ব্যাংক খাত প্রযুক্তিনির্ভর হওয়ায় করপোরেট কর আদায় সহজ ও স্বচ্ছ। সেজন্য করপোরেট করহার কমানো হলে রাজস্ব আদায়ে প্রভাব পড়তে পারে। এ বিবেচনায় শুধু ব্যাংক খাতের করপোরেট কর কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সূত্র মতে, দেশে বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি ৫৭টি ব্যাংক রয়েছে। এর মধ্যে ৩০টি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। বর্তমানে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকের করপোরেট করহার ৪০ শতাংশ, যা তিন অর্থবছরে পরিবর্তন করা হয়নি। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে করপোরেট করহার ৪২ দশমিক ৫০ শতাংশ ছিল। তবে ২০১৩ সালে সরকারি অনুমোদিত ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকের মতো ৪০ শতাংশ হারে করপোরেট কর দিয়ে আসছে। অপরদিকে ছয় বছর ধরে পুঁজিবাজারে তালিকাবহির্ভ‚ত ব্যাংকের করহার ৪২ দশমিক ৫০ শতাংশ বহাল রয়েছে। কয়েক বছর ধরে ব্যাংকসংশ্লিষ্টরা ব্যাংক খাতের করপোরেট করহার কমানোর সুপারিশ করে আসছেন। কয়েক বছর ব্যাংক খাতের করপোরেট করে হাত না দেওয়ায় আগামী অর্থবছর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ও তালিকাবহিভর্‚ত ব্যাংকের করপোরেট কর দেড় থেকে দুই শতাংশ হারে কমানো হতে পারে।
এনবিআর সূত্র মতে, দেশে বর্তমানে করপোরেট করের আটটি স্তর রয়েছে। এর মধ্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে ২৫ শতাংশ; তালিকাবহির্ভ‚ত কোম্পানিকে ৩৫ শতাংশ; পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ও ২০১৩ সালে অনুমোদন পাওয়া নতুন ব্যাংককে ৪০ শতাংশ; তালিকাবহির্ভ‚ত ব্যাংককে ৪২ দশমিক ৫০ শতাংশ; মার্চেন্ট ব্যাংককে ৩৭ দশমিক ৫০ শতাংশ; সিগারেট, জর্দা ও গুলসহ তামাকজাত দ্রব্য প্রস্তুতকারী কোম্পানিকে ৪৫ শতাংশ; পুঁজিবাজার তালিকাভুক্ত মোবাইল কোম্পানিকে ৪০ শতাংশ ও তালিকাবহির্ভ‚ত কোম্পানিকে ৪৫ শতাংশ এবং কোম্পানির লভ্যাংশ আয়ের ওপর ২০ শতাংশ করপোরেট কর দিতে হয়। এছাড়া তৈরি পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠানকে ১০ ও ১২ শতাংশ এবং সমবায় প্রতিষ্ঠানকে ১৫ শতাংশ হারে করপোরেট কর দিতে হয়।
সূত্র জানায়, ব্যাংকে নগদ জমার হার হ্রাস, বেসরকারি ব্যাংকে সরকারি আমানত জমার সীমা বৃদ্ধি ও রেপোর সুদহার হ্রাস করা হলেও টাকার সংকটে ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে পারছে না। উল্টো পুরোনো ঋণের সুদহার বাড়িয়ে উদ্যোক্তাদের চিঠি দেওয়া হচ্ছে। বেসরকারি বিনিয়োগের ওপর এর প্রভাব পড়েছে। বেসরকারি বিনিয়োগ ও ব্যাংক খাতকে চাঙা করতে করপোরেট কর হ্রাস করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সরকার। এছাড়া চলতি বছর সরকারের নির্বাচনী বছর হওয়ায় এবং রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যাংক খাত ছাড়া অন্য কোনো খাতে করপোরেট করে হাত দিতে চায় না সরকার।
সূত্র জানায়, অর্থমন্ত্রী ও এনবিআরের সঙ্গে প্রাক-বাজেট আলোচনায় ব্যবসায়ীরা করপোরেট কর কমানোর জোর দাবি জানিয়েছেন। তারা যৌক্তিকতা দেখিয়েছেন, করপোরেট করহারের কারণে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে না। করপোরেট কর কমানো হলে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে। তবে নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, ব্যবসায়ীদের যুক্তি পুরোপুরি যৌক্তিক নয়। কারণ বৈশ্বিক করের গড়হার ২৪ দশমিক ২৯ শতাংশ, যা পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে এখনও করহার অনেক কম। এছাড়া ব্যবসার ক্ষেত্রে সরকার করছাড় ছাড়াও নানামুখী সুবিধা দিয়ে আসছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের তুলনায় করপোরেট কর আদায়ে পিছিয়ে রয়েছে। বর্তমানে দেশে করপোরেট কর-জিডিপি দুই দশমিক ৩৩ শতাংশ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন